বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
জীবনের পড়ন্তবেলায় ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়কে গভীরভাবে নাড়া দেয় বিবেকানন্দের জীবনাদর্শ। তিনি জানতেন, ভারতবাসীর মুক্তির উপায় সন্ধান ও ভারতের অন্তবিহীন দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে— স্বামীজির অন্তরাত্মার কী গভীর ব্যাকুলতা।
একদিন কলকাতায় হেদোর ধারে ব্রহ্মবান্ধবের হঠাৎ দেখা বিবেকানন্দের সঙ্গে। ব্রহ্মবান্ধব বললেন, ‘ভাই চুপ করে বসে আছ কেন। এসো একবার কলকাতা শহরে একটা বেদান্ত বিজ্ঞানের রোল তোলা যাক। আমি সব আয়োজন করে দেবো— তুমি একবার আসরে এসে নামো।’
উপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বিবেকানন্দ কাতরস্বরে বলিল— ভবানীভাই, আমি আর বাঁচিব না— যাহাতে মঠটি শেষ করিয়া কাজের একটা সুবন্দোবস্ত করিয়া যাইতে পারি— তাহারি জন্য ব্যস্ত আছি— আমার অবসর নাই।
সেইদিন তাঁহার সকরুণ একাগ্রতা দেখিয়া বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, লোকটার হৃদয় বেদনাময় ব্যথায় প্রপীড়িত। কাহার জন্য বেদনা— কাহার জন্য ব্যথা। দেশের জন্য বেদনা— দেশের জন্য ব্যথা।’
স্বামীজির সঙ্গে এই শেষ দেখার মাস ছয়েক পরে— বোলপুর থেকে তিনি ফেরার সময় হাওড়া স্টেশনে পদার্পণ মাত্র খবর পেলেন বিবেকানন্দের তিরোধানের। ‘শুনিবামাত্র আমার বুকের মাঝে একটুও বাড়ানো কথা নয়— ঠিক যেন একখানা ছুরি বিঁধিয়া গেল। বেদনার গভীরতা কমিয়া গেলে আমার মনে হইল— বিবেকানন্দের কাজ কেমন করিয়া চলিবে। কেন তাঁহার তো অনেক উপযুক্ত বিদ্বান গুরুভাই আছেন— তাঁহারা চালাইবেন। তবুও যেন একটা প্রেরণা হইল তোমার যতটুকু শক্তি আছে, ততটুকু তুমি কাজে লাগাও— বিবেকানন্দের ফিরিঙ্গি জয়ব্রত উদযাপন করিতে চেষ্টা কর। সেই মুহূর্তেই স্থির করিলাম যে, বিলাত যাইব... বিলাতে গিয়া বেদান্তের প্রতিষ্ঠা করিব। তখন আমি বুঝিলাম— বিবেকানন্দ কে।’ (‘বিবেকানন্দ কে?’ স্বরাজ, ২২ বৈশাখ, ১৩১৪)
ব্রহ্মবান্ধবের জীবনের এ এক অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চকর অধ্যায়। মাত্র সাতাশটি টাকা সম্বল করে বিলেত রওনা দিয়ে অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজে দশটারও বেশি বেদান্ত দর্শন বিষয়ে বক্তৃতায় আলোড়ন সৃষ্টি করেন।
তাঁর সাফল্য-সংবাদ জানার জন্য রবীন্দ্রনাথ কতখানি উদ্গ্রীব হয়ে থাকতেন, জানা যায় কবির সেই সময়কার চিঠিপত্রে।
কেমব্রিজে ব্রহ্মবান্ধবের বক্তৃতার এমন প্রভাব হল যে, সেখানকার বড় বড় অধ্যাপকরা মিলে একটি কমিটি তৈরি করে ফেললেন, যার উদ্দেশ্য হল অক্সফোর্ডে হিন্দু দর্শনের অধ্যাপনার জন্য একটি স্থায়ী পদ সৃষ্টি করা। ব্রহ্মবান্ধবকে এই কমিটির ভারতীয় সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয়। তাঁর কাজ হবে ভারতবর্ষ থেকে একজন উপযুক্ত অধ্যাপক পাঠানো।
১৯০৩-এর ১০ মার্চ রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে মোহিতচন্দ্র সেনকে লেখেন, ‘উপাধ্যায় মহাশয়ের শেষ পত্রখানি এই সঙ্গে পাঠাইতেছি। যদি অবকাশ পান তবে পত্রখানি জগদীশকে লইয়া দেখাইবেন তিনি খুশি হইবেন। ভারতবর্ষের যথার্থভাবে আত্মপরিচয় দিবার সময় আসিয়াছে। এখন আর সংকুচিত হইয়া থাকিলে চলিবে না।’
৩ মে কবি অপর এক চিঠিতে মোহিতচন্দ্রকে লেখেন ‘উপাধ্যায়ের সম্বন্ধে বক্তব্য একটু সত্বর লিখে আমাকে হাজারিবাগের ঠিকানায় পাঠাবেন। Miss Noble (ভগিনী নিবেদিতা) বোধহয় ব্যস্ত হয়েছেন। আগামী মেলে পাঠাতে পারলেই ভাল হতো।’
সে বছর ৩ আগস্ট রবীন্দ্রনাথ আলমোড়া থেকে মোহিতচন্দ্র সেনের কাছে জানতে চান ‘উপাধ্যায় মশায় কি ফিরেছেন? তিনি একবার আলমোড়ায় যদি বেড়াতে আসেন তাহলে তাঁর দিগ্বিজয়ী কাহিনি একবার ভালো করে শুনে নিই।’
ব্রহ্মবান্ধব পাশ্চাত্য থেকে ফিরে এলেন যেন আরও বেশি স্বাজাত্যবোধ ও দেশাত্মবোধে সঞ্জীবিত হয়ে। চরিত্র ও মেজাজেও পূর্বের থেকে পাল্টে গেলেন অনেকটা। তিনি সন্ন্যাসী কিন্তু কট্টর জাতীয়তাবাদী। তিনি আর শুধু বৈদান্তিক নন, রাজনীতিপ্রিয়, দুরন্ত বিপ্লবী। পাশ্চাত্য সভ্যতায় মোহাচ্ছন্ন দেশবাসীকে আত্মপ্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে মাতলেন। অদ্ভুত তাঁর চেহারা ও চলার দৃপ্ত ভঙ্গি। পরনে শুধু গেরুয়া কাপড়, আর গায়ে গেরুয়া চাদর। ‘জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন’ মেজাজে গড়া-চরিত্র। ১৯০৪ সালে ডন সোসাইটিতে তাঁর বক্তৃতায় মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতৃগণ। প্রত্যক্ষদর্শী বিনয় সরকার লিখছেন—
‘ব্রহ্মবান্ধব হেগেলের তর্কপ্রণালীর সাহায্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির তুলনা সাধন করেছিলেন। একালে আমি যাকে দ্বন্দ্বমূলক বিশ্লেষণ বলি ব্রহ্মবান্ধব তাকে অপবাদ-ন্যায় বলেছিলেন। ...শুনলাম, পশ্চিমারা কদর করে একমাত্র ভোগ। ত্যাগের ধার তারা ধারে না। হিন্দু-সংস্কৃতি একমাত্র ভোগপন্থীও নয় আবার একমাত্র ত্যাগপন্থীও নয়। ত্যাগ ও ভোগের সমন্বয় হচ্ছে ভারতীয় সনাতন আদর্শ। এইখানেই হেগেল-প্রচারিত সিন্থেসিস (সমন্বয়)।’
বছরখানেক পরে প্রকাশিত হল ‘সন্ধ্যা’। এই কাগজে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে শুরু অগ্নিবৃষ্টি। জ্বালাময়ী ভাষায় ছাঁকা ছাঁকা শব্দবন্ধে বা বাক্যে ব্রহ্মবান্ধব শানাতে লাগলেন আক্রমণ।
অরবিন্দ বলতেন, ‘যদি আমরা ভারতের স্বাধীনতা সত্যই চাই, তবে আমাদের সর্বস্ব পণ করতে হবে— এমনকী নিজের জীবনকে দিতে হবে বলিদান, মৃত্যুভয়কে করতে হবে জয়— আর মার নাম করে দিতে হবে ঝাঁপ। এই হল আমার দীক্ষা-মন্ত্র।’
মৃত্যুর পরোয়া করতেন না এই বিদ্রোহী সন্ন্যাসী। ক্রমশ জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির ‘বিভীষিকাপন্থা’র আবর্তে। ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে ব্রহ্মবান্ধব আবির্ভূত যেন সংহার মূর্তিতে— লৌকিক, প্রায় গ্রাম্য ভাষায় তিনি ব্যাপৃত হন ‘ফিরিঙ্গি-নিধনে।’
উত্তরকালে বিপ্লবের আগুন নিভে গেলে, পণ্ডিচেরিতে স্থিতধী অরবিন্দের কাছে নীরদবরণ এ সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি বলেন— ‘তখন বাংলায় তিনটি কাগজ চলতি ছিল: যুগান্তর, সন্ধ্যা আর বন্দেমাতরম্। ব্রহ্মবান্ধব ছিলেন সন্ধ্যার সম্পাদক, ইনি আর একজন মহৎ লোক। এমন বিচক্ষণ লোক ছিলেন যে, সরকার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ খুঁজে পেত না।’
একসময় আঘাত নেমে আসে ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকা ও ব্রহ্মবান্ধবের উপর। ১৯০৭-এর আগস্ট মাস। ‘সন্ধ্যায়’ প্রকাশিত ‘এখন ঠেকে গেছি প্রেমের দায়ে’ (১৩ আগস্ট), ‘ছিদিসানের হুড়ুম দুড়ুম, ফিরিঙ্গির আক্কেল গুড়ুম’ (২০ আগস্ট) ও ‘বাছা সকল লয়ে যাচ্ছেন শ্রীবৃন্দাবনে’ (২৩ আগস্ট)— প্রবন্ধ তিনটিতে রাজদ্রোহ প্রচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার হলেন ব্রহ্মবান্ধব।
সরকারি পক্ষের কৌঁসুলি মিঃ হিউম মামলার কাজ শুরুর পূর্বেই প্রথম আসামি ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় ১৯০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এক লিখিত বিবৃতি পেশ করেন। সেই বিবৃতিতে তিনি দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘সন্ধ্যা’ পত্র পরিচালনা ও প্রকাশের সমস্ত দায়িত্ব আমি গ্রহণ করছি এবং বলছি যে, ‘এখন ঠেকে গেছি প্রেমের দায়ে’ নামের যে প্রবন্ধ ১৩ আগস্ট ১৯০৭ সালে সন্ধ্যা পত্রে প্রকাশিত হয় এবং যে প্রবন্ধ বর্তমান মামলার অন্যতম বিষয়বস্তু তার লেখক আমি। কিন্তু এই বিচারে আমি কোনরূপ অংশগ্রহণে ইচ্ছুক নই, কারণ বিধাতা-নির্দিষ্ট স্বরাজ-ব্রত
উদ্যাপনে আমার কোনও অংশের জন্য আমি বিদেশি জাতির নিকট যে জাতি বর্তমানে আমাদের শাসক ও যার স্বার্থ আমাদের প্রকৃত জাতীয় বিকাশের পথে অন্তরায়স্বরূপ তার নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য নই।
ব্রহ্মবান্ধবের এই দৃপ্তকণ্ঠে দৃঢ়তাব্যঞ্জক ঘোষণা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ‘বন্দেমাতরম্’ পত্রিকায় পরদিন ব্রহ্মবান্ধবের এমন অবিস্মরণীয় আত্মদান সম্বন্ধে লেখা হয়—
‘Never in the history of seditious trail in India has a statement so bold-so strightforward and so dignified been filed. The statement is in every way worthy of the editor of Sandhya.’
সত্যনিষ্ঠ উপাধ্যায়ের দেশের জন্য দুঃখবরণের দৃষ্টান্তে স্মরণে আসে দেশনায়ক সুভাষচন্দ্রের অত্যন্ত প্রিয় অরবিন্দ-উচ্চারিত কয়েকটি কথা, ‘আমি দেখতে চাই যে, সেই দারিদ্র্য ও অখ্যাতি তোমরা মাতৃভূমির সেবায় নিয়োজিত করেছ। মাতৃভূমির গৌরব তোমাদের কর্মের লক্ষ্য হোক, তোমাদের দুঃখবরণের ভিতর দিয়ে মাতৃভূমি পরমানন্দ লাভ করুক।’
উপাধ্যায়ের গ্রেপ্তারের কয়েকদিন পরে, ১৭ সেপ্টেম্বর চিত্তরঞ্জন দাশ হাইকোর্টে দরখাস্ত করেছিলেন যাতে ‘কসাই কাজি’ নামে অভিহিত কিংসফোর্ডের এজলাসে এই মামলার বিচার না হয়। কিন্তু বিচারপতি কেসপ্যাস অগ্রাহ্য করেন চিত্তরঞ্জনের দরখাস্ত।
বিচার চলাকালে ব্রহ্মবান্ধবের হেঁয়ালিপূর্ণ অনেক কথায় পাওয়া যায় রাজদ্রোহের গন্ধ। যেমন—
যুগান্তরের রক্তারক্তি, টিকটিকির ফাটিল পিত্তি।
ফিরিঙ্গিদের কৃপায় দাড়ি গজায়।
আমাদের পোয়াবারো,
ফিরিঙ্গিদের তেরো।।
ঢিলটি মারিবে
পাটকেলটি পাইবে।।
দুশো গজা তিলে খাজা
কালীঘাটে জোড়া পাঁঠা
একটা কালো একটা সাদা।
শ্রীমুখে দুরূপ কথা।
গোদা পায়ের ভোঁথা লাথি,
আজ ত্রয়োদশী তিথি
বড় সিদ্ধিদায়ী।।
২ অক্টোবর কিংসফোর্ডের এজলাসে চিত্তরঞ্জন ‘ইচ্ছা’ সম্পর্কিত প্রবন্ধটির জেরা শেষ করে কোর্ট থেকে চলে যাচ্ছিলেন। এমন সময় ব্রহ্মবান্ধব তাঁকে বললেন— ‘তুমি বেশ করেছ, আমি ইংরেজের আদালত মানি না, আমি জেরা করব না। আমি তোমাকে বলছি, ইংরেজের সাধ্য নেই আমাকে জেলে দেয়।’
দেশবন্ধু এ সম্বন্ধে তাঁর অনুগামী গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরীকে বলেছিলেন, উপাধ্যায় আমার বাড়িতে এসে এই মোকদ্দমার বিষয়ে কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে গেলে আর গৃহে ফিরে যেতেন না, আমার বাড়িতেই বিছানা থাকা সত্ত্বেও ভূমিশয্যায় শুয়ে থাকতেন।
তৎকালীন ক্যাম্বেল হাসপাতালে চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁর হার্নিয়া অস্ত্রোপচার হয়। সুস্থ হয়ে ওঠার মুখে ধনুষ্টঙ্কার হয়ে ১৯০৭-এর ২৭ অক্টোবর ব্রহ্মবান্ধবের মৃত্যু হয়।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ভাগ্নি ও বিখ্যাত গায়িকা সাহানা দেবী ‘স্মৃতির খেয়া’য় জানিয়েছেন, ‘জাতির পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের দিকে তাঁর (উপাধ্যায়) অগ্নিবর্ষী লেখনী বড় কম করেনি! জননী জন্মভূমির মুক্তিপূজায় তিনিও অন্যতম পুরোধা। দৃপ্ততেজে তিনি বলেছিলেন যে, রাজশক্তির ক্ষমতা নেই তাঁকে কিছু করতে পারে। পরে যখন রাজদ্রোহী বলে রাজদ্বারে তিনি অভিযুক্ত হন, তখন তেমনি জোরের সঙ্গে, তেমনি নিশ্চিত সুরেই আবারও তাঁর মুখে নিঃসৃত হয় এই বাণী— ইংরেজের সাধ্য নেই আমায় জেলে দেয়। চিত্তরঞ্জন তাঁর পক্ষ সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেই মামলা তিনি শুরুই কেবল করেছিলেন, শেষ আর তাঁকে করতে হল না! এই বাক্সিদ্ধ মানুষটি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে ক্যাম্পবেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তিনি চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হলেন। ইংরেজের আইন তাঁকে কিছুই করতে পারল না। প্রবল শক্তিসম্পন্ন ব্রিটিশরাজের সকল গর্ব খর্ব করে তাদেরই সামনে দিয়ে জয়ডঙ্কা বাজিয়ে ব্রহ্মবান্ধব চলে গেলেন তাদের নাগালের বাইরে এই বার্তা ঘোষণা করে—
তোর হাতের ফাঁসি রইল হাতে
আমায় ধরতে পারলি না।’
এই তেজস্বী দেশপ্রেমীর এমন অকস্মাৎ মৃত্যুতে স্তম্ভিত বিপ্লবীরা। কয়েক মাস পরে ১৯০৮-এর ১২ এপ্রিল বারুইপুরে এক সভায় অরবিন্দ বললেন, ‘Upadhyaya saw the necessity of realising Swaroj within us and hence he gave himself up to it. He said that he was free and the Britishers could not bind him, his death is a parable to our Nation.’
ব্রহ্মবান্ধবের মৃত্যুর দু-দিন পর রবীন্দ্রনাথ জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে এক চিঠিতে লেখেন— ‘পরশু ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর মোক্কদমা চলছিল ইতিমধ্যে হার্নিয়ার ব্যামোয় অস্ত্র চিকিৎসা করবার জন্য তিনি ক্যাম্বেল হাসপাতাল আশ্রয় করেছিলেন। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হল— রাজা তাঁকে জেলে দিতে চেয়েছিল— তারচেয়ে উপর থেকে তিনি খালাস পেলেন।’
রবীন্দ্রনাথের বহু বক্তৃতাসভায় উপস্থিত থাকতেন, ভাষণের পর আলোচনাতেও অংশ নিতেন ব্রহ্মবান্ধব। শান্তিনিকেতন আশ্রবাসীদের তরফে তিনিই প্রথম কবিকে দেন ‘গুরুদেব’ উপাধি। ‘বিশ্বকবি’ অভিধাও তাঁর প্রথম প্রদত্ত।
১৯০০ সালের ১ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক ‘সোফিয়া’তে প্রকাশিত হয় ব্রহ্মবান্ধবের ‘The world-poet of Bengal’ শিরোনামে এক মূল্যবান প্রবন্ধ। সেই প্রবন্ধেই তিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথকে World poet বা বিশ্বকবি অভিধায় অভিষিক্ত করে লেখেন— ‘রবীন্দ্রনাথ শুধু প্রেম ও প্রকৃতির কবি নন, যাকে চোখে দেখা যায় না। তাকেও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ রহস্যময় অ-রূপ জগতের প্রত্যক্ষদর্শী। বিদেশীরা যদি কোনওদিন বাংলা ভাষা শেখে, তারা শিখবে শুধু রবীন্দ্রনাথের জন্যই। রবীন্দ্রনাথ একজন বিশ্বকবি।’
ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সঙ্গে শেষ কথা ও শেষ দেখার স্মৃতি কবির মনে এক বিশেষ কারণে এত রেখাপাত করে যা তিনি সুদীর্ঘকাল পরে— ১৯৩৪ সালে উল্লেখ করেন ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসের প্রথম সংস্করণে ‘আভাস’ শীর্ষক ভূমিকায়।
অবশ্য তৎকালীন রাজনৈতিক ঝঞ্ঝাবর্তে জনমতের রুদ্ররোষে তাঁকে ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসের পরবর্তী সংস্করণে সেই তাৎপর্যপূর্ণ ‘আভাস’ ভূমিকাটি বর্জন করতে হয়।
কবি ‘আভাস’ ভূমিকার শেষাংশে ব্রহ্মবান্ধব সম্বন্ধে লিখেছিলেন—
‘...স্বয়ং বের করলেন সন্ধ্যা কাগজ, তীব্র ভাষায় যে মদির রস ঢালতে লাগলেন তাতে সমস্ত দেশের রক্তে অগ্নিজ্বালা বইয়ে দিলে। এই কাগজেই প্রথমে দেখা গেল বাংলাদেশে আভাসে ইঙ্গিতে বিভীষিকাপন্থার সূচনা। বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর এত বড় প্রচণ্ড পরিবর্তন আমার কল্পনার অতীত ছিল।
এই সময়ে দীর্ঘকাল তাঁর সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। মনে করেছিলুম হয়তো আমার সঙ্গে তাঁর রাষ্ট্র-আন্দোলনপ্রণালীর প্রভেদ অনুভব করে আমার প্রতি তিনি বিমুখ হয়েছিলেন অবজ্ঞাবশতই।
নানাদিকে নানা উৎপাতের উপসর্গ দেখা দিতে লাগল। সেই অন্ধ উন্মত্ততার দিনে একদিন যখন জোড়াসাঁকোয় তেতলার ঘরে একলা বসেছিলেম হঠাৎ এলেন উপাধ্যায়। কথাবার্তার মধ্যে আমাদের পূর্বকালের আলোচনার প্রসঙ্গও কিছু উঠেছিল। আলাপের শেষে তিনি বিদায় নিয়ে উঠলেন। চৌকাঠ পর্যন্ত গিয়ে একবার মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, রবিবাবু, আমার খুব পতন হয়েছে। এই বলেই আর অপেক্ষা করলেন না, গেলেন চলে। স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, এই মর্মান্তিক কথাটি বলবার জন্যেই তাঁর আসা। তখন কর্মজাল জড়িয়ে ধরেছে, নিষ্কৃতির উপায় ছিল না।
এই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা ও শেষ কথা।’
মনে হয়, তাঁর দার্শনিক চিন্তা ও অধ্যাত্মসাধনার জগৎ থেকে রাজনীতির দ্বন্দ্ব কোলাহলের আবিলতায় হারিয়ে যাওয়াকেই ব্রহ্মবান্ধব হয়তো ‘খুব পতন’ বলে বোধ করেছিলন। মহান দার্শনিক, রাজনীতির কানা গলিতে পথ হারিয়ে ফেললে মানসিক যন্ত্রণা অস্বাভাবিক নয়।
মৃত্যুর আগে স্বয়ং অনুতাপ করে বলেছিলেন— ‘ভগবান, একি হল! ব্রহ্মানন্দ ছেড়ে এতদিন পরে সংসারের পাঁক ঘাটতে বসেছি!’