কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। যোগাযোগ রক্ষা করে চললে কর্মলাভের সম্ভাবনা। ব্যবসা শুরু করলে ভালোই হবে। উচ্চতর ... বিশদ
বয়েসটাও একটু বেশি। সত্তর পেরিয়ে গেছে কবেই।
তবে তখনও বিরুমপুরকে আস্ত একটা গ্রাম বলত না কেউ। বলত, তাজপুরের লেজুড়। শুধু কিশোরীবাবুর জন্যে সবাই বলত, খাতায় কলমে ওটা একটা মৌজা!
তা হোক।
তবু দু-দশখানা গাঁয়ের রাজামশাই ছিলেন সরকার বাড়ির কিশোরীবাবু। সবাই বলতেন— উনি যা বলবেন তাই হবে। টুঁ-হুঁ করা চলবে না।
বিরাটিতে মিত্রবাড়ির শরৎবাবু তখন নামী ডাক্তার।
আরামবাগ মহকুমার মানুষ তাঁকে তখন মান্য করত ভগবানের মতো। কিন্তু সেই মানুষটাও কিনা যখন-তখন খালি গায়ে এসে হাজির হতেন সরকার বাড়ির অন্দরমহলে!
আরামবাগ থেকে চাঁপাডাঙার রাস্তায় তখন মাঝে-মধ্যে দু-চারটে পাদানিওলা মোটর গাড়ি ছুটত ধুলো উড়িয়ে। মাঝে পড়ত দু’দুটো ডাকাবুকো নদী— মুণ্ডেশ্বরী আর দামোদর। ব্রিজ হয়নি তখনও। নৌকায় উঠে বুক ঢিপঢিপ করত ভয়ে। কারণ, ছোট থেকেই আমি ছিলুম মা-বাবার ভিতু বড় ছেলে!
প্রতাপনগর থেকে তিন মাইল হেঁটে বিরাটির কাছে ছান্দ্রা স্কুল। ডাক্তার শরৎবাবুর ভাই রামবাবু স্যার ছিলেন স্কুল গড়ার প্রধান উদ্যোগী। অঙ্কের ক্লাস নিতে গিয়ে তিনিই প্রথম শুনিয়েছিলেন এক রূপকথার রাজপুত্তুরের গল্প। হ্যানস্ অ্যান্ডারসনের নাম সেই প্রথম শোনা। রূপকথার রাজপুত্র ছিলেন তিনি।
কিন্তু বাবা ছিলেন মুচি। মা ধোবানি!
ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের ফুটপাতে বসে জুতো সেলাই করতেন হ্যানসের বাবা!
সেই তাঁদেরই একমাত্র ছেলে হ্যানস অ্যান্ডারসন শীতের রাতে ছেঁড়া কম্বল গায়ে শুয়ে থাকত ফুটপাতে! স্কুলেও পড়াশুনা হয়নি তেমন!
কিন্তু, কী আশ্চর্য সব রূপকথার গল্প লিখলেন বড় হয়ে।
অঙ্কস্যার রামবাবুর কাছে শোনা সে-সব গল্পের কথা মনে পড়লে চোখে জল আসে এখনও। মাথা হেঁট হয়ে আসে!
আসলে ফুরিয়ে যাওয়া সেই ছোটবেলাটাও ছিল কী আশ্চর্য সুন্দর।
শুধু পড়াশুনাই নয়, কথায় কথায় গল্প, গান, নাটক হতো স্কুলে। অঙ্কস্যার বিভূতিবাবু ছিলেন প্রধান উদ্যোগী। কথায় কথায় আসতেন ডাক্তারবাবু নিজেও।
আর আমার প্রতাপনগর বাড়ির মা বেশি মাথা ঘামাতে পারতেন না সে সময়। অন্য ছেলে-মেয়েরাও হইচই করত খিদে পেলে।
সে সময় অবশ্য গাছপালার অভাব ছিল না পাড়ায়।
আম, জাম, লিচু, জামরুল থেকে পাকা তাল ছিল গরিব বাড়ির খুব প্রিয়।
আর বর্ষাকালের কানানদী যে কত রকম মাছ জোগান দিত পাড়ায় পাড়ায়— সে যেন একটা রূপকথার কাহিনী!
আসলে স্কুল থেকেই গলায় গলায় হয়ে গেল শিশির।
লজ্জা করব কী, কদিনের মধ্যেই গোটা বাড়িটাই যেন নিজেরই একটা প্রিয় আশ্রয় হয়ে গেল বিরুমপুরের সরকার বাড়ি।
আমাদের বাড়িতে আমিই ছিলাম বড়।
কিন্তু শিশিরদের সঙ্গে আলাপ হতে ওদের বাড়িতেই পেয়ে গেলুম তিন-তিনটে দিদি আর একটা মিষ্টি বোনকে। যার শ্বশুরবাড়ি আমাদের গ্রামের পাশেই আরাণ্ডিতে। আর মেজদি পইসাড়ায় তো বড়দি-সেজদি মদনপুরে।
সেই কম বয়সে যেমন হাঁটা দিতুম হাসিমুখে, তেমন আনন্দও হতো খুব।
কোথাও পুকুরের নানা স্বাদের মাছ তো— টাটকা আখের গুড় দিয়ে গরম গরম পরোটা। না হলে সকালে উঠে বাসি লুচি।
দেখতে দেখতে মাথায় যখন আরও একটু লম্বা হলুম, তখন ছান্দ্রা স্কুলেও বন্ধুর সংখ্যা বেড়েছে।
হরাদিত্যর কমল থেকে বিরাটির নিমাই তখন বোসপাড়ার গর্ব। মুণ্ডেশ্বরী নদীর ধারে আমগ্রামের মাসুমরাও আমার তখন গলায় গলায়। জসাড়ের মিরাজ তখন হরিণখোলায় নদীর ধারে গান তোলে আমার কাছে বসে। অঙ্কস্যার বিভূতিবাবুর আগ্রহে গানে আমাকে তালিম দেন স্যারের প্রিয় বন্ধু অনিলদা।
তখন অবশ্য আরামবাগ থেকে চাঁপাডাঙা যেতে চালু হয়েছে বাস।
পিচ পড়েছে রাস্তায়। হরিণখোলায় মুণ্ডেশ্বরী নদী, আর চাঁপাডাঙার দামোদরে ব্রিজ হয়েছে দেখার মতন। আর বিরুমপুরের কিশোরী জেঠুর উদ্যোগে নতুন সদস্য হয়ে পড়েছি তাজপুর যাত্রাদলের। যেখানে ডাক্তার সুবলদা থেকে তাঁর মেয়ে কল্যাণী, রেণুদা, গৌরদা, সদানন্দ মাস্টার— সব্বাই তখন আমার বন্ধু। তবু রাইপুরের কম বয়েসি ইন্দ্র ছিল সবচেয়ে প্রিয়। তার ‘সোনাই’কে কখনও ভোলা যাবে না।
তবু বিরুমপুরের সরকার জেঠুর যেন জুড়ি ছিল না সে সময়। যেমন ছিল উদার মন, তেমন ছিল খ্যাতি।
কিন্তু দূর থেকে দেখলে ঘাবড়ে যেত অনেকেই! সাক্ষাৎ যেন যাত্রাদলের ভীম। যেমন কালো কুচকুচে গায়ের রং— তেমন চেহারা!
খালি গায়ে থাকলে শুধু আমাদের মতো ছোটরা কেন, বড়রাও তেমন কাছে যাবার সাহস পেত না সহজে!
পড়াশুনোয় তেমন ভালো ছিলুম না জেনেও কেন জানি না একটু বেশি ভালোবাসতেন আমাকেই! সে নিয়েও ওঁর ছোট মেয়ে আন্নার কত ঠাট্টা-তামাশা শুনতে হতো আমাকে!
মনে আছে হরিণখোলা থেকে বিরাটি, তাজপুর, রাগপুর, হরাদিত্য— এমনকী দূরের আরামবাগেও তখন আমাদের অনেক বন্ধু। থাকা-খাওয়ার জন্যেও নাটকপ্রাণ বিদ্যুৎ তখন রেডি। ওর বড়দাও কী স্নেহশীল ছিলেন আমাদের জন্যে! উনি তখন কামারপুকুর কলেজের একমাত্র ওপরওয়ালা! বিনয়বাবু বলতে সবাই কী খুশি!
বিদ্যুৎ মানে, ওঁর ভাই মনুর মুখে আমার কথা শুনেই কাছে টেনে নিলেন হাসিমুখে বললেন, মনুর মুখে শুনছি, তোমরা নাকি একটা যাত্রার দল খুলেছ আরামবাগে?
আমি তো লজ্জায় মাথা হেঁট করেছি তখন!
দাদা বললেন, আমি তো মনুকে বলেছি— এ বছর লক্ষ্মীপুজোয় আমাদের আনুড়ের বাড়িতে তোমাদের দলের যাত্রা দেখব আমরা!
এ খবরটাও একদিন ছড়িয়ে পড়ল বিরুমপুর সরকার বাড়িতে।
কথাটা জেঠুর কানে বোধহয় তুলে দিয়েছিলেন মদনপুরের সেজদি।
জেঠু বললেন, তোমাদের বন্ধু বিদ্যুৎকে একদিন নিয়ে এসো তো আমাদের বাড়িতে। শুনো! ও নাকি শাজাহানের পার্ট করে দারুণ!
আরামবাগের চৌমাথার মোড়ে বিদ্যুতের এক কামরার ভাড়া ঘরে তখন নামী-দামি নাটুকে মানুষদের আনাগোনা। গড়বেতার যাত্রাপার্টির অশ্বিনী বাঁড়ুজ্যে থেকে চন্দননগরের কিরণ লাহিড়ী, গঙ্গার ওপার থেকে আসা বেলা সরকার— তখন তিনি মাত্র সামান্য টাকার বিনিময়ে চলে আসতেন নাটকের টানে। বিখ্যাত হননি তখনও!
খড়ের ওপর কম্বল পেতে ওঁদের বিছানা করে দিতুম আমরা।
আহা! সে কী আনন্দ ছিল তখন!
আরামবাগের নোন্তুদা, কালীদাস ঘটক, কলেজে পড়া সরোজ রায়— ‘গোরুর গাড়ির হেড লাইট’ নিয়ে যে গরিব ঘরের ছেলেটি একদিন বিখ্যাত হয়েছিল কলকাতায়— তার কথাও বারবার বলতেন বিরুপুরের জেঠু।
মনে আছে, সে সময় শীতের তেমন চাদর কি সোয়েটার ছিল না আমার। কিন্তু গৌরহাটির মোড় থেকে যখন রিকশায় উঠে হোটেলে খেতে যেতাম, তখন গায়ে থাকত একটা দামি প্রিন্সকোর্ট!
যে বেচারির গায়ে দেবার কথা সে ওটা শীতকালে পেতই না!
বিরুমপুরের সরকার বাড়িটাও ছিল এমন।
প্রতাপনগরের একটা ফেলটুস মার্কা ছেলের জন্যেই ডিমের একটা অমলেট থাকত গোটা। এটাও ছিল জেঠুর অর্ডার!
কিন্তু এখন তো আর এসব পুরনো দিনের গল্প শুনতে চায় না কেউ।
তবু উসখুস করে দু-তিনটে আবছা হয়ে যাওয়া ধুলোমলিন পাতা।
সেই মুণ্ডেশ্বরী নদীটাও আর তেমন ডাকাবুকো নেই! কেমন যেন ছন্নছাড়া উসকোখুসকো চেহারা।
হরিণখোলার গা ঘেঁষা কামালদের বাড়িটাও এখন চেনা যায় না সহজে। মাসুম কোথায়? মাসুম?
মিরাজও নেই এখন। তাহলে?
বিরুমপুরের সরকার বাড়িটাও এখন বদলে ফেলেছে তার চেহারা! কী আশ্চর্য!
জেঠু নেই তো কী হয়েছে?
বুড়ো আমগাছটাও সাড়া দেয় না সহজে!
বুজি কোথায়? বুজি? কেউ সাড়া দিচ্ছে না কেন? শিশিরের ডাকনামটা তো সবাই জানে!
কাঁচা আমের গন্ধ যেন বাতাসের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে বদরতলার মাঠের দিকে ফুরফুর করে লুকিয়ে পড়ে পলাশ গাছের ডালে।
বেনেবউ পাখিটাও এখন আর রোজ আসে না কই!
তবু রেণুকাকিমা জানলা দিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি দেয়। বলে,
—ও মমি, মমি— দেখেছিস পাখিটাকে?
কিন্তু কেউ সাড়া দেয় না কেন!
নতুন রং করা বাড়িটাও কেমন যেন মুখ ভার করে থাকে সারাদিন!
অলংকরণ : সুব্রত মাজী