কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর ঈর্ষার কারণে সম্মানহানি হবে। ব্যবসায়ীদের আশানুরূপ লাভ না হলেও মন্দ হবে না। দীর্ঘ ... বিশদ
আজ তোমাদের শোনাব সেই বিরল প্রতিভার মানুষটির কথা, যাঁর নাম শরৎচন্দ্র পন্ডিত। যিনি ছিলেন ধনী-দরিদ্র, বিখ্যাত-অখ্যাত সবারই অতিপ্রিয় ‘দাদাঠাকুর’, যার মধ্যে একই সঙ্গে ছিল চাণক্য পন্ডিতের কূটবুদ্ধি, বীরবলের মতো ‘উইট’ সৃষ্টির ক্ষমতা, গোপাল ভাঁড়ের মতো রস পরিবেশনের দক্ষতা, আবার বিদ্যাসাগরের মতো তেজস্বিতা।
শরৎচন্দ্রের জন্ম ১৮৮১ সালের ১৩ই বৈশাখ, বীরভূম জেলার শিমলান্দি গ্রামে তাঁর মামারবাড়িতে। ছেলেবেলাতেই মা-বাবাকে হারান তিনি। মুর্শিদাবাদ জেলার দফরপুর গ্রামে কাকা রসিকলাল তাঁকে মানুষ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন খুব জেদী, ডানপিটে আর নির্ভীক। একবার এক বৈষ্ণব প্রতিবেশীর বাড়ির চালে কয়েকটা চালকুমড়ো দেখে বালক শরৎচন্দ্র তার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু বৈষ্ণব জানান যে ওটি তিনি জন্মদিনে তাঁর গুরুদেবের সেবায় দেবেন বলে ঠিক করেছেন। শরৎচন্দ্র মনে মনে ফন্দি আঁটলেন। গুরুদেবের জন্মদিনের দিন বৈষ্ণব দেখেন সেই চালকুমড়োটির গায়ে ‘গরু’ লিখে দিয়েছে কে যেন! বৈষ্ণবের বুঝতে বাকি রইল না কাজটি কার। তিনি নালিশ জানালেন শরৎচন্দ্রের কাকার কাছে। অপ্রস্তুত কাকা ছুটে এসে দেখেন ‘গরু’ নয় চালকুমড়োর গায়ে তো ‘গুরু’ শব্দটি লেখা আছে! ‘আসামী’ শরৎচন্দ্র কখন সকলের অজান্তে ‘গরু’ কে ‘গুরু’ করে দিয়ে গিয়েছেন!
নদীর তীরের উত্তপ্ত বালির ওপর দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেতে বালক শরৎচন্দ্রের পায়ে ফোস্কা পড়ত। অপারগ হয়ে একদিন তিনি কাকার কাছে একজোড়া জুতোর বায়না ধরলেন। দরিদ্র কাকা তাঁকে প্রতিবেশী কাঠের পাওয়ালা প্রতিবন্ধী হরি স্যাকরাকে দেখিয়ে বলেছিলেন ‘ওর তো একটা পা নেই তবু চলে যাচ্ছে, আর তোর জুতো না হলে চলবে না?’ সেই থেকেই আমৃত্যু শরৎচন্দ্র জুতো পরেননি। এমনি ছিল তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা। বরং তাঁর এই খালি পা সম্বন্ধে পরবর্তীকালে মানুষের কৌতূহলী প্রশ্নের সরস উত্তর দিতেন এই বলে যে, বাগদাদের রাজারা হলেন ‘খালিফা’ আর তিনি ‘খালিপা’!
এন্ট্রান্স পাশ করে বর্ধমান রাজকলেজে এফএ ক্লাসে ভর্তি হলেও দারিদ্র্যের কারণে পড়া শেষ করতে পারেননি। মাত্র বাইশ বছর বয়সে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ছেলেবেলায় কাকা শিখিয়েছিলেন ‘ইট ইজ বেটার টু স্টার্ভ দ্যান সার্ভ।’ তাই পরের দাসত্ব তিনি কখনও করেননি। দফরপুর গ্রামে অল্প টাকায় একটা পুরনো কাঠের প্রেস এবং কিছু টাইপ কিনে শুরু করলেন তাঁর ‘পন্ডিত প্রেস’। তিনি ছিলেন একধারে প্রোপ্রাইটার, কম্পোজিটর, প্রুফ রিডার এবং ইঙ্কম্যান। ছাপানোর কাজে তাঁকে তাঁর স্ত্রী প্রভাবতী দেবী সাহায্য করতেন।
দাদাঠাকুর ছিলেন বলিষ্ঠ সাংবাদিক। রঘুনাথগঞ্জ থেকেই তাঁর সম্পাদনা ও প্রকাশনায় বের হত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’ ও ব্যাঙ্গ পত্রিকা ‘বিদূষক’। এই ‘বিদূষক’কে কেন্দ্র করে তিনি বহু বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মতিলাল নেহরু, পন্ডিত মদনমোহন মালব্য, লালা লজপত রায়, মহম্মদ আলি জিন্না প্রমুখ। বাংলা ও ইংরেজি দুটি ভাষাতেই তাঁর কবিতা লেখার প্রতিভা ছিল যেমন, ঠিক তেমনি তাঁর অদ্ভূত ক্ষমতা ছিল কথার মধ্যে পানিং, প্যালিনড্রোম, অ্যাক্রসটিক ব্যবহারের! দু-একটি উদাহরণ দিলেই মজাটা বুঝতে পারবে তোমরা। স্নেহভাজন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে একদিন তিনি বললেন, ‘দ্যাখো সুভাষ, আমার মনে হয় তুমিই বিদেশিদের তাড়াবে, কারণ তোমার নামের গোড়াতেও ‘সু’, শেষেও ‘সু’। তাই তোমার জুতোর ঠোক্কর হজম করা বড় মারাত্মক হবে ইংরেজদের পক্ষে।’
‘বোতল পুরাণ’ ছিল তাঁর আরেকটি দুর্দান্ত সৃষ্টি। বোতলের আকারে পত্রিকা, যা তিনি নিজেই ফিরি করতেন কলকাতার পথে পথে স্বরচিত গান গেয়ে গেয়ে—
‘হিউমার স্যাটায়ার উইট / আর ইন মাই পাবলিকেশন / জেন্টেলম্যান টেক দি বট্ল / ফর ইওর রিলাক্সেশন।’
তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে একবার এক গোরা সার্জেন্ট সবক’টি ‘বোতলপুরাণ’ কিনে নিয়ে এই ‘ হকার-কবি ’ কে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।
কলকাতার বেতারকেন্দ্রের সঙ্গেও তাঁর ছিল দীর্ঘদিনের যোগাযোগ। ‘পল্লীমঙ্গল আসর’ ও ‘ছোটদের বৈঠক’-এ তিনি রস পরিবেশন করতেন। ‘প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর’ ছিল তাঁর একটি জনপ্রিয় খেলা যা তিনি ছোটদের শোনাতেন। একটি উদাহরণ দিলেই সে খেলার মজা টের পাবে।
প্রশ্নঃ রাম-রাবণের যুদ্ধের কারণ জান কি?
উত্তরঃ রাম-রাবণের যুদ্ধের কারণ জানকী।
কলকাতার রাস্তার অদ্ভূত অদ্ভূত নামকরণকে বিষয় করে তিনি লিখলেন তাঁর উপভোগ্য কবিতা ‘কলকাতার ভুল’ —
‘...একটা সাঁকো নাইকো যেথায় / জোড়াসাঁকো নাম / সেথা দিনে রাতে রবির উদয় / দেখে আসিলাম...।’
এই বিরল প্রতিভাধর মানুষটি তাঁর জীবনের শেষ দিনটিতেও কিন্তু রসিকতা করতে ছাড়েননি। ১৯৬৮ সালে সাতাশি বছর বয়সে তিনি এই পৃথিবীর লীলাও সাঙ্গ করেছিলেন তাঁর জন্মদিনের তারিখ সেই ১৩ই বৈশাখেই!