বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
১৮৭১ সালে রমেশচন্দ্র ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সফল হয়ে বাংলা ও ওড়িশার বিভিন্ন স্থানে কাজ করেন সরকারি উঁচু পদে। ভারতীয় বলে তাঁর যোগ্যতার উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হয়নি, বারংবার বঞ্চনার শিকার— এমনতরো তীব্র ক্ষোভ সঞ্চিত হয় তাঁর মনে। ১৮৯৭ সালে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে কিছুকাল অধ্যাপনা করেন লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে। পরবর্তীকালে ঋগ্বেদের বাংলা অনুবাদ তাঁর অন্যতম কীর্তি। লালমোহন ঘোষ একদা রহস্য করে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে বলেছিলেন— ‘রমেশ বেদ থেকে আরম্ভ করে ধারাপাত, সব লিখে গেচে!’
রমেশচন্দ্র দত্ত ১৮৯৯ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের লখনউ অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় ফিরে আসেন দেশে। সেই বছর বরোদার মহারাজা সয়াজি রাও গায়কোয়ড় আমন্ত্রণ জানান তাঁকে। বরোদায় গিয়ে একদিন উপস্থিত হন অরবিন্দের বাসগৃহে।
রমেশচন্দ্র স্বয়ং পারদর্শী গদ্যে-পদ্যে-উপন্যাসে। ইংরেজি, বাংলা দু’টি ভাষাতেই তুখোড়। আলাপ-আলোচনার স্রোতের মাঝে এক সময় দেখতে চাইলেন অরবিন্দের কবিতা।
পিতৃকল্প এত বড় একজন লোক তাঁর কবিতা পড়তে চাইছেন, খানিকটা ইতস্তত ভঙ্গিতে অরবিন্দ একগুচ্ছ কবিতা তুলে দিলেন তাঁর হাতে। রমেশচন্দ্র যত তাঁর লেখা পড়েন, ততই বিস্ময়ে বিমুগ্ধ। অরবিন্দকে বললেন— ‘তোমার কবিতা আগে পড়লে কখনওই আমার লেখা ছাপাতুম না। এখন দেখছি, আমি ছেলেখেলা করছি।’
বাংলায় কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত বিশেষ পছন্দ করতেন অরবিন্দ। তাঁর কলকাতায় ফিরে আসার পরের দিনগুলির কথায় বিপ্লবী সুধীরকুমার সরকার জানিয়েছেন, ‘প্রিন্সিপাল পদে ন্যাশনাল কলেজের প্রাপ্য ৭৫ টাকার মধ্যে বাড়ি ভাড়া ২৩ টাকা বাদে আমাদের চার-পাঁচজনের ভরণপোষণ তাঁকে করিতে হয়। একদিন তো বলিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত পড়িতে। তখন তার মূল্য ১৮ টাকা। ভাবিলাম, উনি তো খাওয়া-পরার হিসাব না করিয়াই বই খরিদ করিতে বলিলেন। আর একেবারে অত বড় বই পড়িবার ধৈর্যও আমার ছিল না। বইয়ের দোকানে গিয়া ছোটখাট মহাভারত পাইলাম সাড়ে সাত টাকায়। উহা কিনিয়া আনিয়া উপর উপর পড়িয়া লইলাম। কয়েকদিন পর আবার মহাভারতের কথা উঠিলে বইখানা ধীরে সন্তর্পণে হাতে দিতেই আমার মুখের দিকে একবার তাকাইয়া ছোট্ট হাসির সাথে বলিলেন, এ মহাভারত পড়িয়া তো লাভ নাই। ইহা আধুনিক ইতিহাসযোগ্য করিয়া লেখা। এসব উপরের খোলস। Spirit বাদ দিয়া খোলস পড়িলে যা হয়, তাই। ফেরত দিয়া বদলাইয়া অন্ততঃ কালীপ্রসন্ন সিংহের বাংলাখানা আনিতে বলিলেন।’
বরোদায় অরবিন্দের মহাভারত চর্চায় বিমুগ্ধ হয়েছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত। এরপরে ১৯০৪ সালে রমেশচন্দ্র রাজস্ব সচিব হলেন বরোদা রাজ্যে। সেই সময় সুযোগ ঘটে এই দুই বঙ্গসন্তানের আরও কাছাকাছি আসার। তখন সেখানে অরবিন্দের প্রাত্যহিক পঠন-পাঠন ও মহাকাব্য চর্চার এক বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় ছায়াসঙ্গী দীনেন্দ্রকুমার রায়ের চিত্ররূপময় স্মরণ-উদ্ভাসে।
বরোদার দিনগুলোয় অরবিন্দ অনেক রাত পর্যন্ত জেগে লেখাপড়া করতেন বলে দেরি হয়ে যেত সকালে উঠতে। ‘চার-পাঁচ টাকা দামের একটা মুখখোলা ওয়াচ’ সঙ্গে থাকত সব সময়। পড়ার টেবিলে থাকত ছোট একটা টাইমপিস ঘড়ি। সকালে চা খেয়ে লিখতে বসতেন।
দীনেন্দ্রকুমার জানাচ্ছেন, ‘...তিনি মহাভারতের অনুবাদ করিতেছিলেন। বাংলা ভালো বুঝিতে না পারিলেও সংস্কৃত রামায়ণ-মহাভারত তিনি সুন্দর বুঝিতে পারিতেন। তিনি ধারাবাহিকরূপে অনুবাদ করিতেন না। মহাভারতের এক একটি উপাখ্যান অবলম্বন করিয়া কবিতা লিখিতেন; ইংরেজীর নানা ছন্দে কবিতা লিখিতেন। ... ছোট আকারের গ্রে-গ্রানাইট রঙের চিঠি-লেখার কাগজে প্রথমে কবিতাগুলি লিখিতেন, প্রায়ই কাটাকুটি করিতেন না। লিখিবার পূর্বে সিগারেট টানিতে টানিতে খানিকটা ভাবিয়া লইতেন; তাহার পর তাঁহার লেখনীমুখে ভাবের মন্দাকিনী প্রবাহিত হইত।’ পরবর্তী সময়ে অরবিন্দের ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকায় এক-একটি অগ্নিবর্ষী লেখায় জাতির ধমনীতে যেন নতুন রক্তপ্রবাহ বইতে শুরু করে। অথচ কত দ্রুত আর অনায়াসে লিখতেন স্বদেশবাসীর ঘুম-ভাঙানিয়া অবিস্মরণীয় সব নিবন্ধ।
এমন শোনা যায়, অরবিন্দ বসে আছেন কলকাতার স্কট লেনের বাড়িতে— এমন সময় শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী এলেন ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার সম্পাদকীয়-র জন্য লেখা চাইতে। অরবিন্দ তাঁর টেবিলের কাগজের স্তূপ থেকে প্যাকিং কাগজ বের করে তার একপাশে লেখা শুরু করে মিনিট পনেরো-কুড়ির মধ্যে শেষ করলেন। ভাবতে অবাক লাগে, কোনও পরিবর্তন, কোনও কাটাকুটি কিছুরই দরকার হতো না। পরের দিন সেই লেখাই পাঠকদের অন্তরে স্বদেশপ্রেমের প্লাবন বইয়ে দিত।
দীনেন্দ্রকুমার জানিয়েছেন— ‘অরবিন্দকে কখনও রাগ করিতে দেখি নাই।’
বেলা প্রায় দশটা পর্যন্ত লেখাপড়া করে তিনি স্নানে যেতেন। স্নান শেষে ফের বসতেন লেখার খাতা নিয়ে। সকাল থেকে লেখা হতো যতটুকু, আবৃত্তি করতেন আপন মনে। কোনও কোনও ছত্র দু’তিনবার পাঠের পর প্রয়োজন মতো পরিবর্তন করতেন দু-একটি শব্দ।
এগারোটার পূর্বেই খাবার এসে যেত টেবিলে। খেতে খেতে খবরের কাগজ দেখে নিতেন অরবিন্দ। সেখানকার খানা মুখে রুচত না দীনেন্দ্রকুমারের, কিন্তু তিনি ছিলেন তাতেই অভ্যস্ত। পাচকের কাছে রান্না সম্বন্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন না কখনও।
অরবিন্দের ভিক্টোরিয়া গাড়ি সম্বন্ধে তাঁর বাংলা শিক্ষক লিখছেন— ‘ঘোড়াটা খুব বড়, কিন্তু চলনে গাধার দাদা! চাবুকেও তাঁহার গতিবৃদ্ধি হইত না! গাড়িখানি যে কতকালের তাহা কেহ বলিতে পারিত না। অরবিন্দের সকলই বিচিত্র। যেমন পোশাক পরিচ্ছদ, তেমনই গাড়ি, তেমনই বাড়ি।’
বরোদায় তাঁর বাসগৃহে ‘গ্রীষ্মকালে দুঃসহ রৌদ্রে খাপরা তাতিয়া আগুনের মতো হইত। আবার শীতকালে এমন কনকনে শীত যে, যেন বুকের রক্ত পর্যন্ত জমিয়া যাইবার উপক্রম হইত। কিন্তু অরবিন্দ শীত, গ্রীষ্মে সমান নির্ব্বিকার। শীতে, কি গ্রীষ্মে একদিনও তাঁহাকে কাতর দেখি নাই। এই বাঙ্গলোতে দিনে মাছি ও রাত্রে মশার উপদ্রবে আমি অস্থির হইয়া উঠিতাম। রাত্রে শয্যায় শয়ন করিয়া মনে হইত মশাগুলা আমাকে মাঠে টানিয়া লইয়া গিয়া শোষণ করিবে। ঘরের খাপরাগুলি পুরাতন; ঘরগুলি বহুদিন অসংস্কৃত অবস্থায় খালি পড়িয়া ছিল। বর্ষাকালে খাপরার ভিতর দিয়া মেঝেতে টুপটাপ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িত। আমাদের দেশের অনেক বড়লোকের গোশালাও ইহা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট স্থান। কিন্তু এমন কদর্য্য গৃহে বাস করিতে অরবিন্দের বিন্দুমাত্র আপত্তি বা কুণ্ঠা দেখি নাই। তিনি নির্ব্বিকার চিত্তে দীর্ঘকাল সেই জীর্ণ গৃহে বাস করিয়াছিলেন।’
কখনও পরতেন না বিলাসী সাজ-পোশাক। ‘মূল্যবান জুতা, জামা, টাই, কলার, ফ্লানেল লিনেন, পঞ্চাশ রকম আকারের কোট, হ্যাট, ক্যাপ এ সকল তাঁহার কিছুই ছিল না। কোনও দিন তাঁহাকে হ্যাট ব্যবহার করিতে দেখি নাই। যে টুপীগুলি এ দেশে পিরালী টুপী নামে সাধারণত পরিচিত, তিনি তাহাই ব্যবহার করিতেন।’ তাঁর শয্যাও ছিল পোশাকের মতো সাধারণ ও আড়ম্বরহীন।
তাঁকে নিয়মিত বই সরবরাহ করতেন বম্বের তৎকালীন বিখ্যাত পুস্তক ব্যবসায়ী আত্মারাম রাধাবাঈ সেগুন ও থ্যাকারে কোম্পানি। তাঁরা প্রতি মাসে, কখনও কখনও প্রতি সপ্তাহে পাঠাতেন নতুন বইয়ের পূর্ণ তালিকা। কলকাতার গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স ও বসুমতী অফিস থেকে প্রকাশিত বইপত্র আসত নিয়মিত। মাইনে পেয়েই প্রতি মাসে পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা পাঠাতেন গ্রন্থ-প্রকাশকদের। প্যাকিং বাক্সে বোঝাই হয়ে তাঁর বই আসত ‘রেল-পার্সেলে’। সেই সব সদ্য-আসা বই আট-দশ দিনে পড়ে ফেলে নতুন বইয়ের অর্ডার পাঠাতেন— এমনই সর্বভুক পাঠক ছিলেন অরবিন্দ।
বরোদায় তিনি অনেক অর্থ ব্যয় করতেন গ্রন্থ সংগ্রহে। অথচ মাত্র কয়েক বছর পূর্বে— বিলেত থেকে ফিরে আসার আগে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কষ্ট পেয়েছেন খিদের যন্ত্রণায়। সামান্য কিছু বৃত্তির অর্থে ব্যয় সংকোচন করেও কোনও মতে সমাপ্তি টানেন বিলেতে প্রবাস জীবনের শেষের দিনগুলি।
প্রশ্ন জাগে, কেন এমন হয়েছিল? কেন অরবিন্দকে সইতে হয়েছিল অনেকদিন নিরাহার, আধপেটা খাওয়ার শোচনীয় পরিস্থিতি? এর নেপথ্যের ইতিহাস বড় করুণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ডাঃ কৃষ্ণধন ঘোষের উপন্যাসোপম বিচিত্র জীবনের বেদনা-ভারাতুর শেষের দিনগুলি।
পিতার প্রসঙ্গে প্রায়ই নীরব থাকতেন অরবিন্দ। অবশ্য অগ্রজের গভীর নীরবতা অনেকটা পূরণ হয়েছে অনুজের ‘আত্মকথা’র সরবতায়। বারীন্দ্রকুমার ঘোষ লিখছেন—
‘মায়ের মত উদ্দাম পাগলের সঙ্গে সারা জীবন ঘর করা খুব ধৈর্য্যের ও সহিষ্ণুতার কথা, বাবা তা চেষ্টা করেও পারেননি। তবু সে চেষ্টা কম দিন তিনি করেননি। মা পাগল হতে আরম্ভ হবার পরও তাঁদের চার ছেলে ও এক মেয়ে হয়েছিল। বোধহয় আমার জন্মের পর বিলাত থেকে ফিরেই দু’জনে পৃথক হন, মা এসে রোহিণীতে বাস করেন। মাকে বাবা মাসে মাসে আর্থিক সাহায্য করতেন, খুব সম্ভব যে সাহায্যের পরিমাণ ও তাঁর আসা যাওয়া ক্রমশঃ কমে এসেছিল, কারণ রেল লাইনের ধারের সেই সাহেবী বাড়ীর মত খানসামা, বাবুর্চি, আয়া ও আড়ম্বর আর তারিণীবাবুর বাড়িতে ছিল না। একটা চাকর দিত জল আর মা করতেন রান্না। শেষের দিকে টাকা আসতো দাদাবাবু রাজনারায়ণ বসুর হাতে, কারণ আমরা দেখতাম বাঁকে করে করে লোকে মাস কাবারের বাজার দাদাবাবুর বাড়ী থেকে নিয়ে মায়ের কাছে দিয়ে যেত।
বাবার স্বভাব ছিল বেহিসেবী খরচে, টাকা তাঁর হাতে ভোজবাজীর সৃষ্ট জিনিসের মত দেখতে না দেখতে উড়ে যেত। দয়ার বশে যে নারীর অধিক অসহায় ও দুর্ব্বল, বন্ধুর জন্যে যে এককথায় সর্বস্ব দিয়ে দিতে পারে, পরিচিত অপরিচিতের যে মানুষ স্বভাবতঃ পরমাশ্রয়, সে মানুষ অমিতব্যয়ী হলে যা হয় এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ছেলে তিনটিকে বিলাতে শিক্ষার জন্যে রেখে এসে বাবা কিছুদিন নিয়মিত টাকা পাঠালেন, তারপর সে দিকেও বিশৃঙ্খলা এল। এইরকম মানুষ দুনিয়ায় অনেক আছে যারা দুঃস্থের জন্যে দানসত্র খুলে বসে আছে, আর তার নিজের পরমাত্মীয় উপবাসে মরছে।’
১৮৯০ সালে ডাঃ কৃষ্ণধন ঘোষ যখন খুলনার সিভিল সার্জেন— তখন উন্মাদগ্রস্তা স্বর্ণলতা ঘোষ তাঁর দুই সন্তান বারীন্দ্রকুমার ও সরোজিনীকে নিয়ে থাকতেন দেওঘর থেকে মাইল তিনেক দূরে রোহিণীতে। বারীন্দ্রকুমার ও সরোজিনীকে পাগল-মায়ের কাছ থেকে নিয়ে আসার জন্য ডাঃ কৃষ্ণধন দেওঘরে শ্যালক যোগেন বসুকে লেখেন একের পর এক চিঠি, সঙ্গে পাঠান টাকা।
রোহিণীতে অতিবাহিত দিনগুলির কথায় বারীন্দ্রকুমার জানাচ্ছেন— ‘আমাদের বাড়ীতে জনমানুষ কখনও আসতো না, সে অঞ্চলে প্রসিদ্ধ পাগলী মেমসাহেবের ভয়ে ও-বাড়ীর ত্রিসীমানায় কাউকে ঢুকবার সাহস রাখতে দেখিনি। মা মাঝে মাঝে রেগে উগ্রচণ্ডী হয়ে থাকতেন; তখন বাড়ীর হাতার মধ্যে অপরিচিত মানুষ দেখলে চীৎকার করে গালাগালি দিতেন, ছোরা দেখাতেন, দরকার হলে তাড়াও করতেন।’
অবশেষে ডাঃ কৃষ্ণধন স্বয়ং উপস্থিত হলেন রোহিণীতে স্ত্রী ও পুত্র কন্যাকে দেখতে। ‘অসহ্য ভয়ের ও দুঃখের শোণিত-রেখায় আঁকা শৈশবের এই জীবনের কথায় পিতাকে প্রথম পাওয়ার প্রসঙ্গে বারীন্দ্রকুমার লিখছেন—
‘একদিন আমি ও দিদি বাইরে খেলা করছি, কে একজন হোমরাচোমরা গোছের মানুষ এলো। ভিতরে যখন আমাদের ডাক পড়লো তখন আমার এইটুকু মনে আছে যে, দাড়ীওয়ালা ভীষণদর্শন তার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যে আমি আর দিদি সারা ঘরটার দেওয়ালের ধারে ধারে ছুটোছুটী করছি আর সেই মানুষটি দুই হাত বাড়িয়ে আমাদের বুকে নেবার জন্যে পাগলের মত আসছে। তারপর অজস্র খেলনা বিস্কুটের রমণীয় স্তূপের মাঝে কখন যেন আমাদের আত্মসমর্পণের পালা।’
স্বর্ণলতা এতই উন্মাদগ্রস্তা ছিলেন যে, দেওঘরের পুরাণদহে তাঁর পিতার কাছে রাখাও সম্ভবপর ছিল না। তা না হলে রোহিণীর মাঠে, বাংলোতে আয়া-বাবুর্চি-চাকর দিয়ে তাঁকে ওভাবে রাখবার কোনও প্রয়োজন ছিল না।
পুত্রকন্যাদের দেখে ডাঃ কৃষ্ণধনের মনে হয়, পাগল-মায়ের কাছে থেকে তাদের লেখাপড়া তো হবেই না, এমনকী যে-কোনও সময় ঘনিয়ে আসতে পারে জীবন-সংশয়।
তখন কৃষ্ণধন ঘোষ বাধ্য হয়ে বারীন ও সরোজিনীকে তাঁদের মায়ের কাছ থেকে লোক দিয়ে একরকম চুরি করিয়ে নিয়ে আসেন কলকাতার গোমেস লেনে।
নিজের চাঞ্চল্যকর অপহরণ-পর্ব সম্বন্ধে বারীন ঘোষ লিখছেন— ‘আমার বেশ মনে আছে— তখন শীতকাল, বোধহয় অগ্রহায়ণ কি পৌষ মাস। ...হঠাৎ একটা গুন্ডাকসমের গাঁট্টাগোঁটা মানুষ এসে মাকে বলল, মেম সাহেব, ফুল লেগা। সে এক কোঁচড় ফুল মায়ের সামনে ঝপ করে ছুঁড়ে দিয়ে আমার দু’হাত চেপে ধরলো, তারপর আমাকে টানতে টানতে নিয়ে দে দৌড়! পিছনে পিছনে রৈ রৈ রবে হল্লা করতে করতে ছুটলো আরও দশ বার জন জোয়ান। মা তো রেগে কাঁই, দৌড়ে ভিতরে গিয়ে ছোরা এনে ঊর্ধ্বশ্বাসে গুন্ডার পালকে তাড়া। আর মাটিতে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে টানতে টানতে আমাকে নিয়ে গুন্ডার পালের প্রাণ হাতে করে ছুট।’
গুন্ডার দল বারীনকে নিয়ে তুলল কলকাতার গোমেস লেনে। সেখানেই প্রথম দেখা রাঙ্গা মায়ের— যিনি পরে প্রকৃত মায়ের হৃদয়ে স্নেহ-যত্ন দিয়ে বড় করে তোলেন তাঁদের। কিন্তু নিয়মিত নিষ্করুণ পরিহাস, অশ্রুব্যাকুল বেদনায় আঘাতে জর্জরিত তাঁর জীবন। একমাত্র বারীন ঘোষের স্মৃতিচারণা ছাড়া তিনি যেন কাব্যে উপেক্ষিতাই রয়ে গেলেন কৃষ্ণধন ঘোষের জীবন থেকে। অরবিন্দ-পিতার মৃত্যুর পর ব্রাহ্মসমাজের এক কেষ্টবিষ্টুর বিশ্বাসঘাতকতায় অসময়ে নিঃশেষিত হয়ে যায় বারীন ঘোষের প্রিয় ‘রাঙ্গা মায়ের’র জীবন।
বারীন ঘোষ জানান— ‘লেনের একটা দোতলা বাড়ীতে নিয়ে ওরা আমায় তুললো। তখনকার দিনে মোটরকার ছিল না, ছিল অগুন্তি ছ্যাকরা গাড়ী। নীচে আমায় কোলে করে নিলেন এতক্ষণের রহস্যে ঘেরা রাঙা মা। দীর্ঘছন্দ সবল বলিষ্ঠ দেহ, অপূর্ব্ব রূপ সারা যৌবন সুঠাম অঙ্গ বয়ে ঝরে পড়ছে। বয়স আন্দাজ ১৮/১৯— অন্ততঃ এখন তাই মনে হয়। আমার জরাজীর্ণ শতছিদ্র কাপড় ছাড়িয়ে মা আমায় গরম জলের গামলায় ফেলে সাবান ও স্পঞ্জ দিয়ে ধুয়ে মুছে তুললেন, ধোয়া কাপড় পরিয়ে বুকে চেপে ধরে সে কি আদরের ঘটা। সন্তানহীনা সেই বালিকার প্রাণ হৃদয় মন সব অন্তরটুকু আমি একমুহূর্তে হরণ করে নিয়েছিলুম। দিদি এসে মুখটি চুন করে সামনে দাঁড়াল।’
ফাঁসির মঞ্চ ছুঁয়ে এসে— আন্দামান দ্বীপান্তরের জীবনশেষে, ফেলে আসা দিনগুলির কথায় বারীন ঘোষ লেখেন, ‘রাজনারায়ণ বসুর প্রতিভায় জাত তাঁর পাগলী মেয়ে আমার মা, প্রকাণ্ড শক্তিধর পুরুষ অথচ ভালোবাসায় সৌন্দর্য্যের মোহে সহজে আকৃষ্ট নারীর অধিক কোমল উন্মার্গগামী কৃষ্ণধন আমার বাবা, যাঁদের ঔরসে ও গর্ভে জন্মেছেন মেজদা— মনোমোহনের মত অপূর্ব্ব কবি, সেজদা শ্রীঅরবিন্দের মত শতমুখী প্রতিভার বিরাট পুরুষ; সেই শক্তির চঞ্চল ইতস্ততঃ বিশপী শিখায় আমার জন্ম। তাঁদের সব দুর্ব্বলতা ও কিছু কিছু শক্তি ও প্রতিভার স্ফুলিঙ্গ নিয়ে ধুমে ও আলোকে কৃষ্ণজ্যোতির্ম্ময় আমার এই সত্তা জন্মেছে।’