বিদ্যার্থীদের ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তা করে বিষয় নির্বাচন করলে ভালো হবে। প্রেম-প্রণয়ে বাধাবিঘ্ন থাকবে। কারও সঙ্গে মতবিরোধ ... বিশদ
ঐতিহাসিক ভুল
১৯৯৬ সাল। একাদশ লোকসভা নির্বাচন। নরসিমা রাও সরকারের বিরুদ্ধে তখন একের পর এক কেলেঙ্কারির অভিযোগ। ভোট শেষে দেখা গেল, ভারতীয় জনতা কংগ্রেসকে উৎখাতের রায় দিয়েছে। অটল বিহারী বাজপেয়ির নেতৃত্বে বিজেপি তখন একক বৃহত্তম দল। ১৯৭৭ সালের পর এই প্রথমবার কংগ্রেস ছাড়া কোনও রাজনৈতিক দল একক দক্ষতায় বেশি আসন পেয়েছে। রীতি মেনেই রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মা সরকার গঠন করতে বললেন বাজপেয়িকে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা জোগার করতে পারল না বিজেপি। ১৩ দিনের মাথায় ইস্তফা দিলেন বাজপেয়ি। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল কংগ্রেস সরকার গঠনে রাজি নয়। কারণ তারা বুঝতেই পেরেছিল, সরকার গঠন করলে তাদেরও একই হাল হবে। এই অবস্থায় শুরু হল অকংগ্রেসি ও অবিজেপি সরকার গঠনের উদ্যোগ। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হল পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে। কিন্তু দলের বাধায় প্রধানমন্ত্রী হওয়া হল না জ্যোতিবাবুর। প্রথম বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হল।
২০১৯ সালে আবার লোকসভা নির্বাচন। পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে ভোটে অকংগ্রেসি-অবিজেপি জোট লড়াই করতেই পারে। সেই জোটের নেতা কে হবেন? দাবিদার অনেকেই। কিন্তু ধারে-ভারে এগিয়ে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই ওই জোট ক্ষমতায় এলে বাংলা পেতেই পারে প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
জোটের সম্ভাবনা
কিন্তু সেই সম্ভাবনা কতটা বাস্তবায়িত হতে পারে। একথা সত্য যে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি যেভাবে হইহই করে জিতেছে, ২০১৯ সালে তা মোটেও সম্ভব হবে না। ২০১৪ সালের ভোট ছিল কংগ্রেসের কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে স্বচ্ছ প্রশাসন আর আচ্ছে দিনের ভোট। সেই কারণে, উত্তরের চার-পাঁচটি রাজ্য থেকে বিজেপি প্রাপ্ত আসনের সিংহভাগ জিতেছিল। সংখ্যাটা প্রায় ১৫০। কিন্তু ২০১৯ সালে দাঁড়িপাল্লায় মেপে দেখা হবে আচ্ছে দিন কতটা পাওয়া গিয়েছে। তাই বাগ্মী মোদির পক্ষেও গতবারের মতো ঝড় তোলা কার্যত অসম্ভব। সাম্প্রতিক উপ নির্বাচনে বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর আর ফুলপুর উপনির্বাচনে দেখাই গিয়েছে বিরোধীরা একজোট হলে বিজেপির বিজয় রথ থামানো সম্ভব।
জোট ফর্মুলা
সেই ফায়দা কি লুটতে পারবে বিরোধীরা? উত্তর দেওয়া কঠিন। কারণ এখন দু’টো সম্ভাবনা। প্রথমটি কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে জোট। এতে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই হবে একের বিরুদ্ধে এক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেই এই ফর্মুলা কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। দ্বিতীয়ত, কগ্রেসকেও বাদ দাও। সেক্ষেত্রে লড়াই ত্রিমুখী। অনেকটা ১৯৯৬ সালের প্রতিকৃতি দেখতে চাইছে এই ফর্মুলা। কংগ্রেস যাই আসন পাক, সমর্থন করুক তৃতীয় ফ্রন্টের সরকারকে। তবে এই মডেল আবার শারদ পাওয়ারের মতো বিরোধী নেতাদের মনপসন্দ নয়। ফলে জোট গড়ব গড়ব বললেও, কীভাবে তা হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। অবশ্য সময় এখনও রয়েছে।
কারা থাকবেন
এই জোটে কারা থাকতে পারেন? উত্তরপ্রদেশ থেকে অখিলেশ। মায়াবতী যোগ দিতেও পারেন। অন্ধ্র ও তেলেঙ্গানা থেকে চন্দ্রবাবু নাইডু ও কে চন্দ্রশেখর রাও মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু তামিল রাজনীতির ডামাডোলের জন্য কোন দল এই জোটে আসবে তা বলা কঠিন। শিবসেনা এই জোটে ঢুকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পূর্বতন ইউপিএ থেকে এনসিপি ও এনডিএ থেকে লোক জনশক্তির জোটে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নীতীশ বিজেপির সঙ্গ সম্ভবত ছাড়বেন না। লালুর আরজেডি নিশ্চিতভাবেই জোটের সঙ্গে থাকবেন। বিজু কী করবেন তা পরিষ্কার নয়। কেজরিওয়াল বিজেপির বিরোধিতাই করবেন আশা করা যায়। এছাড়া থাকছে তৃণমূল কংগ্রেস। বামেরা কী করবে? এই জোটে তাদের থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। জাতীয় রাজনীতিতে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া বামেদের একলাই চলতে হবে।
জোট ইতিহাস
১৯৪৬ সালেই ভারতে জোট সরকার গড়েছিলেন জওহরলাল নেহরু। স্বাধীনতার পর কেন্দ্রে ও বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের আধিপত্য ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু ১৯৬২ পর্যন্ত সাধারণ নির্বাচনে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট তারা পায়নি। এই সময়কালে ত্রাবাঙ্কুর-কোটিন, ওড়িশা ও কেরলে জোট গড়ে সরকার গড়তে হয়েছিল কংগ্রেসকে। কেরলেই প্রথম ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের নেতৃত্বে অকংগ্রেসি সরকার গঠিত হয়। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনের পর দেখা গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সহ ন’টি রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতা হারিয়েছে। বিরোধীরা জোট করে ক্ষমতায় এসেছে। চতুর্থ সংসদীয় নির্বাচনের পরেই কংগ্রেসে ভাঙন ধরে। ১৯৬৯ সালে বস্তুত ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস কেন্দ্রে ডিএমকে ও সিপিআইয়ের সঙ্গে জোট করেছিল। ১৯৭১ সালের পঞ্চম সাধারণ নির্বাচন থকেই বিরোধীরা একজোট হয়ে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। তবে ভারতে সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী জোট রাজনীতির প্রথম সার্থক প্রয়োগ দেখা গিয়েছিল ১৯৭৭ সালে। ইন্দিরা গান্ধীর তানাশাহির বিরুদ্ধে জনতা পার্টিকে সেবার মানুষ দু’হাত ভরে ভোট দিলেও মোরারজি দেশাই পাঁচ বছর ক্ষমতায় টিকতে পারেননি। মাত্র দু’বছর ছিল সরকারের মেয়াদ। এরপর চৌধুরী চরণ সিং প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। মাত্র ১৭১ দিনে সেই সরকারের পতন হয়। তারপর শুরু হয় কংগ্রেসি রাজ। ১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধী পুনরায় প্রধানমন্ত্রী। ইন্দিরার প্রয়াণের পর ১৯৮৪ সালে ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রী হন রাজীব গান্ধী। বফর্স কেলেঙ্কারির ইস্যু তুলে ১৯৮৯ সালে ফের শুরু হয় জোট সরকার। কিন্তু ভি পি সিং সরকার এক বছরও পূর্ণ করতে পারেনি। পরে চন্দ্রশেখরের সরকার টিকেছিল আরও কম সময়। ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস। তারপর ১৯৯৬ সাল থেকে আবার জোট সরকার। তিন বছরে দু’জন প্রধানমন্ত্রী। প্রথমে দেবেগৌড়া, পরে গুজরাল। ১৯৯৯ সালে এনডিএ জোট করে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। আর ২০০৪ সালে ইউপিএ জোটে কংগ্রেস। তবে পূর্বতন জোটের সঙ্গে এই জোটের তফাৎ হল, এই জোটে হয় কংগ্রেস, না হয় বিজেপি নেতৃত্ব দিচ্ছে। ফলে ওই সরকারগুলি পাঁচ বছরের মেয়াদ সম্পূর্ণ করেছে। কারণ, মিলিজুলি সরকার ঠিক একে বলা যাবে না। বস্তুত, মিলিজুলি সরকার একবারও পূর্ণ মেয়াদ টিকতে পারেনি।
ফেডারেল নেতৃত্ব
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা চন্দ্রশেখরের স্বপ্নের ফেডারেল ফ্রন্টে এবার অনেক নেতাকেই দেখা যাচ্ছে, যাঁদের গ্রহণযোগ্যতা একেবারেই তলানিতে। যেমন চন্দ্রবাবু নাইডু। তিনি এখনও এনডিএ শরিক। অতীতে তিনি তৃতীয় ফ্রন্টের প্রথমসারির নেতা ছিলেন। চন্দ্রশেখর নিজেও বিজেপি বিরোধিতা অতীতে সেভাবে কখনই করেননি। অখিলেশ বিজেপি বিরোধী নিজ রাজ্যেই রাজপাট হারানোয়। মায়াবতী অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এখন বিজেপি বিরোধিতা করছেন। কিন্তু তাঁর পাল্টি খেতে খুব একটা সময় লাগার কথা নয়। লালুপ্রসাদ চিরকালই বিজেপি বিরোধী। শারদ পাওয়ারও তাই। কিন্তু এরা কংগ্রেসকে নিয়ে চলতে ভালোবাসেন। ডিএমকেও কংগ্রেসকে ফেলে দিতে চাইবে না। বাকি রইলেন মমতা। তাঁর রাজ্যে ক্রমশ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে বিজেপি। তাই তিনি এখন কট্টর বিজেপি বিরোধী।
জোট যেদিকে তাকিয়ে
২০১৯-এর আগে বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। এর মধ্যে রয়েছে বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ও। এই সব রাজ্যের ফল ২০১৯-এর সমীকরণ তৈরিতে অনেকটাই সাহায্যকরবে। কারণ বিধানসভায় বিজেপি ভালো ফল করলে, এখনকার মোদি বিরোধী হাওয়া আবার কমে যাবে। আর যদি বিজেপি হারে, তবে জোট রাজনীতির ঝড় উঠবে। সেক্ষেত্রে নজর থাকবে কংগ্রেসের উপর। তারা ভালো ফল করলে বিরোধী নেতাদের অধিকাংশই চাইবেন রাহুল-মোদি টক্কর হোক। আর কংগ্রেস ডুবলে আওয়াজ উঠবে, মোদিকে হারাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই নেতৃত্ব দিতে হবে। আর তা হলে, প্রথম বাঙালি প্রধানমন্ত্রী পদে দেখা যেতে পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।