বিদ্যার্থীদের ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তা করে বিষয় নির্বাচন করলে ভালো হবে। প্রেম-প্রণয়ে বাধাবিঘ্ন থাকবে। কারও সঙ্গে মতবিরোধ ... বিশদ
মহাকাশ তোমাদের অনেককেই টানে। মহাকাশে নভশ্চরদের জীবন কিন্তু আমাদের পৃথিবীর মতো হয় না। সেই জীবন অনেক কঠিন। কেন জানো? আমরা যে পৃথিবীতে হাঁটতে পারি, শুতে পারি, খেতে পারি, তার সবকিছুর জন্যই পৃথিবীর অভিকর্ষ বল দায়ী। সেই কোন কালে বিজ্ঞানী নিউটন আপেল পড়তে দেখে আবিষ্কার করেছিলেন মাধ্যাকর্ষণ সূত্র। পৃথিবীর এই আকর্ষণের কারণেই আমাদের পা মাটিতে থাকতে পারে। আমরা নিজেদের দেহের ভারসাম্য রাখতে পারি। সব কাজ করতে পারি। কিন্তু মহাকাশে সেই সুযোগ কোথায়। সেখানে প্রায় জিরো গ্র্যাভিটি। অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রায় শূন্য। সেখানে সব জিনিসই ভেসে বেড়ায়। এমনকী, অ্যাস্ট্রোনটও ভেসে থাকে। তাই ওই ভাসমান অবস্থায় পৃথিবীর মতো সব কাজ করা বেশ কঠিন।
এই কাজ যাতে সুষ্ঠুভাবে মহাকাশচারীরা করতে পারে তার জন্য বেশ কয়েকমাস ধরে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ভেসে থাকা অবস্থায় যাবতীয় কাজ যেন তাঁরা করতে পারেন। মহাকাশচারীদের জন্য তৈরি করা হয় বিশেষ পোশাক। কারণ সবসময় যে তাঁরা স্পেশ স্টেশনেই থাকবেন, তার তো মানে নেই। তাঁদের স্পেশ-ওয়াক অর্থাৎ মহাকাশে হাঁটতেও হতে পারে। মনে রাখতে হবে মহাকাশের তাপমাত্রা আর পৃথিবীর তাপমাত্রা কিন্তু এক নয়। আবার সূর্যালোকও সমান নয়। তাই এই পোশাক নভশ্চরদের বিশেষ সুবিধা দেয়। চরম তাপমাত্রা বলতে যা বোঝায় যেমন ধরো মাইনাস ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১২০ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও যেন কারও অসুবিধা না হয় তার ব্যবস্থা থাকে ওই পোশাকে। মহাকাশচারীর বুক ঢাকা দেওয়ার জন্য পোশাকের ওই অংশটি বেশ শক্ত হয়। তাঁদের হাত পুরো ঢাকা থাকে। হাতে থাকে গ্লাভস। ওই পোশাকের সঙ্গে হাতের অংশ যুক্ত থাকে। পোশাকের মধ্যে থাকে কিছু টিউব। যে টিউব দিয়ে জল সরবরাহ করা হয়। যাতে মহাকাশে হাঁটার সময় তাঁদের শরীর ঠান্ডা থাকে। আর ব্যাগের পিছনে থাকে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের অঙ্গ হিসেবে অক্সিজেন, প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা ও একটি ফ্যান। পোশাকের সঙ্গেই থাকে সোলার প্রুফ হেলমেট। সূর্যালোকে চোখ যাতে ঝলসে না যায়, তার জন্য থাকে বিশেষ ব্যবস্থা। সবকিছু ঠিকঠাক নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে কি না, তা পোশাকের সঙ্গেই থাকা কম্পিউটার স্ক্রিনে দেখতে পারেন মহাকাশচারী। স্পেশ ওয়াক করতে গিয়ে যদি কোনও মহাকাশচারী দুর্ঘটনাবশত হারিয়ে যান তবে কী হবে? যেমন গ্র্যাভিটি বলে একটি হলিউড ছবিতে দেখানো হয়েছিল। না তেমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ তাঁদের ওই পোশাকেই সেফার বলে একটি মোড আছে। যদি কোনও কারণে স্পেশ স্টেশন থেকে ছিটকে যান ওই মহাকাশচারী, তিনি তৎক্ষণাৎ ওই সেফার চালু করবেন। তখন কয়েকটি ছোট ছোট জেট কার্যকর হবে। এবং ওই মহাকাশচারী স্টেশনে ফিরে আসতে পারবেন। ও আর একটা কথা মহাকাশচারীদের হাতে থাকে দু’টো ঘড়ি। পৃথিবী থেকে তাঁরা কোন সময় রওনা দিয়েছেন, তা দেখার জন্য একটি ঘড়ি। অন্য ঘড়ি দেয় জিএমটি অর্থাৎ গ্রিনিচ মিন টাইম। মানে বিশ্বের স্ট্যান্ডার্ড সময়।
এ তো গেল হাঁটার কথা। আর স্টেশনের ভিতরে কী অবস্থা হয়। সেখানেই তো বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয় তাঁদের। আমরা পৃথিবীতে সকাল থেকে কী করি? মা ডাকলে ঘুম থেকে ওঠে ব্রাশ করি। ওঁদের তো ডাকার কেউ নেই। ওঁরা নিজেরাই ওঠেন। তারপর আমাদের মতোই ব্রাশ করেন। কিন্তু একটু তফাৎ রয়েছে। ওখানে তো ব্রাশ করে জল দিয়ে কুলকুচি করে ফেলা যায় না। স্পেশ স্টেশনের দেওয়ালে ব্যাগের মধ্যে আটকানো থাকে একটি ব্যাগ। তার মধ্যেই থাকে ওই সব ব্রাশ-পেস্ট। সেই পেস্ট অবশ্য বিশেষ ধরনের। খেয়ে নেওয়া যায়। ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে জলের টিউব থেকে জল লাগিয়ে দেন মহাকাশচারীরা। জল লাগানোর সময় একটু জল যদি টিউব থেকে বেরিয়ে আসে, তখন সেটি বাবল হয়ে ভেসে বেড়ায়। মহাকাশচারীরা দিব্যি সেটিকে খেয়ে ফেলেন। কারণ অপচয়ের সুযোগ কোথায়। ব্রাশ করে সেই পেস্ট খেয়েই ফেলেন তাঁরা।
দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে টয়লেট বা বাথরুম যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাথরুমে একটি কমোড থাকে। আর থাকে ভ্যাকুম ক্লিনার টাইপের মেশিন। ওই মেশিন নোংরাকে শুকনো কাগজের মতো করে দেয়। সেগুলিকে জড়ো করে করে রাখতে হয়। নাহলে সেটি ভেসে এদিক-ওদিক হয়ে যাবে। আসলে ১০ সেমির ওই সাকশন কমোডে বসাটাই কঠিন। তাঁরা নিয়মিত স্নানও করেন। শ্যাম্পু করেন, সাবান দেন। তফাৎ হল তাঁদের শ্যাম্পু জল ছাড়া। ওই শ্যাম্পু তাঁরা মাথায় ঘষে দেন। স্নান করেন ভিজে কাপড় গায়ে ঘষে। লিক্যুইড শোপ যেমন হয়, ওই কাপড়ও অনেকটা তেমনভাবে তৈরি করা হয়। স্পেশ স্টেশনের ভিতরকার পরিবেশ অবশ্য অনেকটাই স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হয়। সেখানে তাই নভশ্চররা স্পেশ ওয়াকের মতো পোশাক পরে থাকেন না। স্বাভাবিক কাপড়ই তাঁরা পরেন। যেমন আমরা কটন পোশাক পরি, তেমনি। তবে ওখানে কাচাকাচির বা ইস্ত্রি করার কোনও সুযোগ নেই। তাই পোশাক ও আন্ডারওয়্যার বেশিই লাগে।
মহাকাশচারীদের আগে খাওয়ার জন্য টিউব ব্যবহার করতে হতো। এখন তাঁরা স্বাভাবিক খাবার খান। যেমন আমরা পৃথিবীতে খাই। কী নেই সেই তালিকায়, রুটি, ফল, সব্জি, ডিম, মাংস, ডাল, সবই। তবে সবটাই প্যাকেটজাত। স্টেশনের রান্নাঘরের ফ্রিজে (আমাদের পৃথিবীর মতো নয় কিন্তু) এসব খাবার থাকে। মহাকাশচারীদের কিন্তু শরীরচর্চা মাস্ট। কারণ প্রায় মাধ্যাকর্ষণ শূন্য এলাকায় হাড় ও মাসলের শক্তি বাড়ানো জরুরি। তাই তাঁরা প্রতিদিন ট্রেডমিলে হাঁটেন। নানাবিধ বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি মহাকাশের ঘরকেও তাঁদের পরিষ্কার রাখতে হয়।
ভ্যাকুম ক্লিনার, লিক্যুইড ডিটারজেন্ট ও ডিসপোজেবল গ্লাভস এই কাজে ব্যবহার হয়। এই নোংরা তাঁরা জমা করে রেখে দেন। মহাকাশে ফেলে দেন না। সেগুলি পৃথিবীতে নিয়ে আসেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, তাঁরা কি সারাদিন কাজই করেন? তাঁদের বিনোদন নেই। আছে। তাঁদের শোওয়ার ঘর (অবশ্য যদি সেটিকে তোমাদের ঘর বলে মনে হয় তবেই) আছে। সেখানে ল্যাপটপ রয়েছে, বই রয়েছে। গান শোনার সুযোগ রয়েছে। পৃথিবীকে দেখার সুযোগ রয়েছে। এমনকী, পৃথিবীর সঙ্গে কথা বলাও যায়।
সবার শেষে আসি ঘুমের কথায়। অ্যাস্ট্রোনটরাও কিন্তু দিনে ঘণ্টা ছয় অবশ্যই ঘুমোন। ভেসে ভেসে তো ঘুমনো যায় না, তাই তাঁদের জন্য স্লিপিং ব্যাগ রয়েছে। সেখানে ঢুকে দিব্যি ঘুম দেন তাঁরা। যে টিম মহাকাশে যায়, তার মধ্যে কিন্তু চিকিৎসকও থাকেন। অসুখ-বিসুখ হলে আমাদের মতো মহাকাশেও ডাক্তারই ভরসা। জরুরি প্রয়োজনের জন্য চিকিৎসকদের ওষুধ, ইনজেকশন থেকে শুরু করে নানাবিধ বিষয় মজুত থাকে।
ব্যাপারটা সহজ নয় ঠিকই, কিন্তু আকর্ষণীয়। কী ভাবছ, ট্রাই করে দেখবে নাকি?
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে