বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
প্রথমে মনে হয়েছিল কোনও রাজপ্রাসাদ। ইতালীয় ঘরানায় তৈরি এই বাড়ি প্রাসাদই তো বটে!
এই বাড়ির ইতিহাস প্রায় ২১৯ বছরের পুরানো। সেই ১৮০০ সালে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জন অ্যাডামস আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তর ফিলাডেলফিয়া থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কংগ্রেস থেকে অনুমোদন নিয়েছিলেন। ওয়াংশিংটন ডিসি হয়ে উঠেছিল আমেরিকার নয়া রাজধানী। এই সময় ওয়াশিংটন ডিসিতে কংগ্রেস সদস্যদের নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ ও বইপত্র ব্যবহারের জন্য কোনও উপযুক্ত গ্রন্থাগার ছিল না। রাষ্ট্রপতি অ্যাডামস শুধুমাত্র কংগ্রেস সদস্যদের ব্যবহারের জন্য মাত্র ৫ হাজার ডলার ব্যয়ে একটি ছোট লাইব্রেরি তৈরির জন্য মার্কিন কংগ্রেস থেকে অনুমোদন নেন। তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ থেকে দু’জন সদস্যকে এই লাইব্রেরি পরিচালনার জন্য নিয়োগের বিধান অনুমোদন করান। এরপর অনুমোদিত অর্থে ইংল্যান্ড থেকে ১১ ট্রাঙ্ক ভর্তি বই আর ১ ট্রাঙ্ক ম্যাপ এনে ক্যাপিটল হিলের যেটুকু অংশ তখন তৈরি হয়েছিল তারই একপাশে ছোট আকারের লাইব্রেরিটি স্থাপিত হয়। নাম রাখা হয়েছিল ‘দ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’।
১৮১৪ সালে ইংরেজ সেনারা তাদের মার্কিন উপনিবেশ রক্ষার চেষ্টায় ওয়াশিংটনে এসে ক্যাপিটল হিলে কেন্দ্রীয় সরকারের মূল দপ্তরটি দখল করে নিয়েছিল। লাইব্রেরি অব কংগ্রেস সম্পূর্ণ পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। ব্রিটিশ সেনারা লাইব্রেরি অব কংগ্রেস পুড়িয়ে দেওয়ার পর গ্রন্থাগারটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত কোনও বই সেই সময় রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে যুদ্ধ শেষ হলে লাইব্রেরিটি নতুন করে গড়ে তোলার জন্য কংগ্রেস থেকে পুনরায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেফারসন যখন ফ্রান্সে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে ছিলেন, তখন সেখানকার দোকানে ঘুরে ঘুরে আমেরিকা সম্পর্কে বহু দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রহ করে এনে নিজের লাইব্রেরিতে রেখেছিলেন। ১৮১৪ সালের পর যখন লাইব্রেরি অব কংগ্রেস নতুন করে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়, তখন তিনি মার্কিন কংগ্রেসকে জানান, তার বইগুলো তিনি এই লাইব্রেরিতে দিতে ইচ্ছুক। তারা যে দাম দিতে পারবেন তাতেই তিনি সেই অমূল্য বইগুলো লাইব্রেরিকে দিয়ে দেবেন। কংগ্রেস মাত্র ২৩,৯৫০ ডলারে ৬,৪৮৭টি বাছাই করা বই জেফারসনের কাছ থেকে লাইব্রেরির জন্য কিনে নেয়। এভাবেই শুরু লাইব্রেরির জন্য বই সংগ্রহের কাজ। ১৮৯৭ সালে জেফারসন বিল্ডিংয়ের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ৫০ জন সুনির্বাচিত স্থপতি, ভাস্কর ও চিত্রকর লাইব্রেরি বাড়িটি নিখুঁত ও শিল্পমণ্ডিত করে গড়ে তোলেন। অন্য বাড়ি পরে তৈরি হয়। তিনটি বাড়ির মধ্যে জেফারসন বিল্ডিং বয়সে সবচেয়ে পুরনো। তারপরও বাড়িটি অতি সুন্দরভাবে সাজানো। ইতালীয় স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই জেফারসন বিল্ডিংয়ের সবচেয়ে বড় পড়ার ঘরটি তিন তলায়।
কালক্রমে এর আকৃতি ও সংগ্রহের বিশালত্বের সঙ্গে সঙ্গে লাইব্রেরির দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে সর্বসাধারণের জন্য। এই গ্রন্থাগারে এখন প্রায় ৪৭০ ভাষার ১৬৪ মিলিয়নের বেশি বই, জার্নাল ও সংবাদপত্রসহ নানা নথিপত্র সংরক্ষিত রয়েছে, বিশ্বের মধ্যে যা বৃহত্তম এবং অনন্য। বিভিন্ন বিষয়ের বই থরে থরে সাজানো। যার যে বই দরকার, কম্পিউটারের সাহায্যে মুহূর্তে এনে হাজির করে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে এখানে। এই গ্রন্থাগারের সংগ্রহশালার তাকগুলো পাশাপাশি সাজালে তা প্রায় ৫৩২ মাইল দীর্ঘ হবে, এমনই বিশাল এই গ্রন্থাগার। এর আর্কিটেকচারাল ডিজাইনও এককথায় অসাধারণ। প্লেটো, নিউটন, শেক্সপিয়রের মতো প্রতিভাধরদের লেখা বই-ই শুধু নয়, তাদের পূর্ণ অবয়বের মূর্তিতে এই গ্রন্থাগারের বিভিন্ন তলা সাজিয়ে তোলা হয়েছে। ‘ক্যাপিটল হিল’ মার্কিন সরকারের প্রধান কর্মকেন্দ্র। তারই লাগোয়া একটি পাড়া জুড়ে তিন-তিনটি বিশালাকার বাড়িতে চলছে এই গ্রন্থাগারের বিস্ময়কর কর্মযজ্ঞ।
অভিজাত, ব্যস্ত ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাভিনিউ ও তার পিছনের সেকেন্ড স্ট্রিট পর্যন্ত জায়গা জুড়ে বিশাল টমাস জেফারসন বিল্ডিং। পাশাপাশি ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাভিনিউয়ের অন্য ফুটপাতে ম্যাডিসন মেমোরিয়াল বিল্ডিং। আর জেফারসন বিল্ডিংয়ের পিছনে, সেকেন্ড স্ট্রিটের অন্যদিকের ফুটপাতে জন অ্যাডামস বিল্ডিং। পাশাপাশি তিনটি বাড়িতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। কিন্তু অবিরাম চলতে থাকা বাস ও গাড়ির স্রোত এবং নিরন্তর পথচলতি মানুষের ভিড় এড়ানোর জন্য এই তিনটি বাড়িতে যাওয়ার সুবিধার্থে রাস্তার তলা দিয়েও আন্ডারগ্রাউন্ড রোড নির্মাণ করা হয়েছে। সেই আন্ডারগ্রাউন্ড রোডে দিন-রাত সবসময় আলো জ্বলে। পড়ুয়ারা এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়িতে যান। শুধু তা-ই নয়, বই ভর্তি ছোট আকারের মোটর ট্রাকও এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সবেতেই আধুনিকতার ছোঁয়া।
জেফারসন বিল্ডিংয়ের মেঝে থেকে পাথরের স্তম্ভগুলো ১৬০ ফুট উঁচু। শুধু এই একটি হলেই ৪৫,০০০ হাজারেরও বেশি রেফারেন্স বই আছে। ২১২ জন পাঠক একসঙ্গে বসে পড়তে পারেন এই একটি হলঘরে। এটি ছাড়া আরও পড়ার ঘর আছে। প্রতিটি ডেস্কে পৃথক আলো, আরামদায়ক চেয়ারের ব্যবস্থা আছে। এত পাঠকের ভিড়, কিন্তু গোটা হলঘর নিস্তব্ধ, নিরিবিলি পরিবেশ। কেউ কাউকে বিরক্ত করে না। যে যার মতো করে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। পাশেই কম্পিউটার ক্যাটালগ সেন্টার। সেখানে দলে-দলে লোক কম্পিউটার টার্মিনালে তাঁর প্রয়োজনীয় বিষয়টি জেনে নিতে পারেন। জেফারসন বিল্ডিংয়ে লাইব্রেরির স্থান সংকুলান না হওয়ায় এই বাড়ির পিছনে, রাস্তার অন্য পারে তৈরি হয় জন অ্যাডামস বিল্ডিং। ১৯৩৯ সালে। সেটি জেফারসন বিল্ডিংয়ের মতো অত জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও বাড়ির সামনের দিক সুন্দর মার্বেল পাথরে মোড়া আর তার প্রধান প্রবেশপথে ব্রোঞ্জের বিরাট দরজা। তাতে শোভা পায় বারোটি মনুষ্য-মূর্তি। এই চমৎকার মূর্তিগুলো সেসব ঐতিহাসিক পুরুষদের, যাঁরা পৃথিবীর নানা দেশে লেখার হরফ আবিষ্কার করেছিলেন। জন অ্যাডামস বিল্ডিংয়েও যখন লাইব্রেরির স্থান সংকুলান হল না, তখন তৈরি করতে হয় আরও একটি বাড়ি। জেফারসন বিল্ডিংয়ের পাশাপাশি ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাভিনিউয়ের অন্য দিকে সেই নতুন বাড়ি জেমস ম্যাডিসন মেমোরিয়াল বিল্ডিং। নির্মিত হয় ১৯৮০ সালে। ফলে গোটা লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের স্থান-পরিধি দ্বিগুণ হয়ে যায়। এই তিনটি বৃহৎ বাড়ি ছাড়াও অন্যত্র এই লাইব্রেরির কর্মকেন্দ্র আছে। এই তিন বিল্ডিং মিলে সাধারণ পাঠকদের জন্য ২১টি পড়ার ঘর রয়েছে।
বড়দিন ও পয়লা জানুয়ারির ছুটি ছাড়া বছরের আর সব দিন লাইব্রেরি খোলা থাকে। পড়ার ঘর, প্রদর্শনী, ফিল্ম শো— এমনকী গোটা লাইব্রেরি ঘুরিয়ে দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। লাইব্রেরিতে নিয়মিতভাবে নানা ডকুমেন্টরি ফিল্ম দেখানো হয়। গান শোনানোর ব্যবস্থা রয়েছে। যার যেদিকে আগ্রহ, সব পাওয়া যায় হাতের মুঠোয়। এ যেন এক অজানা ভুবন।
শুনে অবাক হচ্ছেন? না, অবাক হইনি আমি। কারণ, এই ‘দ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’ যে দেশের সম্পত্তি, সেই দেশের নাম আমেরিকা। দুনিয়ার সর্বশক্তিমান দেশে যে এমন এক বিশাল লাইব্রেরি থাকবে, তা তো স্বাভাবিক। লাইব্রেরি তো দুনিয়ার ইতিহাস আগলে রাখে। ভবিষ্যতের দিশা দেখায়।