কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বড়দিন একটি প্রধান উৎসব হিসেবে পালিত হয়। বড়দিন উৎসবের অন্যতম অঙ্গ হল বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকে উপহার দেওয়া-নেওয়া। এই প্রথার সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জুড়ে আছে কিছু খ্রিস্টীয় পৌরাণিক চরিত্রও। এঁরা হলেন ‘ফাদার ক্রিস্টমাস’ বা ‘সান্টাক্লজ’, ‘পেরে নোয়েল’, ‘সেন্ট নিকোলাস’ বা ‘সিন্টারক্লাস’, ‘ওয়েনাকসম্যান’, ‘সেন্ট বাসিল’, ‘ফাদার ফরেস্ট’, ‘ক্রিস ক্রিঙ্গল’, ‘জৌলুপুক্কি’, ‘বাব্বো নাতালে’, ‘লে বাফানা’। তবে, এই চরিত্রগুলির মধ্যে আধুনিককালে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলেন লাল পোশাকপরা সান্টাক্লজ।
কিন্তু কে এই সান্টাক্লজ? এই নামটিরই বা উৎস কী? সেই নিয়ে আছে অনেক গল্প। ‘সান্টাক্লজ’ নামটি ডাচ নাম সিন্টার ক্লাসের অপভ্রংশ। যে নামের মানে হল সেন্ট নিকোলাস। এই নিকোলাস চতুর্থ শতাব্দীতে তুরস্কের মিরার বিশপ ছিলেন। নিকোলাসের বাবা ছিলেন খুব ধনী। কিন্তু হঠাৎ বাবার মৃত্যু হল। নিকোলাসের তখন তরুণ বয়স। বাবার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলেন তিনি। তাঁর মনে ইচ্ছে হল এই সম্পত্তি তিনি মানুষের উপকারে লাগাবেন। ওই অঞ্চলে একজন গরিব মানুষ বাস করতেন। তাঁর ছিল তিন মেয়ে। টাকার অভাবে মেয়েদের বিয়ে দিতে পারছিলেন না তিনি। নিকোলাসের কানে সেই খবর পৌঁছতেই তিনি এক গভীর রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি একটি কাপড়ের ব্যাগে সোনার গয়না নিয়ে সেই গরিব মানুষটির বাড়ির চিমনির নীচে, যেখানে কাপড় শুকোচ্ছিল, তার ভেতর লুকিয়ে রেখে দিয়ে এলেন। পরদিন সকালে তাঁরা সেই সোনা ভর্তি ব্যাগ দেখে তো খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন! আর মহাআনন্দে বড় মেয়ের বিয়ে দিতে পারলেন। দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ের সময়ও ঘটল সেই একই ঘটনা। তখন সেই গরিব পরিবারটি বুঝতে পারল যে কোনও দয়ালু মানুষ তাঁদের কষ্টের কথা ভেবে সাহায্য করছেন। তৃতীয় মেয়ের যখন বিয়ের সময় হল তখন সেই দয়াবান ব্যক্তিকে আবিষ্কার করার জন্য সেই গরিব বাবা রাত জেগে আড়াল থেকে নজর রাখতে লাগলেন। কয়েকরাত এমন করে লুকিয়ে অপেক্ষা করার পর, এক রাতে সোনা ভর্তি ব্যাগ রাখতে যেই নিকোলাস এসেছেন, ওমনি সেই গরিব বাবা আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন। নিকোলাস স্বীকার করলেন যে তিনিই সোনা দিয়ে যেতেন তাঁদের। তবে তিনি চান না তাঁর এই দানের কথা কেউ জানুক তাই তিনি বারণ করলেন একথা কাউকে জানাতে। কিন্তু কথা চাপা থাকল না। আর এইভাবেই নিকোলাস হয়ে উঠলেন জনপ্রিয় ‘সান্টাক্লজ’। যাঁরা যাঁরা উপহার পেতেন, পরবর্তীকালে তাঁরাও সান্টাক্লজের নাম নিয়ে অন্যের উপকারে এমনভাবেই গোপনে সাহায্য করতেন। অনেক দেশে তাঁর সম্মানে ৬ ডিসেম্বর উপহার আদানপ্রদানের মাধ্যমে উৎসব পালন করা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস, নিকোলাস তাঁর সহকারীদের সাহায্যে এক বছর ধরে শিশুদের আচার-আচরণ ব্যবহারের খোঁজখবর নিয়ে ঠিক করেন কোন শিশু উপহার পাওয়ার যোগ্য আর কোন শিশুর সে যোগ্যতা নেই।
সান্টাক্লজের যে রূপটি আমরা এখন দেখতে পাই তার পেছনে যাঁরা আছেন তাঁদের মধ্যে আমেরিকান কার্টুনিস্ট টমডিন ন্যাস্টের (১৮৪০-১৯০২) নাম সবার আগে করতে হয়। ১৮৮০’র দশকে ন্যাস্টের কল্পনার সান্টাক্লজের আধুনিক রূপটি আমরা পাই। হাসিখুশি, নাদুসনুদুস, ভুঁড়িওয়ালা, সাদা চুল, দাড়ি, গোঁফের সান্টা পরে থাকেন লাল কোট, টুপি ও ট্রাউজার, যার কলারে, হাতায় আর টুপির শেষ প্রান্তে সাদা পশম দেওয়া, চোখে কখনও কখনও পরেন সানগ্লাস, কোমরে আর পায়ে কালো চামড়ার বেল্ট ও বুট। তাঁর পিঠে থাকে উপহার ভর্তি ব্যাগ, যাতে থাকে ভালো ছেলেমেয়েদের জন্য নানারকম উপহার আর দুষ্টু ছেলেমেয়েদের জন্য কয়লার টুকরো। বল্গা হরিণের টানা শ্লেজ গাড়ি চড়ে তিনি আসেন উত্তর মেরু থেকে খেলনা তৈরি করিয়ে। মুখে তাঁর বুলি থাকে— ‘হো হো হো!’ তিনি তাঁর সঙ্গে করে আনেন খুশি, শান্তি আর আনন্দ।
আমেরিকায় ও কানাডায় শিশুরা রাতে শুতে যাবার আগে সান্টার জন্য দুধের গ্লাস ও কুকির প্লেট সাজিয়ে রাখে, ব্রিটেনে ও অস্ট্রেলিয়ায় দেওয়া হয় শেরি ও কিমা পাই। ডেনমার্ক, নরওয়ে ও স্যুইডেনে ভাতের পরিজ ও দারচিনি। কোনও কোনও দেশে বল্গা হরিণদের জন্যও গাজর ও খড় রাখা হয়। শিশুরা ফায়ার প্লেসের ম্যান্টনের ওপর তাদের মোজা রেখে দেয় যাতে সহজেই সান্টার চোখে পড়ে। যাদের বাড়িতে ফায়ার প্লেস নেই তারা সদর দরজা খোলা রাখে সারা রাত সান্টাক্লজের জন্য।
ইতালিতে আবার সান্টাক্লজের ভূমিকাটি পালন করেন বাব্বো নাতালে। এদেশে আবার লে বাফানা উপহার নিয়ে আসেন। শোনা যায় এই লে বাফানা নাকি শিশু যিশুর জন্য উপহার আনতে বেরিয়েছিলেন কিন্তু পথে তিনি রাস্তা হারিয়ে ফেলেন। তাই তারপর থেকে তিনি সব শিশুদের জন্যই উপহার আনেন।
সান্টাক্লজকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে যত কৌতূহল তৈরি হয়েছে, তাঁকে নিয়ে ততই সৃষ্টি হয়েছে নানা গল্প ও চরিত্র। যেমন, সান্টাক্লজের স্ত্রীর নাম মিসেস ক্লজ। ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়াতে এবং কয়েকটি লাতিন আমেরিকান দেশের বিশ্বাস অনুসারে সান্টাক্লজ খেলনা তৈরি করেন এবং যিশুকে তা দেন। যিশুই সেইসব খেলনা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে ছোট ছেলেমেয়েদের উপহার দেন বড়দিনের আগের রাতে— ক্রিস্টমাস ইভে। শিশুরা সান্টাক্লজের উদ্দেশ্যে চিঠি লেখে তাদের পছন্দের জিনিসটা চেয়ে। ব্রিটেনে, এইসব চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয় যাতে বাতাসের মাধ্যমে পৌঁছে যায় সেই সুদূর উত্তর মেরুতে সান্টার কাছে। আবার কোনও কোনও দেশে গ্যাসবেলুনের সঙ্গে এইসব চিঠিগুলো বেঁধে আকাশে সান্টার উদ্দেশ্যে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
পৃথিবীতে বোধহয় এমন শিশু পাওয়া কঠিন যে সান্টাক্লজের কাছ থেকে উপহার পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ক্রিস্টমাস ইভে ঘুমোতে যায়নি, এবং ক্রিস্টমাসের দিন চোখ মেলেই এদিক ওদিক তাকিয়ে দুরু দুরু বুকে সেই উপহার খোঁজেনি! প্রিয়জনদের উপহার দিয়ে তোমরা নিজেরাও হয়ে উঠতে পারো এক একজন খুদে সান্টাক্লজ। এবারের বড়দিনে একবার সেই চেষ্টা করে দেখোই না— তোমাদের বড়দিনের আনন্দ আরও সহস্রগুণ যে বেড়ে যাবেই সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই!