যারা বিদ্যার্থী তাদের মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। নানা বিষয়ে খুঁতখুঁতে ভাব জাগবে। গোপন প্রেম থাকলে ... বিশদ
বিজ্ঞানের গুণী ছাত্র রবি
এখন তো তোমরা ইন্টারনেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ফেসবুক, টুইটার থেকে শুরু করে কত কিছুর যে সুবিধা পাচ্ছ! কিন্তু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ে তো আর এত কিছু ছিল না। তবে, তার সময়টাতে কিন্তু বিজ্ঞানের যুগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তোমাকে যদি আমাদের দেশের কয়েকজন বিজ্ঞানীর নাম বলতে বলা হয় তবে তুমি কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামটি বলবে? কখনও না, তাই না? তিনি কোনও কিছু আবিষ্কার কি উদ্ভাবনও করেননি। তবে, তিনি কিন্তু বিজ্ঞানকে ধরতে পেরেছিলেন। তিনি তো ছিলেন কবি, তার কি আর পরীক্ষাগারে বসে বসে গবেষণা করলে চলবে? তাই করলে কি আর তাঁর সেই নোবেল বিজয় সম্ভব হতো? তাই তিনি বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করলেন। নিজে বিজ্ঞান পড়লেন। আর কী করলেন? একটা আস্ত বই-ই লিখে ফেললেন। বইটির নাম দিলেন ‘বিশ্বপরিচয়’। এ বইয়ের মধ্যে তিনি তার বিজ্ঞান ভাবনার কথা লিখে গেলেন।
বিজ্ঞানচর্চার হাতেখড়ি হয়েছিল ছেলেবেলাতেই
রবি কবির তো বিজ্ঞান চর্চার হাতেখড়ি হয়েছিল ছেলেবেলাতেই। তুমিও যেমন রোজ বসো তোমার প্রাইভেট টিউটরের সামনে। তবে রবির সেই স্যার প্রথম যেদিন পড়াতে আসেন, সেদিন সঙ্গে করে এনেছিলেন আস্ত একটা কঙ্কাল। প্রতি রাতে শোবার ঘরের দেওয়ালে ঝুলে থাকা কঙ্কালটার হাড়গুলো যখন হাওয়ায় নড়ত খট খট করে, তখন আর ভয় করত না রবির। কেননা, হাড়গুলোর শক্ত শক্ত নাম সব জানা হয়েছিল আগেই। বিজ্ঞানের স্যার সীতানাথ দত্ত কবিগুরুর মনে ছোটবেলাতেই বিজ্ঞান শিক্ষার বীজ পুঁতে দিয়েছিলেন। তিনি তা অকপটে বলেও গেছেন। ‘সারা সকাল জুড়ে নানারকম পড়ার যতই চাপ পড়ে, মন ততই ভিতরে ভিতরে চুরি করে কিছু কিছু বোঝা সরাতে থাকে, জালের মধ্যে ফাঁক করে তার ভিতর দিয়ে মুখস্থ বিদ্যে ফসকিয়ে যেতে চায়।’
বিজ্ঞানের রস-আস্বাদনের লোভে
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য একটা কথা স্বীকার করে লিখেছেন, ‘আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বালককাল থেকে বিজ্ঞানের রস-আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না। আমার বয়স বোধ করি তখন নয়-দশ বছর; মাঝে মাঝে রবিবারে হঠাৎ আসতেন সীতানাথ দত্ত মহাশয়। আর জানি তাঁর পুঁজি বেশি ছিল না, কিন্তু বিজ্ঞানের অতি সাধারণ দুই-একটি তত্ত্ব তখন দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিতেন আমার মন বিস্ফারিত হয়ে যেত। মনে আছে, আগুনে বসালে তলার জল গরমে হালকা হয়ে উপরে ওঠে আর উপরের ঠান্ডা ভারী জল নিচে নামতে থাকে, জল গরম হওয়ারই এই কারণটা যখন তিনি কাঠের গুঁড়োর যোগে স্পষ্ট করে দিলেন, তখন অনবচ্ছিন্ন জলে একই কালে যে উপরে নিচে নিরন্তর ভেদ ঘটতে পারে তারই বিস্ময়ের স্মৃতি আজও মনে আছে। যে ঘটনাকে স্বতই সহজ বলে বিনা চিন্তায় ধরে নিয়েছিলুম সেটা সহজ নয়, এই কথাটা বোধ হয় সেই প্রথম আমার মনকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তারপরে, বয়স যখন হয়তো বারো হবে (কেউ কেউ যেমন রংকানা থাকে আমি তেমনি তারিখকানা এই কথাটি বলে রাখা ভালো), পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ডালহৌসি পাহাড়ে। সমস্ত দিন ঝাঁপানে করে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছতুম ডাকবাংলোয়। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে দেখতে গিরিশৃঙ্গের বেড়া-দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে করে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড় প্রবন্ধ লিখেছি। স্বাদ পেয়েছিলুম বলেই লিখেছিলুম, জীবনে এই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা, আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে।’
‘বৈজ্ঞানিক সংবাদ’ লিখতেন
ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ছোটদের পত্রিকা বালকের সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তখন তাঁর বয়স মাত্র চব্বিশ বছর। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী রবীন্দ্রনাথের মেজো বউঠাকুরানি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বালক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সহযোগী ছিলেন এবং কার্যত সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব তিনিই পালন করে যেতেন। গল্প, উপন্যাস,কবিতা ছাড়াও বালকের পাতায় ‘বৈজ্ঞানিক সংবাদ’ও লিখতেন রবীন্দ্রনাথ। তাতে অনেক অজানা তথ্য এবং মজার কথা থাকত। অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষকে মূঢ়তার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার ইচ্ছাই ছিল তাঁর বিজ্ঞানচর্চার মূল উদ্দেশ্য, কেননা আধুনিক সংস্কারমুক্ত জীবনবোধ তৈরি না হলে মনের অন্ধকার ও জীবনের অন্ধকার কখনও অপসৃত হয় না।
পড়তে পড়তে হয়ে গেলেন বিজ্ঞানের ভক্ত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিজ্ঞান শিখতে সমস্যাও ছিল। বড় সমস্যা ছিল, এসব মোটা মোটা বৈজ্ঞানিক বইপত্তর সব লেখা থাকত ইংরেজিতে। রবীন্দ্রনাথ করলেন কি, ইংরেজিটাই শিখলেন আগে। তিনি বলেছেন, কী কী শোনো, বয়স আরও বাড়লে, ‘ইংরেজি ভাষা অনেকখানি আন্দাজে বোঝবার মতো বুদ্ধি’ খুলে গেলে, সহজবোধ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই সেখানে যত পেয়েছেন পড়তে ছাড়েননি।’ মাঝে মাঝে গাণিতিক দুর্গমতায় পথ বন্ধুর হয়ে উঠেছে, তার কৃচ্ছ্রতার উপর দিয়ে মনটাকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছি। তার থেকে একটা এই শিক্ষা লাভ করেছি যে, জীবনে প্রথম অভিজ্ঞতার পথে সবই যে আমরা বুঝি তাও নয়, আর সবই সুস্পষ্ট না বুঝলে আমাদের পথ এগয় না একথাও বলা চলে না।’ রবীন্দ্রনাথ সেই তরুণ বয়সেই ‘সার রবার্ট বল্’, ‘ফ্লামরিয়’ প্রভৃতি অনেক লেখকের জ্যোতির্বিজ্ঞান-বিষয়ক অনেক বই পড়ে ফেলেছিলেন। তারপর ‘সাহস করে’ পড়েছিলেন প্রাণতত্ত্ব সম্বন্ধে হাক্সলির প্রবন্ধ। এভাবে প্রচুর বিজ্ঞানের বই পড়তে পড়তেই তিনি হয়ে গেলেন বিজ্ঞানের ভক্ত।
কিন্তু তিনি তো কবি ছিলেন তাই না? এভাবে বিজ্ঞানী হয়ে গেলে তিনি কবিতা লিখলেন কী করে? সে উত্তরও তিনিই দিয়েছেন— ‘কবিত্বের এলাকায় কল্পনার মহলে বিশেষ যে লোকসান ঘটিয়েছে সে তো অনুভব করি নে।’ অর্থাৎ কিনা, বিজ্ঞান জানলেই যে কবি-কল্পনা নষ্ট হবে, এমন কোনও কথাই নেই। উলটে তাতে ষোলো আনা লাভ। তোমার লেখার মাঝে যদি বড়সড় বৈজ্ঞানিক ভুল থাকে, সে-ই তো আরও বেশি সমস্যা। যে পড়বে, সে খুব একটা ভুল কথা জেনে বসে থাকবে না!