বেশি বন্ধু-বান্ধব রাখা ঠিক হবে না। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য আসবে। বিবাহযোগ আছে। কর্ম পরিবেশ পরিবর্তন হতে ... বিশদ
জঙ্গলের বারোটা রুট। প্রথমদিন আমাদের ছয় নম্বর রুট দেওয়া হল। জঙ্গলে আধঘণ্টা মতো যেতেই প্রথম চমক—একটা চিতা একটা ছোট্ট হরিণকে তাড়া করেছে। চিতার পা-গুলো এবং আকারটা দেখতে পেলাম গাছের আড়ালে। কিছুক্ষণেই জঙ্গলের এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়ে পালিয়ে গেল হরিণটা। আমরা চলে আসায় চিতাবাঘটা আর পেরিয়ে যেতে পারল না। সবাই বলল, ‘আমাদের জন্যই হরিণটা এ যাত্রায় বেঁচে গেল!’ এগিয়ে চললাম এবং জঙ্গল ক্রমশ আরও গভীর হতে লাগল। আমরা একবার রণথম্বরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রতিটি সাফারির সময় গাইড বলত, ‘আজ নিরানব্বুই শতাংশ আশা আছে বাঘ দেখার।’ কিন্তু কোনওদিনই বাঘ দেখতে পাইনি। তাই আমি আর আমার দাদামশাই এটাকে মজা করে গাইডের ‘অভিনয়’ বলতাম। এইবারও একটা উঁচু জায়গায় এসে আমাদের গাইড হিন্দিতে বলল আমরা যেন কেউ শব্দ না করি, সিংহ দেখার নিরানব্বুই শতাংশ সম্ভাবনা এখানে। তার কারণ, কাছেই একটি ছোট জলাশয়, সিংহ সেখানে জল খেতে আসে। কিন্তু আমি এই কথাটায় বিশেষ একটা গুরুত্ব না দিয়ে দাদামশাইকে বললাম, ‘ওই যে; আবার অভিনয় শুরু হয়েছে!’ আমার দাদামশাই এই কথায় সায় দিলেন ঠিকই, কিন্তু গাইডের এবারে উপদেশ শুধুমাত্র ‘অভিনয়’ ছিল না। হঠাৎ দেখি সেই উঁচু জায়গাটা থেকে একটা সিংহী নেমে আসছে...! চোখ একেবারে ধাঁধিয়ে গেল। আমাদের জিপটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিংহীটা। একেবারে কাছাকাছি এসে, তারপর এক লাফে জলাশয়টার দিকে গিয়ে জল খেতে লাগল। কিছুক্ষণ জল খেল, তারপর আবার একটা লাফ দিয়ে জলাশয়টার ওপারে গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। তারপর অনেকক্ষণ পা চাটল, হাই তুলল। সব শেষে, আবার জলাশয় পার করে আমাদের দিকে তাকিয়ে, উঁচু জায়গাটার উপর উঠে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে গেল। এতক্ষণ আমার বাবার ক্যামেরায় শাটার টেপার শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ ছিল না আমাদের জিপে। এবার আবার সবাই এই অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করলাম। আমার জীবনে প্রথম এমন একটা অভিজ্ঞতা। এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না যে সত্যিই এই ঘটনা ঘটেছে এক্ষুনি, মনে হচ্ছে যেন সবটাই একটা অপূর্ব স্বপ্ন। চোখ বন্ধ করলেই বারবার দৃশ্যটা ভেসে উঠছে চোখের ওপর। বাবা বললেন, তিনি নাকি একবারও ক্যামেরার শাটারটা ছাড়েননি। তাই নিজের চোখে যা দেখেছেন, সবটাই আছে ক্যামেরায় বন্দি। সেদিন আরও কয়েকটি হরিণ ছাড়া আর কিছু দেখিনি, কিন্তু যা দেখেছি, তাই যথেষ্ট।
পরের দিন ভোর পাঁচটায় উঠে আবার রওনা দিলাম সাফারি অফিসের পথে। এটা দু নম্বর সাফারি। তখনও আলো ফোটার কোনও নাম নেই। সাফারি শুরু হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে ভালো করে আলো ফুটল। শুনে গিয়েছিলাম গিরে নাকি খুব গরম। কিন্তু তবুও একটা করে জ্যাকেট নিয়ে গিয়েছিলাম সকলেই। সেদিন ভোরে বুঝলাম গিরেও ঠান্ডা পড়ে। প্রায় সকাল আটটার আগে, অর্থাৎ সূর্য ওঠার আগে পর্যন্ত খুবই ঠান্ডা ছিল। সেদিন আমাদের নয় নম্বর রুট অ্যালট করা হল। সাফারির প্রায় শুরুর দিকেই সিংহ দেখলাম সেদিন। গভীর জঙ্গলের ভেতর কেশরওয়ালা সিংহটাকে দেখতে পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উঁচু ঘাসের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফেলল সে। এক ঝলক দেখতে পেলাম মুখটা। কিন্তু একটুখানি এগিয়ে যা দেখলাম, তা বর্ণনার বাইরে! দুটো সিংহী কোথা থেকে দৌড়ে এসে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে খেলা শুরু করল। এ-ওর গা চাটছে, ঘাসে গড়াগড়ি খাচ্ছে, আরও কত রকম খেলা দেখাচ্ছে। পরপর দুবেলা এইরকম অভিজ্ঞতা হবে, ভাবতেই পারিনি আমি। অন্য জিপগুলোকে দেখতে দেওয়ার জন্য আমাদের জিপটা যখন এগিয়ে চলে গেল, তখন ইচ্ছেই করছিল না যেতে। মনে হচ্ছিল সিংহ সিংহীদের দেখেই যাই যতক্ষণ তারা আছে। কিন্তু সেটা তো আর হয় না, তাই অগত্যা! সবাই সিংহটার মুখ দেখতে পেয়েছি এক ঝলক। কিন্তু তাই বা কম কীসে?
দ্বিতীয় দিন দুপুরেই তৃতীয়, অর্থাৎ শেষ সাফারি। এবার বারো নম্বর রুট। এই রুটের বিশেষত্ব হল কমলেশ্বর ড্যাম নামক একটি জলাশয়। এই সাফারিতে আমরা সিংহ বা সিংহী দেখিনি ঠিকই, কিন্তু তার পরিবর্তে দেখেছি কমলেশ্বর ড্যামের সৌন্দর্য ও সেখানকার নানা রকম পাখি। ড্যামে পৌঁছে কিছুক্ষণের বিরতি। জিপ থেকে নেমে নাম না জানা পাখির ছবি তুললাম বাবার সঙ্গে। যখন ড্যামের ধার দিয়ে আবার ফেরার পথ ধরেছি, তখন দেখি ড্যামের মাঝে চরা! আসলে বিশাল কুমির ড্যামের একেবারে মাঝখানে পিঠটুকু তুলে শুয়েছিল। হঠাৎ দেখে তাই চরা মনে হয়েছিল আমার। এছাড়াও আর একটা জিনিস দেখলাম এই সাফারিতে। যখন গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ফিরছি, তখন দেখি একটা নীল গাই জঙ্গলের একেবারে বাইরের দিকে বেরিয়ে এসে পাতা খাচ্ছে। আমাদের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে, লাফিয়ে, দৌড়ে, যেভাবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেল।
তিনটে সাফারিতে তিনরকম আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতা হল। বাড়ি ফিরে আসার পরেও বেশ কয়েকদিন এই দৃশ্যগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম চোখ বুজলেই। গির ভ্রমণ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখা ও ছবি : জাগরী বিশ্বাস
সপ্তম শ্রেণী, সাউথ পয়েন্ট হাই স্কুল