মানসিক অস্থিরতা দেখা দেবে। বন্ধু-বান্ধবদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা দরকার। কর্মে একাধিক শুভ যোগাযোগ আসবে। ... বিশদ
রাশিয়া বিশ্বকাপে হামলার হুমকি দিয়েছে আইএস। মেসিকে নিয়েও পোস্টার ছড়িয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠী। পোস্টারে গরাদবন্দি আর্জেন্তিনীয় তারকার কান্নায় ঝড়ে পড়ছে রক্ত। এবং তাতে লেখা, ‘তুমি (বা তোমরা) এমন এক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়ছ, যাদের অভিধানে ব্যর্থতা বলে কোনও শব্দ নেই।’ আর সেই পোস্টারও জনসমক্ষে এনেছে সেই থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ’।
প্রশ্ন উঠেছে, কে এই রিতা কাৎজ? গোটা দুনিয়াজুড়ে নৃশংস হামলার ঘটনায় আইএসকে জড়িয়ে সংবাদ প্রচার করে নজরে আসে সার্চ ফর ইন্টারন্যাশনাল টেররিস্ট এন্টাইটিস (সাইট)। এই সাইটটি ওয়াশিংটনের একটি বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগী প্রতিষ্ঠান। রিতা কাজ করছেন হোমল্যান্ড সিকিউরিটিজের প্রাক্তন পরিচালক জোস ডিভনের সঙ্গে। রিতা এর আগে প্রকাশ্যে কাজ করেছেন ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ও মার্কিন তদন্ত গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের সঙ্গেও। অনর্গল আরবি ভাষায় পারদর্শী রিতা ছদ্মবেশে থেকেছেন প্যালেস্তাইনের আন্দোলনেও। অথচ কাজ করেছেন ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’-এর হয়ে। রিতা কাৎজের এনআইটিই সংস্থায় অর্থ জোগান, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি, প্রচারের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য অন্ধকারে ঢাকা। একইভাবে তাঁর মদতদাতাদের পরিচিতিও কালো চাদরে ঢাকা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, রিতা কাৎজের জন্ম ১৯৬৩ সালে ইরাকের বসরায়। জন্মগতভাবে তিনি ইহুদি ধর্মের অনুসারী। ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১৯৬৮ সালের দিকে তৎকালীন সাদ্দাম সরকার প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয় রিতার বাবাকে। ওই সময় তিন সন্তান নিয়ে রিতার মা পালিয়ে যান ইরানে। সেখান থেকে চলে যান ইজরায়েলের বাট ইয়াম শহরে। সেখানেই পরে তাঁদের ঠিকানা হয়। বসরায় জন্ম নেওয়ায় কারণে আরবিতে পারদর্শী রিতা। কেউ কেউ বলেছেন, বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই রিতাকে আরবি শেখানো হয়েছে। পরে তাঁকে চাকরি দেওয়া হয়েছে ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীতে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর তত্ত্বাবধানেই তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি, ইতিহাস আর পশ্চিম এশিয়া নিয়ে পড়াশোনা করেন রিতা। ১৯৯৭ সালে চিকিৎসক স্বামীর সঙ্গে পাড়ি দেন আমেরিকায়। জাল ভিসার কারণে তিনি আমেরিকায় আটক হয়েছিলেন। পরে ওই জালিয়াতির কথা স্বীকারও করেন তিনি। ১৯৯৭ সালেই মার্কিন গবেষণা ইনস্টিটিউটে চাকরি পান রিতা। হলিল্যান্ড ফাউন্ডেশন নামে একটি গ্রুপ হামাসের পক্ষে কাজ করছে বলে প্রথম উদ্ঘাটন করেন রিতা। এরপর থেকে গুপ্তচরগিরিতে তাঁর মর্যাদা বেড়ে যায়। একসময় বোরখা পরে মুসলিম মহিলার পরিচয়ে শব্দ রেকর্ডিং যন্ত্রসহ ছুটে বেড়ান ইসলামি সম্মেলনে। হামাসের ফান্ড সংগ্রহকারীদের সঙ্গে ঘুরেছেন বিভিন্ন মসজিদে। প্যালেস্তাইনের সমর্থকদের সঙ্গে থেকেছেন তাদের আন্দোলনেও। ওই সময় এফবিআই তাঁকে লুফে নেয় ইসলামি জঙ্গিসহ বিদেশি জঙ্গি গ্রুপের তথ্য সংগ্রহের জন্য।
২০০২ সালে ইরাক আক্রমণের আগে আমেরিকায় বসবাসরত মুসলিমদের উপর কড়া নজরদারি করা হয়। সেই সময় রিতা প্রতিষ্ঠা করেন সার্চ ফর ইন্টারন্যাশনাল টেররিস্ট এন্টাইটিস (সাইট) নামে সংস্থাটি। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং অনলাইনে ফাঁস করা এই সংস্থার প্রধান কাজ। আল-কায়েদা নেটওয়ার্ক, আইএস নেটওয়ার্ক, হামাস, ইসলামিক জিহাদ এবং হিজবুল্লাহ নিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠান নিয়মিত প্রচার চালাতে থাকে। বিভিন্ন গোয়েন্দা কর্তারা জানান, রিতা কি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করছেন, নাকি কোনও গোয়েন্দা সংস্থার বেসরকারি মুখপাত্র হিসেবে প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন, এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। সিআইএ, কেজিবি, মোসাদ, এম-১৬ এর মতো প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থাগুলি যে ইন্টেলিজেন্স তথ্য প্রকাশ করতে পারছে না, তা লাগাতার প্রকাশ করেছে সাইট। তাদের এই কর্মকাণ্ড পৃথিবীর বহু নেতৃস্থানীয় দেশের গোয়েন্দা সামর্থ্যকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। ‘আমাক’ নামে একটি সাইটের সূত্র দিয়ে তারা তথ্য প্রকাশ করছে। আমাক নিউজকে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সংবাদসংস্থা উল্লেখ করে আইএসের জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সংবাদ প্রকাশ করে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। কোনও ঘটনার পর সেই ঘটনার দায় স্বীকার, কোথাও হামলার হুমকিসহ জঙ্গি তৎপরতাসংশ্লিষ্ট সব খবরই প্রকাশ করে থাকে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। সেই খবর পরে অন্যরা প্রকাশ করে। আমাক নিউজ সাধারণভাবে ইন্টারনেটে দেখা যায় না। সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। যে কেউ চাইলেই রেজিস্ট্রেশন করতে পারে না।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরাক আক্রমণের আগে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের কথা বলেছিল মার্কিন ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থাগুলি। সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় দায় পড়েছিল তাদের উপর। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য তারা সমালোচিত হয়েছিল পৃথিবীজুড়ে। তাই মিথ্যা প্রচারের দায়টা আর সরাসরি নিতে চায় না কোনও সংস্থা বা দেশ। এখন তার বদলে সুকৌশলে বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমেই প্রচার চালাচ্ছে তারা। তাত্ত্বিকভাবে যা ‘ধূসর প্রচার’ হিসেবে পরিচিত।
রিতা নিজেও কট্টর ইজরায়েলপন্থী। নিজেকে জায়নবাদী বলে পরিচয় দিতেই পছন্দ করে। তাঁর ওয়েবসাইটটি বেশি আলোচনায় এসেছে মূলত ২০১৪ সালের আগস্ট থেকে। যখন মোসাদ-এর মাধ্যমে আইএসের উৎপত্তি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। রিতা কাৎজ তাঁর সাইট ইনটেলিজেন্স গ্রুপে বেশ ক’টি এক্সক্লুসিভ ভিডিও প্রকাশ করে। যেখানে কমপক্ষে দু’জন মার্কিন সাংবাদিকের শিরশ্ছেদের ভিডিও ছিল। কোনও গণমাধ্যমই তখন এইসব ভিডিওর ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেনি। কেউ প্রশ্ন তোলেনি একটা বেসরকারি কোম্পানি কী করে কোথা থেকে এসব ভয়ঙ্কর ভিডিও সংগ্রহ করে। সেই প্রতিষ্ঠানের পরিচয়ই বা কী? অবাক হবেন না শুনলে, এই প্রতিষ্ঠানে প্রধান সহযোগী গণমাধ্যম ফক্স নিউজ। যাকে সবাই ইজরায়েলপন্থী এবং মার্কিন সরকারের চর বলেই জানে।
২০০৩ সালে রিতা ‘Terrorist Hunter: The Extraordinary Story of a Woman Who Went Undercover to Infiltrate the Radical Islamic Groups Operating in America’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। সেখানে নাম গোপন করে লেখেন ‘Anonymous’। সেই বইয়ে দাবি করেন, তিনি জঙ্গি মুসলিমদের অনেক বৈঠকে পরিচয় গোপন করে উপস্থিত হয়েছিল! কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, একে তো জঙ্গিদের গোপন বৈঠক, তার উপর মুসলিম জঙ্গিরা লিঙ্গ সংবেদনশীল। তাদের বৈঠকে রিতার পরিচয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়েই কীভাবে তাঁকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হল! আসলে রিতার প্রতিষ্ঠানটি জন্মের পর থেকেই এমন সব গোপন তথ্য দিয়ে আসছে, যা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে রীতিমতো লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। তবে অনেক তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যেমন—২০০৭ সালে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়: একটি ছোট্ট গোয়েন্দা কোম্পানি যারা ইসলামি জঙ্গি গ্রুপগুলির উপর নজরদারি করে, তারা ওসামা বিন লাদেনের একটি ভিডিও সংগ্রহ করেছে। যা আল-কায়েদা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের এক মাস আগেই সংগ্রহ করা হয়েছিল। ২০০৭-এর সেপ্টেম্বর দু’জন শীর্ষ কর্তাকে শর্ত সাপেক্ষে ভিডিওটি দেওয়া হয়। বলা হয়, আল-কায়েদা এই ভিডিও প্রকাশের আগে পর্যন্ত যেন গোপন রাখা হয়। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে বহু গোয়েন্দা সংস্থা ওই সাইট থেকে ভিডিওটি ডাউনলোড করে। ওই দিনই বিকেলে ভিডিও এবং অডিওর ট্রান্সক্রিপ্ট বুশ প্রশাসনের ভিতর থেকে ফাঁস হয়ে বিভিন্ন টিভি মিডিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয় যে, ভিডিওটি ভুয়ো! সেই থেকে ‘সাইট’-কে মানুষ সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করেছে।
প্রশ্ন উঠেছে, এটা কি কোনও প্রোপাগান্ডা সাইট? যারা গোটা বিশ্বে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের ভীতি ছড়িয়ে দিতে চায়! যারা আরব দুনিয়ার বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে ইজরায়েলের স্বার্থ সুনিশ্চিত করতে চায়! সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে সিরিয়ায় আইএসের উত্থানের পর অতিরঞ্জিত কিছু ভিডিও প্রকাশের পর। অভিযোগ, সিরিয়াতে মার্কিন ও তার মিত্রদের হস্তক্ষেপ ত্বরান্বিত করতে রিতা কাৎজ অনেক ভুয়ো ভিডিও প্রকাশ করেছেন।
২০১৪-এর সেপ্টেম্বরে দুই মার্কিন সাংবাদিক জেমস ফলি এবং স্টিভেন সোটলভকে শিরশ্ছেদ করার ভিডিও প্রকাশ করে সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দেয় সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। লেখক বিল গার্ডনার ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফে তো দাবিই করে বসেন, এসব ভিডিও আসলে ক্যামেরার কারসাজি! এরপর জাপানি সাংবাদিক কেনজি গোতো এবং হারুনা ইউকাওয়ার শিরশ্ছেদের ভিডিও নিয়েও অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এবং তা তাদের নিজেদেরই বানানো। হুবহু একই স্থানে এবং বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ভিডিও করা, ক্লোজ শটেও পাঁচবার ধারাল ছুরি চালানোর পরও গলা দিয়ে রক্ত পড়ার দৃশ্য দেখতে না পাওয়া, সাউন্ড কোয়ালিটিসহ ইত্যাদি ফরেনসিট বিশ্লেষণে সাইট-এর আইএসের ভিডিওগুলি সত্য নয় বলেই প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে! আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, যেহেতু আইএস মোসাদ-এর সৃষ্টি এবং রিতা কাৎজ মোসাদেরই অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। হয়তো রিতা কাৎজই আইএসের প্রধান মহিলা সদস্য। আসলে, জীবনের একটা দীর্ঘ সময় রিতা ইজরায়েলে কাটিয়েছেন। ইজরায়েলের বিখ্যাত ডিফেন্স ফোর্সে (আইডিএফ) চাকরি করেছেন। এরপর আমেরিকায় এসে সরাসরি হোয়াইট হাউস, এফবিআই, সিআইএ, বিচার বিভাগ, অর্থ বিভাগ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ তথা মার্কিন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব বিভাগের সঙ্গে কাজ করেছেন। সেই সুবাদে সেসব জায়গায় অবাধ যাতায়াত এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
তাহলে কি রিতা কাৎজ ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের চর? না, এখনও তার কোনও উত্তর মেলেনি।