গুরুজনের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা ও মানসিক উদ্বেগ। কাজকর্মে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। বয়স্কদের স্বাস্থ্য সমস্যা ... বিশদ
১৭, হরচন্দ্র মল্লিক লেন, আহিরীটোলা বললে না চিনলেও, পুতুলবাড়ি নামে চিনবে সকলেই। যেখানে অলৌকিক কাহিনি আর বঞ্চনার ইতিহাস মিলেমিশে একাকার। উত্তর কলকাতার এই বাড়ি নিয়ে প্যারানর্মাল প্রেমীদের মনে আগ্রহের খামতি নেই। সম্ভবত ১৮ শতকের শেষ কিংবা ১৯ শতকের শুরুতে রোমান শৈলীর এই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের তকমা পেয়েছে এই বাড়ি। সময়ের ছাপ বাড়ির অঙ্গে প্রকট। তবে যতটা না ঐতিহ্য তাঁর চেয়েও বেশি অশরীরী থিওরি এই শতাব্দী প্রাচীন বাড়িকে বেশ পরিচিতি দিয়েছে। এই বাড়ির মাথায় একটি পুতুল দাঁড়িয়ে রয়েছে, এছাড়াও বাড়ির দোতলা ও ছাদজুড়ে রয়েছে বিচিত্র সব পুতুলের মূর্তি। সম্ভবত তাই ‘পুতুল বাড়ি’ নামকরণ। এছাড়াও দেওয়ালের ছবি, বাড়ির স্থাপত্যশৈলী ইত্যাদি লক্ষণীয়। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর অবস্থা শোচনীয়। অযত্নের ছাপ স্পষ্ট বাড়ির প্রতিটি অংশে। আর সবকিছু মিলে বাড়ির অশরীরী হাওয়াকে যে বেশ গতি দিয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পুরনো কলকাতায় নদীপথে যে পণ্য পরিবহণ হতো, তাঁর মধ্যে অন্যতম ছিল আহিরীটোলা ঘাট। ঘাট সংলগ্ন গুদাম ঘরে সেসব মালপত্র মজুত থাকত। তখন ঘাট সংলগ্ন এই বাড়িটি গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার হতো। এরপর ১৮৬৯ সালে বৈকুণ্ঠ নট্ট এই বাড়ি ভাড়া নেন বিনোদনের জন্য। বর্তমানে বাড়িটিতে কয়েকঘর ভাড়াটে থাকেন, ভৌতিক সব মিথকে অগ্রাহ্য করেই। কারণ ভিটেছাড়া হওয়ার মতো আতঙ্ক আর কিছুতেই সম্ভবত নেই। কিন্তু এই বাড়ির সঙ্গে আজকের দিনে কীভাবে অলৌকিক তকমা জুড়ে গিয়েছে তা নিয়ে রয়েছে নানা মতামত।
ভূতে বিশ্বাসীদের মতে বাড়ির বারান্দায়, দোতলা বা তিনতলায় তাঁদের আনাগোনা শুরু হয় সন্ধে নামলেই। এমনকী, ভরদুপুরেও নাকি পুতুলরূপী অতৃপ্ত আত্মাদের আনাগোনা প্রত্যক্ষ করেছে কেউ কেউ। লোকে বলে, মধ্যরাতে এই বাড়ি থেকে শোনা যায় কান্নার শব্দ। বাড়িতে অশরীরী ছায়ামূর্তির উপস্থিতিও টের পেয়েছেন কেউ কেউ। যদিও এই কেউ কেউ আসলে কারা, তা স্পষ্ট নয়। সবটাই শোনা কথা।
প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৯ শতকের গোড়ায় এই বাড়ির ধনী বাবুরা এই বাড়িতেই অত্যাচার থেকে খুনের মতো ঘৃণ্য অপরাধ চালাতেন। যদিও এগুলো ছিল বাবুদের মনোরঞ্জনের নামান্তর। দাসীদের কেউ প্রতিবাদ করায় তাঁদের মাশুল দিতে হতো নিজেদের জীবন দিয়ে। তাঁদের শব নাকি বাড়ির পিছনেই পুঁতে ফেলা হতো। আজও নাকি সেইসব অত্যাচারিত অতৃপ্ত আত্মাদের দীর্ঘশ্বাসে এই বাড়ির হাওয়া ভারী হয়ে থাকে। তাঁদেরই কান্না, উপস্থিতি রাত নামলেই টের পাওয়া যায় বলে দাবি অনেকের।
আবার অন্য এক কাহিনি অনুযায়ী একসময় এই বাড়ির মালিকের মেয়ের সংগ্রহে প্রচুর পুতুল ছিল। কিন্তু সেগুলি ছিল অভিশপ্ত, যাদের মধ্যে ছিল আত্মার বাস। বাড়ির মালিক সেগুলি ফেলে দিতে গেলে পরেরদিন বাড়ি থেকে নিজের স্ত্রী ও কন্যার মৃতদেহ উদ্ধার হয়। আর সেই অভিশপ্ত পুতুলগুলি নাকি এখনও বাড়ির তিনতলার ঘরে রয়েছে। সেই কারণেই নাকি তিনতলা বন্ধই থাকে সারাক্ষণ। ভাড়াটেরা থাকেন নীচের দুটি তলাতে। বাড়ির জরাজীর্ণ দশা, অলৌকিক গল্প, আলো আঁধারি পরিবেশ সব মিলে একটা অস্বস্তির চাদর যেন জড়িয়ে রেখেছে বাড়িটিকে। আর বাড়ির বাসিন্দারাও উপদ্রবে অতিষ্ঠ, তবে সেটা ভূতের নয় বরং ভূতপ্রেমীদের। যদিও এখনও পর্যন্ত কেউ ভৌতিক অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারেনি। কিন্তু তাঁতে বিন্দুমাত্র দমেননি তাঁরা। অনধিকার প্রবেশ আটকাতে বাড়ির গেটে ঝোলানো, ‘কঠোরভাবে প্রবেশ নিষেধ’-এর নোটিস। তাতে আরও লেখা রয়েছে, ‘এই বাড়ি নিয়ে প্রচলিত ভূত সংক্রান্ত তথ্যগুলি সম্পূর্ণ মিথ্যে।’ তথ্যও উৎসাহে ভাটা ফেলেনি। মূলত বাড়ির বাসিন্দাদের মতে সবটাই গুজব, তাই ভূতের দেখা না মিললেও অতি উৎসাহীরা তাঁদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়ির ভগ্নপ্রায়, আগাছাপূর্ণ ম্লান দশা ভৌতিক তত্ত্বতে সঙ্গত দিলেও দুঃখজনক যে সংস্কারের অভাবে ধীরে ধীরে পুরনো কলকাতার অংশ মুছে যাচ্ছে। অবহেলা অযত্নে হারিয়ে যাচ্ছে স্থাপত্য, ইতিহাস, সময়ের দলিল। যা একসময় ছিল বর্তমান আজ অস্তিত্ব হারিয়ে তা ভূত মান অতীত। তাই অশরীরী থাকুক না থাকুক অতীত গৌরবের ভূতে কলকাতা যে আক্রান্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।