শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
বইমেলার রচনা
স্কুলটা আমার কাছে মন্দিরের মতো। ৫৩ বিঘা জমিতে আমাদের স্কুল। ফুলের বাগান, লাইব্রেরি, পুকুর, হোস্টেল, অতিথিনিবাস সব মিলিয়ে অভুতপূর্ব পরিবেশ। ছোট থেকে দেখে আসছি, এখানে সব বিচিত্র রকমের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। তাই মনে আছে এই স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার কথা। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। নাম দিয়েছিলাম রচনা ও অঙ্ক দৌড়ে। ১০০ শব্দে বইমেলার রচনা লিখে ১০০ মিটার দৌড়। আর অঙ্ক করে ২০০ মিটার। ভয়ে প্রাণটা কাঁপছিল। ৫ বিঘা জমির ওপর আমাদের খেলার মাঠ। উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক। রচনা দৌড়ে তৃতীয় হলাম। তাতে মনের জোর বেড়ে গেল। অঙ্ক দৌড়ে দ্বিতীয় হলাম। সবাই বুকে জড়িয়ে ধরল। প্রাইজ পেয়ে এত আনন্দ হল যে, জীবনে সেই আনন্দ আর পাইনি।
সৌমেন মণ্ডল, দশম শ্রেণী
বিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা
আজ সবাই আমায় চেনে কুইজ মাস্টার হিসেবে। কিন্তু আমার মনে পড়ে যায় সেই দিনটার কথা। ২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। ওইদিন ছিল বিদ্যালয়ের বিরাট সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। চারদিকে সাজো সাজো রব। স্কুল প্রাঙ্গণের বিশাল মঞ্চে উপস্থিত বিশিষ্ট অতিথিরা। দর্শকাসনে বসে আমার বাবা ও মায়েরা। তাঁরা ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। বহু দল নাম দিয়েছে কুইজে। অত দল দেখে ভাবলাম আমি তো কিছুই পারব না। তাও ইন্টারনেট ও বই-এর সাহায্যে কিছু প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। যাই হোক প্রথম পর্বের বাছাইতে উত্তীর্ণ হলাম। দ্বিতীয় পর্বের সাহস ও ভরসা দিলেন শিক্ষক মহাশয়রা। স্কুলের কুইজের তো কোনও ধারণা ছিল না। অত দর্শক দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ও মা তারপর দেখি আমার সব প্রশ্নের উত্তরই জানা। উত্তরপর্ব শেষে রেজাল্ট ঘোষণা হল। দেখি আমাদের টিম প্রথম হয়েছে। তবে বেশিরভাগ উত্তর আমি দিয়েছিলাম বলে সবাই আমায় আদর করছিল। বাড়িতে বাবা ও মা খুব প্রশংসা করছিল। সেই থেকেই আমার সব বিষয়ে জানার উৎসাহ বেড়ে গেল।
অর্ক বেরা, অষ্টম শ্রেণী
আয়নার সামনে প্র্যাকটিস
বরাবরই আমি চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসি। স্কুলে সেইরকম বন্ধু তৈরি হয়নি তখনও পর্যন্ত। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস। ক্লাসে ক্লাসে নোটিশ এল সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার। দেখলাম অনেকেই নাম দিচ্ছে। সেই সময় আমারও মনে হল আমি নাম দিই। কিন্তু সাহসে কুলাল না। পরের দিন ক্লাস টিচার জিজ্ঞেস করল কারা নাম দিয়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। আমার না উত্তর শুনে স্যার একটু রাগ করলেন। তারপর নিজেই তাৎক্ষণিক প্রতিযোগিতায় আমার নামটা লিখে নিলেন। কীভাবে বলতে হবে, কী বিষয় তা বলে দিলেন। আমি ওই বিষয়টা নিয়ে কয়েকদিন আয়নার সামনে প্র্যাকটিস করলাম। অনুষ্ঠানের দিন ৫ মিনিটের বক্তব্যে ঝড় বইয়ে দিয়েছিলাম। মঞ্চ থেকে নামার সময় ক্লাস টিচার বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মাইকে আমার নাম ঘোষণা হল দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হিসেবে। আজও ভুলিনি মঞ্চে আমার প্রথম দিনের কথা।
স্নিগ্ধজ্যোতি চক্রবর্তী, সপ্তম শ্রেণী
চতুর নাপিতের ভূমিকায়
এই বিদ্যালয়কে ঘিরে জড়িয়ে আছে বহু স্মৃতি। আমার জীবনের অনেক সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী এই বিদ্যালয়। সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি স্কুলে। পুরো পরিচয়পর্ব শেষ হবার আগেই ক্লাসের নোটিশ। সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের আহ্বান। রয়েছে বহু বিষয়। প্রথাগত হিসেবে সেভাবে কিছু শেখাও হয়নি। তবে একটু- আধটু কথা বলে লোক হাসাতে পারি। প্রতিযোগিতার প্রথমেই রয়েছে হাস্যকৌতুক বিভাগ। নামটা দিয়েই দিলাম। কী করব, কী বলব সেই নিয়ে একটু ভয় ছিল। মঞ্চে উঠে চতুর নাপিতের ভূমিকায় অভিনয় করতে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলাম। বেশ কনফিডেন্সের সঙ্গে যা পারলাম করলাম। এবং হাসির ছলে মঞ্চ থেকে নামলাম। রেজাল্ট ঘোষণা হতে দেখি, আমি প্রথম হয়েছি। সেই আনন্দের স্মৃতি আজও আমায় ভাবায়।
অমিত কুমার সামন্ত, অষ্টম শ্রেণী
পা কাঁপছিল
বরাবরই নাচ ও গানের প্রতি আগ্রহ ছিল। বাড়িতে প্র্যাকটিস করতাম। কিন্তু পাড়ার অনুষ্ঠানে কখনও করা হয়ে ওঠেনি। খুব ছোট থেকে এই স্কুলে পড়ি। আমার দাদা-দিদিরাও পড়ত। ওদের মুখে শোনা স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নাকি খুব সুন্দর হয়। মনের মধ্যে সাধ তো ছিলই। যাইহোক ক্লাসের নোটিশে বলা হল, গ্রন্থাগারে গিয়ে নাম দিতে। নাচে নাম দিলাম। কিন্তু তারপর মনে হল নাম তো দিলাম কিন্তু হলভর্তি দর্শকের সামনে নাচব কী করে? কোনও দিন তো নাচিনি। ঘরে ছাড়া। পা কাঁপছিল। কিন্তু মা বার-বার সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। যখন নাম ডাকল মনে হল যেন হৃৎপিণ্ডটা বাইরে বেরিয়ে আসবে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। ওই অবস্থাতেই নাচলাম। আমি তো জানতাম কিছুই হতে পারব না। নাম ঘোষণার সময় দেখলাম আমি নাচে দ্বিতীয় হয়েছি। সেই প্রথম খোলা মঞ্চে আমার নাচের শুরু হল। সেই অভিষেকের দিনটার কথা কখনও কি ভোলা যায়!
রচনা বেরা, দশম শ্রেণী
কিছুতেই মনে পড়ল না কবিতাটা
২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। ওই দিনটার কথা মনে পড়লে এখন হাসি পায়। স্টেজে আবৃত্তি করতে উঠে ল্যাজে-গোবরে হয়েছিলাম। অর্ক, প্রতিজ্ঞা, অমিত সবাই আবৃত্তি করার পর আমার নাম ডাকল। সুন্দর করে মুখস্থ করা কবিতাটা আবৃত্তি করতে উঠলাম। একদম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। রবিঠাকুরের ‘সোনারতরী’। দু’তিন লাইন বলার পর বেমালুম ভুলে গেলাম। কিছুতেই মনে পড়ল না কবিতাটা। হাত, পা ঠান্ডা হবার জোগাড়। শেষ দু’চার লাইন বলে কোনওরকমে নামলাম। সেইদিন এত লজ্জা পেয়েছিলাম যে জীবনে কোনওদিন ভুলব না।
সোমাশ্রী রানা, নবম শ্রেণী
গান গাইবার অভিজ্ঞতা
গান প্র্যাকটিস করি একদম নীরবে নিরালায়। মাইক, স্টেজ, আলো, এত কিছু তো থাকে
না। তমশা, রূপসা, স্বর্ণালী সব দেখলাম
নাম দিয়েছে সঙ্গীতে। অত বড় হলঘরে
গমগম করছে লোক। এর আগে কোনও
দিন স্টেজ পারফর্ম করিনি। হাত, পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল। নাম ঘোষণা হতেই উঠলাম স্টেজে। হারমোনিয়াম বাজাব কী হাত তো কাঁপছে। ওই অবস্থায় শুরু করলাম গান।
স্থায়ী ও অন্তরাতে একটু ভুল হল। সেটা নিজেও বুঝতে পারছিলাম। অত লোকের সামনে গান গাইবার অভিজ্ঞতা তো ছিল না। তাই সেই দিনটার কথা আজও মনে পড়ে। তবে স্টেজে গান গাইতে আর হাত-পা
কাঁপে না।
মৌলি ভুক্তা, সপ্তম শ্রেণী
সুবর্ণ হাজরা, প্রধান শিক্ষক
পূর্ব মেদিনীপুরের বৈষ্ণবচক। কংসাবতীর তীরে ছায়াঘেরা এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। আর গ্রামের গর্ব বৈষ্ণবচক মহেশচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। ৫৩ বিঘা জমির ওপর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, নিয়মশৃঙ্খলায় ঘেরা একটি কো-এড স্কুল। সামনে ফুলের বাগান, ভারতবর্ষের ম্যাপ, অতিথি ভবন, বরদাকান্ত গ্রন্থাগার, সভাগৃহ আনন্দভবন, পুকুর, শিক্ষকাবাস, ক্যান্টিন, ছাত্রনিবাস, খেলার মাঠ, পোস্ট অফিস, শিশু উদ্যান প্রভৃতি। ১৯৬০ সালে এখানেই বসেছিল বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন। বহু সাহিত্যিক ও প্রথিতযশা গুণী মানুষের পদধূলিধন্য এই স্কুল।
শতাব্দী প্রাচীন স্কুলের পরতে পরতে শুধুই ইতিহাস। তারই পুনরাবৃত্তি করলেন প্রধান শিক্ষক সুবর্ণ হাজরা। ওঁর কথায়—তখন বৈষ্ণবচকে কোনও স্কুল ছিল না। কর্দমাক্ত রাস্তায় ৮ মাইল হেঁটে স্কুল যেতে হতো। তাই সকলের লেখাপড়া করা হতো না। সেই অশিক্ষার অন্ধকার দূর করতে এগিয়ে এলেন কয়েকজন শিক্ষাদরদি ব্যক্তি। মহেশচন্দ্র বেরা মুম্বই নিবাসী ব্যবসায়ী জাফরলালা মহম্মদের আর্থিক সাহায্যে ও বরদাকান্ত সামন্তের জমিতে প্রতিষ্ঠা করলেন স্কুল। ১৯১৯ সালের ২ জুন। নাম রাখা হয় ‘বৈষ্ণবচক নকলঙ্কী—ধার্মিক মিডল ইংলিশ’ স্কুল। পরবর্তীতে সত্যেশ্বর বেরা তাঁর সব সঞ্চয় দান করেন স্কুলের উন্নয়নে। এই প্রত্যন্ত গ্রামে স্বপ্নের স্কুল তৈরিতে যাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য তিনি হলেন প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক শ্রীদাম বেরা ও সহকারী প্রধান শিক্ষক সন্তোষ কুমার সামন্ত। এককথায় বলা যায়, তাঁদের চিন্তা-ভাবনার ফসল আজকের বৈষ্ণবচক মহেশচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। ঐতিহ্য ও পরম্পরা বজায় রেখে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকরা এখানকার আবাসনেই থাকেন। ছাত্রাবাসে থাকে দূর-দূরান্তের বহু ছাত্র। বর্তমানে এখানে পড়াশোনা করে ১৫০০ ছাত্র-ছাত্রী। আজও পালিত হয় রাখীবন্ধন উৎসব। বছরভর চলে নানান সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও উৎসব। চালু আছে বহু স্মৃতি পুরস্কার। স্কুলের নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষায় আছে কমিটি। প্রতি ক্লাসে ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নীরবতা পালন। এবং ছুটির সময় প্রতিটি ক্লাসকে সারিবদ্ধভাবে বেরতে হয়। শুরু থেকেই নির্দিষ্ট নিয়মকানুনে বাঁধা এই স্কুল।
এখন এত বড় পরিকাঠামো ধরে রাখতে বহু সমস্যা রয়েছে। অনেকগুলি বিষয়ে শিক্ষকের পদ খালি। ৫ বিঘা জমির খেলার মাঠের সংস্কার দরকার। রজনীকান্ত ছাত্রাবাসের সংস্কার। ছাত্রীদের জন্য হস্টেল তৈরি করা। বিল্ডিংয়ের সংস্কার ও রং করা, শৌচাগার নির্মাণ, সুইমিং পুল, জে ই ই এবং আই আই টি পরীক্ষার কোচিং সেন্টার স্থাপন করতে হবে। এই স্কুলকে বাংলার মডেল স্কুল তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য। সেজন্য প্রয়োজন প্রায় ২ কোটি টাকা। তাই অভিভাবক-অভিভাবিকা, স্থানীয় মানুষ, বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা কৃতী ছাত্র-ছাত্রী ও প্রশাসনের আরও আর্থিক সহযোগিতা চাই। সেই সঙ্গে সবাইকে আহ্বান জানাই এ বছরের আগত
শতবর্ষের অনুষ্ঠানে।