বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
এবার স্থির করলাম আটলান্টিক পার হয়ে আর আমেরিকা যাব না। ওপথ আমার চেনা হয়ে গিয়েছে। তাই নতুন পথে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম প্রশান্ত মহাসাগর পার হয়ে।
আমাদের বিমান উড়ল রাত একটা পনেরো মিনিটে। কখন যে হংকং পৌঁছে গেলাম হালকা ঘুমের ঘোরে তা বুঝতে পারিনি। এবার লে ওভার ঘণ্টা দুয়েকের সময় হাতে, তার মধ্যে আছে হ্যান্ড লাগেজের সিকিওরিটি চেকিং।
সাজানো বিমানবন্দরটির কাচের আবরণ দিয়ে হংকং শহরের কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। বিমানটি অবতরণের সময় ওপর থেকে দেখা যাচ্ছিল বিশাল লম্বা সর্পিল একটি সেতু উপসাগরের উপর দিয়ে কোথায় যেন চলে গিয়েছে। পরে জানলাম সেতুটির নাম হংকং জুহাই ম্যাকাও ব্রিজ।
ম্যাকাও হংকং-এর লাগোয়া একটি দ্বীপ। ফেরি করে সরাসরি চলে যাওয়া যায় এই দ্বীপে। সরাসরি বাসরুটও আছে। ম্যাকাও দ্বীপে যেতে গেলে কোনওরকম ভিসা লাগে না। দ্বীপটি খুব সাজানো, চাইনিজ ও জাপানি জিনিসের ছড়াছড়ি। কেনাকাটার ফাঁকে ফাঁকে পর্যটকরা মিশে যায় স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে ক্যাসিনো পার্লারে ভাগ্য পরীক্ষায়।
এবার আরেকটি অধ্যায় শুরু। ক্যাথে প্যাসিফিক বিমানটি আমাদের নিয়ে ইস্ট চায়না সি ঘেঁষে, কোনাকুনিভাবে জাপানের উপর দিয়ে অনন্ত প্রশান্ত মহাসাগর পার হতে লাগল। একটু পরেই বিমান সেবিকাদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল খাবার পরিবেশনে। হরেক রকমের খাবার ককটেল, স্ন্যাকস, অ্যাপিটাইজার হিসাবে স্যুপ, একটু বিরাম দিয়ে এল স্যালাড, চিকেন পাস্তা, চিজ উইথ ফ্রুটস শেষ পাতে আইসক্রিম। এর সঙ্গে জুসের ছড়াছড়ি আপেল, পাইনাপেল, ম্যাঙ্গো, অরেঞ্জ, স্ট্রবেরি ইত্যাদি। যাত্রীদের মধ্যে আপেল জুসের চাহিদাই বেশি। জম্পেশ খাওয়াদাওয়া শেষ করে আপেল জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে কখন যে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম খেয়ালই নেই। যখন ঘুম ভাঙল তখন বিমান বহুদূর চলে এসেছে। কানাডার আকাশ অতিক্রম করে আমেরিকার আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে প্রায়। আর অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের বিমানটি অবতরণ করবে। একটু পরেই ঘোষণা সিট বেল্ট বেঁধে নিন জেএফকে বিমানবন্দরে আমরা পৌঁছে গিয়েছি। অবশেষে আমেরিকার মাটি স্পর্শ করলাম।
আমার গন্তব্যস্থল নিউইয়র্ক শহর। এই শহরে বেশ কয়েকবার আসা হল, অনেক কিছুই আমার দেখা। শহরের সাবওয়ে ট্রেন বিভিন্ন দিকে ছুটে চলেছে ম্যানহাটন, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, কুনি আইল্যান্ড, টাইমস স্কোয়্যার, কলম্বাস সার্কেল, সেন্ট্রাল পার্ক—এসব জায়গা ছাড়াও এই শহরের বহুদিকে ঘুরে বেড়িয়েছি এই ট্রেনে চেপে। বিভিন্ন স্তর দিয়ে নানারকম ট্রেন ছুটে চলে। প্রথম প্রথম স্টেশনে ঢুকেই মাথা গুলিয়ে যেত এই বিশাল কর্মকাণ্ড দেখে। একেকটি ট্রেন একেক স্টেশনে এসে অন্য ট্রেনকে ধরিয়ে দিচ্ছে। এই ভাবেই যাত্রীরা যে যার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাচ্ছে। ট্রেন বদলের জন্য স্টেশনের বাইরে আসতে হচ্ছে না। এক টিকিটেই বহুদূর চলে যাওয়া যায়। অ্যালফাবেট দিয়ে ট্রেনের নাম, যেমন আমার অ্যাপার্টমেন্টের তলা দিয়ে যায় এফ ট্রেন। স্টেশনগুলিতে বিশ্বের নানা দেশের মানুষ দেখা যায়, স্প্যানিশ, চাইনিজ, বাংলাদেশি, আফ্রো, আমেরিকান, পাকিস্তানি এরা ছিল নিত্য যাত্রী। ট্রেনের কামরার মধ্যে কতরকম দৃশ্যই না দেখা যায়—মেমসাহেবের কোলে তার আদুরে ছোট্ট কুকুরছানাটি আমাদের সহযাত্রী হয়ে দুলতে দুলতে চলেছে। একবার তো আমি ঘাবড়েই গিয়েছিলাম কোনও এক স্টেশন থেকে বিশালাকার এক শ্বেতাঙ্গ উঠল। তার পাশে আমাকে লিলিপুট মনে হচ্ছিল। সেও একটি হুমদো কুকুর নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমি তো ভয়ে জড়সড়। এই ট্রেনে ভিখারিও ওঠে, তাদের চাহিদা বেশি নয়, মাত্র এক ডলার, কফি কিনে খাবে। আহা বেচারাদের দেখে মনে হচ্ছিল কোনও এক শনিবারের আড্ডায় কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে ধরে নিয়ে গিয়ে আকণ্ঠ কফি পান করাই। মাঝে মাঝে ট্রেনের মধ্যে ম্যাজিক শো হচ্ছে, কখনও আবার লম্ফঝম্প করে কেউ জিমনাস্টিক দেখাচ্ছে। এদেশের মানুষজন খুবই মিউজিক লাভার, স্টেশনগুলি জমজমাট হয়ে ওঠে মিউজিকের ফোয়ারায়। কেউ বা একা আবার কেউ কেউ দলবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান গাইছে। চলমান যাত্রীরা তাদের ব্যস্ততার মধ্যেও কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে। যাবার সময় দিয়ে যাচ্ছে দু-এক ডলার, এই ভাবেই চলছে ক্যাপ কালেকশন। অনেক সময় আমেরিকার বিখ্যাত পপ সিঙ্গাররা মিশে যায় এই গানের দলের সঙ্গে। পৃথিবী বিখ্যাত অন্ধ পপ সিঙ্গার স্টিভ ওয়ান্ডার এদের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছেন একদিন। আজও তাঁর গানের লাইন কানে বাজে ‘আই জাস্ট কল্ড ইউ টু সে লাভ ইউ’।
নিউইয়র্ক শহরের আবহাওয়ার কোনও বিশ্বাস নেই। শীত ও গ্রীষ্ম মিলেমিশে থাকে এই শহরে। এখন ডিসেম্বর মাস উৎসবের মাস, ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে তুষারপাত, প্রথমে ছিটেফোঁটা, তারপর হালকা, এর পরপরই অঝোরে ঝরছে শ্বেতশুভ্র তুষার। তুষারের মোড়কে ঢেকে গিয়েছে নিউইয়র্ক। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই জেঁকে বসেছে শীত। তাপমাত্রা নেমে গিয়েছে মাইনাসে। গাছের পাতার রংবদলের পালা শেষ, ফল বিদায় নিয়েছে অজস্র শুকনো পাতা ঝিমিয়ে ঝরে পড়ে রয়েছে গাছগাছালির তলায়। পত্রবিহীন গাছগুলি এতদিন দাঁড়িয়েছিল বেআব্রু হয়ে, তুষারপাত শুরুর পর থেকে গাছগুলি নবরূপে সজ্জিত হয়েছে। পেঁজা তুলোর মতো শ্বেতশুভ্র তুষারের আবরণে গাছের ডালপালাগুলি নিজেদেরকে ঢেকে নেয়। মাইলের পর মাইল রাস্তার দু’ধারের গাছের সারিকে মনে হয় কাশফুলের বাগান। ঘাসগুলো ঢেকে যায় বরফের চাদরে, হঠাৎ যেন এক ঝাঁক এলব্রাটস পাখি দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়ার আগে সাদা পালকের আস্তরণ সারা শহরে বিছিয়ে দিয়ে গিয়েছে। আর এই বিস্তীর্ণ বরফের ওপর সূর্যের দ্যুতি এক মায়াময় দৃশ্যের অবতারণা করে। ধবধবে সাদা, স্নিগ্ধ এ এক অপরূপ সাজ। পার্কগুলো বরফে ঢেকে যায়। শিশু কিশোরদের আনন্দের সীমা থাকে না, তারা কেউ স্নোম্যান বানাচ্ছে কেউ আবার স্নোবল বানিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারছে আর তার পোষা কুকুর ছুট্টে গিয়ে সেটি কুড়িয়ে নিয়ে আসছে। সান্তা ক্লজের আগমনী বার্তার আভাস দেয় যেন এই তুষারপাত। বড়দিনের এই শহরের আকর্ষণই আলাদা। সকাল থেকে চার্চে প্রেয়ার শুরু হয় আর আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয় সারা শহর। নিউইয়র্ক শহরে রকফেলার সেন্টারে চব্বিশে ডিসেম্বর আমরা হাজির হয়েছিলাম ক্রিসমাস ট্রি দেখার জন্য। বেশ কয়েকদিন পরপর তুষারপাত হওয়ায় সামনের চত্বর বরফে আবৃত ছিল, সেই বরফের ওপর যুবক যুবতী শিশু কিশোররা হইহই করে স্কেটিং করছিল, ধুপধাপ করে বরফের ওপর পড়ছিল আবার উঠে দাঁড়াচ্ছিল। ছোটরা হাত ধরাধরি করে উন্মাদনায় সাঁইসাঁই করে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
অবশেষে মহাসমারোহে ক্রিসমাস ট্রি স্থাপন করা হল, চারদিকে চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা। কাতারে কাতারে মানুষের সমাগম, এক মহান ঐতিহ্য নিয়ে এই অনুষ্ঠানটি প্রায় ৯০ বছর ধরে পালিত হয়। ক্রিসমাস ট্রি নিয়ে এক ঘটনার কথা শুনলাম এক শ্বেতাঙ্গীর মুখে, একসময় আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই মন্দা যাচ্ছিল, তার ছাপ বিশেষভাবে নিউইয়র্ক শহরের মানুষজনের ওপর পড়ে, তারা দিন দিন ঝিমিয়ে পড়ছিল। এই সময় এক সঞ্জীবনী শক্তি নিয়ে হাজির হয়েছিল ক্রিসমাস ট্রি উৎসব। আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল চারদিকে।
ক্রিসমাস ট্রি হয় বিশালাকার, কোনওটা ১০০ ফুট কোনওটা আবার ৭০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতার। নানা জায়গা থেকে আনা হয় এই গাছ। কখনও কানেটিকাট থেকে কখনও বা পেনসিলভানিয়া থেকে। বড়দিনের উৎসব শেষ হয়ে গেলে প্রতি বছর জানুয়ারির শুরুতে গাছটি রকফেলার সেন্টার থেকে সরানো হয় তারপর তাকে দান করা হয় হ্যাবিট্যাট ফর হিউম্যানিটি নামের একটি সংগঠনকে। সেই সংগঠনের তত্ত্বাবধানে গাছটি চেরাই করে পাওয়া কাঠ দান করা হয় গৃহহীনদের ঘর নির্মাণের জন্য।
ঠান্ডা বাড়ছে, আজ ৩১ ডিসেম্বরে বছরের শেষদিন। নিউইয়র্ক শহরের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা ও বহু রাস্তার সংযোগস্থল ঘিরে এক বিশাল চত্বর, নাম টাইমস স্কোয়্যার। সেখানেই আমরা দাঁড়িয়ে, নববর্ষ উদ্যাপন দেখব বলে। আলোয় আলোকময় রং-বেরঙের বৈদ্যুতিক আলোকসজ্জা ও প্রোজ্জ্বল সাইনবোর্ডের বৈচিত্র্য এক স্বপ্নপুরীতে পরিণত করেছে। প্রথম দর্শনে অনেকেই বিস্ময়ে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। টাইমস স্কোয়্যারের পাশেই ব্রডওয়ে। এটি হল নাটকপাড়া, নাটক চলছিল ‘ফ্রোজেন’। অনবদ্য সব নাটক মঞ্চস্থ হয় এখানে। এখান থেকে একটু আড়াআড়িভাবে তাকালেই দেখা যায় এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। আজ নব সাজে সজ্জিত হয়েছে নতুন বছরকে আহ্বান জানাতে। নববর্ষের শুভসূচনা দেখার জন্য এই কনকনে ঠান্ডায় লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগম টাইমস স্কোয়্যারে। এ এক উত্তাল জনসমুদ্র, তবু কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা নেই, সবাই যেন আনন্দের সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে, ম ম করছে সুন্দর পারফিউমের গন্ধ, তাকে কখনও ছাপিয়ে যাচ্ছে উন্মাদনার আবেশ। উন্মুক্ত বিশ্ব মঞ্চে বসেছে কনসার্টের আসর, এসেছেন হলিউডের অভিনেতারা। মঞ্চ মাতিয়ে রেখেছেন নিউইয়র্কের জনপ্রিয় শিল্পীরা।
রাত ১১টা ৫৯ মিনিট বাজতেই কাউন্টডাউন শুরু। আমরা সবাই উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলাম এক অবিস্মরণীয় মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকার জন্য। বিশ্ব মঞ্চে হাজির হলেন সস্ত্রীক নিউইয়র্ক শহরের মেয়র। এবার তিনি ‘বিগ অ্যাপেল’ নামক ক্রিস্টাল বলের বৈদ্যুতিক বোতাম টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে ১২ ফুট ব্যাসের ১১ হাজার ৮৭৫ পাউন্ড ওজনের আলো ঝলমল স্ফটিক বলটি ৭০ ফুট উচ্চতা থেকে নেমে এল নীচে। পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে স্বাগত জানানো হল নতুন বছরকে। সঙ্গে সঙ্গে জন অরণ্যে শুরু হল জাতিধর্ম নির্বিশেষে আলিঙ্গনের জোয়ার আর নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময়। আতশবাজির আলোর ছটায় টাইমস স্কোয়্যার হয়ে উঠেছে যেন এক রঙিন পৃথিবী।
রাত বাড়তে লাগল, আর নয়, এবার ফেরার পালা। জন অরণ্যের মধ্যে থেকে হারিয়ে যাওয়া আমিকে খুঁজে নিয়ে পা বাড়ালাম নিজের গন্তব্যস্থলের অভিমুখে। তখনও কানে ভেসে আসছে বিশ্বমঞ্চ থেকে মারিয়া ক্যারির মধুর কণ্ঠের গান ‘I’d give my all for your love tonight’