পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়: ১৮৯৮-এর শেষ লগ্নে চিকিৎসক ও বন্ধুদের পরামর্শে দেওঘর গেলেন বিবেকানন্দ। সেখানে মাসখানেক কাটিয়ে কলকাতায় ফেরেন ১৮৯৯-এর ২২ জানুয়ারি। তখনও দেওঘরে জীবিত ছিলেন উত্থানশক্তিরহিত রাজনারায়ণ বসু।
মৃত্যুর পূর্বে প্রায় আড়াই বছর পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। অবশ হয়ে গিয়েছিল তাঁর ডানদিক, তুলতে পারতেন না ডান হাত। কেউ দেখা করতে এলে বাম হাতেই নমস্কার বা প্রতি নমস্কার করতেন। সেই কারণে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাইতেন বারংবার।
রাজনারায়ণের এমন অবস্থায় দেওঘরে থাকতে বিবেকানন্দ একদিন দেখা করতে গিয়েছিলেন, লিখেছেন গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী। তিনি ‘শ্রীঅরবিন্দ ও বাঙ্গলায় স্বদেশী যুগ’ গ্রন্থে জানান ‘১৮৯৮ খৃঃ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অথবা ১৮৯৯ খৃঃ জানুয়ারীর যে-কোন সময়ে স্বামীজী, পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী রাজনারায়ণবাবুর সহিত গিয়া সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাতের সময় অরবিন্দের কনিষ্ঠা ভগিনী কুমারী সরোজিনী ঘোষ উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রত্যক্ষদর্শী এবং তিনি একাধিকবার আমাদিগকে এ কথা বলিয়াছেন।’
জানা যায়, এই সাক্ষাতের সময় অরবিন্দের ছোট বোন সরোজিনী ঘোষ ছাড়াও ছোট মাসি লজ্জাবতী দেবীসহ আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।
গিরিজাশঙ্কর জানিয়েছেন, ‘...মধ্যাহ্ন-ভোজনের জন্য রাজনারায়ণবাবু স্বামীজীকে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। স্বামীজী রাজনারায়ণবাবুর বাড়ীতে আসিয়া নিজে রন্ধন করিয়া ভোজন করিয়াছিলেন। রাজনারায়ণ বাবু শয্যাশায়ী অবস্থাতেই স্বামীজীর ভোজনের সর্বপ্রকার ব্যবস্থা নিজে পর্য্যবেক্ষণ করিয়াছিলেন। বারান্দাটি ঘেরাও করিয়া দিয়াছিলেন। উভয়ের প্রতি উভয়ের একটা সম্ভ্রম-শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধের পরিচয় আমরা পাই। একজন আর একজনের নিকট অপরিচিত আগন্তুক নহেন। যেন উভয়েই উভয়ের মনের মানুষ।’
অরবিন্দের মাতামহ রাজনারায়ণ বসু ছিলেন জীবন সমুদ্রের এক আশ্চর্য আলোকোজ্জ্বল বাতিঘর,— এক মহা পরিবর্তনের অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী।
সঞ্জীবনী সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্র তাঁর আত্মচরিতে লিখেছেন ‘রাজনারায়ণ বসু মহাশয় আমার বিবাহের ২/১ বৎসর পূর্ব্ব হইতেই দেওঘরে বাস করিতেছিলেন। তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যাকালে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদিগকে লইয়া ব্রহ্মোপাসনা করিতেন। তৎপর পৃথিবীর সমস্ত দেশের ইতিহাস ও বিভিন্ন জাতির অবস্থা বর্ণনা করিতেন। ভারতে হিন্দুজাতির কী প্রকারে অভ্যুদ্বয় হইয়াছিল, কেনই বা তাহাদের পতন হইয়াছিল তদ্বিষয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করিতেন।’
অরবিন্দের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে মাতামহ রাজনারায়ণের জীবন-চর্যা ও চিন্তাধারার প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কোনও কোনও বিষয়ে নিবিড় তাঁদের চিন্তা-সাযুজ্য। দু’জনেই ঔপনিষদিক চিন্তায় ও চর্চায় অনন্যচিত্ত। মাতামহের মতো দৌহিত্রও জীবনের এক পর্যায় দুর্মদ হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবের দীপক রাগিণীতে।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ‘ভারতের জাতীয় আন্দোলন’ সন্দর্ভে লিখেছেন— ‘স্বর্গীয় রাজনারায়ণ বসু ও ঠাকুরবাড়ীর কয়েকজন যুবক মিলিয়া অতি উদ্ভট রকমের বৈপ্লবিক জল্পনা করিতেন বলিয়া শোনা যায়।’
ঠাকুরবাড়ির সেই ‘কয়েকজন যুবক’-এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ কতটা যুক্ত ছিলেন— সে রহস্য তিনি নিজেও খোলসা করেননি ‘জীবনস্মৃতি’তে। কবি জানিয়েছেন—
‘জ্যোতিদাদার উদযোগে আমাদের একটি সভা হইয়াছিল, বৃদ্ধ রাজনারায়ণবাবু ছিলেন তাহার সভাপতি। ইহা স্বাদেশিকের সভা। কলিকাতার এক গলির মধ্যে এক পোড়ো বাড়িতে সেই সভা বসিত। সেই সভার সমস্ত অনুষ্ঠান রহস্যে আবৃত ছিল। বস্তুত, তাহার মধ্যে ঐ গোপনীয়তাটাই একমাত্র ভয়ংকর ছিল। আমাদের ব্যবহারে রাজার বা প্রজার ভয়ের বিষয় কিছুই ছিল না। আমরা মধ্যাহ্নে কোথায় কী করিতে যাইতেছি, তাহা আমাদের আত্মীয়রাও জানিতেন না। দ্বার আমাদের রুদ্ধ, ঘর আমাদের অন্ধকার, দীক্ষা আমাদের ঋক্মন্ত্রে, কথা আমাদের চুপিচুপি— ইহাতেই সকলের রোমহর্ষণ হইত, আর বেশি-কিছুই প্রয়োজন ছিল না। আমার মতো অর্বাচীনও এই সভার সভ্য ছিল। সেই সভায় আমরা এমন একটি খ্যাপামির তপ্ত হাওয়ার মধ্যে ছিলাম যে, অহরহ উৎসাহে যেন আমরা উড়িয়া চলিতাম। লজ্জা ভয় সংকোচ আমাদের কিছুই ছিল না। এই সভায় আমাদের প্রধান কাজ উত্তেজনার আগুন পোহানো।’
মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রিয়বন্ধু রাজনারায়ণের প্রেরণাতেই অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিখতে শুরু করেছিলেন ‘সিংহলবিজয়’ কাব্য। ১৮৬২ সালের ৯ জুন কলকাতা থেকে বিলেত যাত্রা করেন মাইকেল। পাঁচদিন পূর্বে তিনি প্রাণের বন্ধু রাজনারায়ণকে পাঠান একটি বিদায়পত্র— সেই চিঠির মধ্যে লেখেন তাঁর সুবিখ্যাত ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতাটি।
মহৎ-প্রাণ এমন মানুষকে দেশবাসী শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় ভূষিত করেন ‘ঋষি’ অভিধায়। উত্তরকালে স্বনামধন্য মাতামহ ঋষি রাজনারায়ণ বসুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে দৌহিত্রও হয়ে ওঠেন ঋষি অরবিন্দ। যদিও তখন তিনি বিপ্লব বা ‘বিভীষিকা পন্থা’র অন্তবিহীন পথ পেরিয়ে পরম সত্তার অন্বেষায় আসীন ধ্যানের আসনে।
১৮৯৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দেওঘরে মাতামহ রাজনারায়ণের তিরোধানে অরবিন্দ বরোদা থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানান ‘Transit, Non periit’ শীর্ষক কবিতায়। সেই ইংরেজি কবিতার প্রারম্ভে প্রয়াত মাতামহের উদ্দেশে লেখেন—
‘তোমার তো শেষ হয়নি; তুমি তো আমাদের থেকে, আলো
থেকে অন্ধকারে চলে যাওনি। ও দুর্বার দীপ্ত আত্মা!
তুমি তো যাওনি সেই স্বর্গে যেখানে আছে সেই পুরানো
আনন্দ আর সন্ন্যাসের স্তব্ধতা।’
(অনুবাদ- প্রমোদকুমার সেন)
বরোদা-জীবনের শুরুতে বম্বের ‘ইন্দুপ্রকাশ’-এ অরবিন্দ বলেছিলেন, যাদের কিছু নেই— সর্বহারা মানুষদের কথা, যারা বেঁচে থাকে একমাত্র সম্বল শরীরটাকে খাটিয়ে। সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘Proletariate is the real key to the situation.’
মাত্র কয়েক বছর পরে একদিন বিবেকানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন এক আশ্চর্য আগন্তুক— ‘হিতবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক। নাম তাঁর সখারাম গণেশ দেউস্কর। জন্মসূত্রে মারাঠি হলেও ছিলেন খাঁটি বাঙালি। পরবর্তী সময়ে অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীদের ক্লাস নিতেন। পড়াতেন অর্থনীতি। বোঝাতেন ব্রিটিশ ভারতে শোষণের ইতিহাস। অধ্যাপনা করতেন বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজে। কিন্তু ইংরেজ-বিরোধী মতবাদের জন্য বাধ্য হন পদত্যাগ করতে।
বিবেকানন্দের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সখারাম দেউস্করের সঙ্গে গিয়েছিলেন দুই বন্ধু। তাঁদের একজন পাঞ্জাব থেকে এসেছেন শুনে স্বামীজি সেখানকার অভাব ও বিবিধ সমস্যার কথা বলতে লাগলেন। তখন পাঞ্জাবে চলছিল তীব্র খাদ্যাভাব।
বিবেকানন্দ তাঁদের বুঝিয়ে বলেছিলেন— দরিদ্র মানুষদের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ও সামাজিক প্রগতির জন্য সর্বাগ্রে চাই শিক্ষা। আর শিক্ষা বিস্তারের কাজে এগিয়ে আসতে হবে দেশের ধনী ও শিক্ষিত মানুষজনদের। সংখ্যায় তারা স্বল্প হলেও দায়িত্ব অনেক।
স্বামীজির মন তখন ধাবিত ছিল দু’টি দিকে। এক, অরবিন্দ যাদের প্রোলেতারিয়েত বলেছেন, তাদের উদ্ধার এবং দুই, বিপ্লব-সংহারের প্রতীক কালীর উপাসনা। সুতরাং বিবেকানন্দ দরিদ্রদের সমস্যা ও দুঃখ-কষ্টের প্রসঙ্গেই কথা বলতে লাগলেন। বেদান্তের কথা কিছুই হল না।
এই জাতীয় আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বিদায় নেবার সময় পাঞ্জাবি ভদ্রলোক খানিকটা নৈরাশ্যের সুরে বললেন— ‘মহাশয়, ধর্মবিষয়ক বিভিন্ন উপদেশলাভের বড় আশা নিয়ে আমরা আপনার কাছে এসেছিলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের কথাবার্তা তুচ্ছ বিষয়গুলির মধ্যে আবদ্ধ থেকে গেল। দিনটাই বৃথা গেল।’
বিবেকানন্দ গম্ভীর মুখে তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন— ‘মহাশয়, যে পর্যন্ত আমার দেশের একটি কুকুরও অভুক্ত থাকবে,— সে পর্যন্ত আমার ধর্ম হবে তাকে খাওয়ানো ও তার যত্ন নেওয়া— আর যা কিছু তা হয় ধর্মধ্বজিতা বা অধর্ম!’
স্বামীজির কথা শুনে ও ভাব দেখে অবাক হয়েছিলেন তিন আগন্তুকই। এমনকী, এতবড় পণ্ডিত সখারাম দেউস্করও সেদিন বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিকতার প্রমাণ না পেয়ে, পেয়েছিলেন শুধু তাঁর স্বদেশপ্রেমের পরিচয়। যদিও সে পরিচয় ছিল নিবিড় প্রাণস্পর্শী ও প্রেরণাপ্রদ।
স্বামীজির দেহান্তের দীর্ঘকাল পরে তাঁরই এক শিষ্যের কাছে সখারাম সেই কথাগুলি জানিয়েছিলেন সবিস্তারে। বিবেকানন্দের ‘ঐ কথাগুলি তাঁহার অন্তঃকরণে চিরতরে জ্বলন্ত অক্ষরে মুদ্রিত হইয়া গিয়াছিল এবং তাঁহার সম্মুখে স্বদেশপ্রেমের এমন এক অচিন্তনীয় জীবন্ত চিত্র তুলিয়া ধরিয়াছিল, যাহার কল্পনাও তিনি পূর্বে করিতে পারেন নাই।’ (যুগনায়ক বিবেকানন্দ, তৃতীয় খণ্ড— স্বামী গম্ভীরানন্দ)
বিবেকানন্দ-সহোদর ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতে, বাংলার প্রথম যুগের বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ স্বামীজির বৈপ্লবিক কর্মপ্রয়াস সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত ছিলেন।
ভূপেন্দ্রনাথের প্রবীণ সহযোগী বিপ্লব-সঙ্গী সখারাম গণেশ দেউস্করকে স্বামীজি বিভিন্ন সময় এ সম্বন্ধে যা বলেছিলেন, তা তিনি জানান ভূপেন্দ্রনাথকে। সখারামকে স্বামীজি এমনও বলেছিলেন, ‘The Country has become a power magazine. A little spark may ignji it.’
শ্রীঅরবিন্দ বলতেন, বিবেকানন্দ যেন এ দেশের ইতিহাসকে দু’হাতে ধরে বদলে দিয়েছেন।
ভূপেন্দ্রনাথের মতে, স্বামীজির অন্যতম শিষ্যা ভগিনী ক্রিস্টিনকে স্বামীজি বলেছিলেন যে, দেশীয় রাজন্যবর্গের সাহায্যে বৈপ্লবিক পথে তিনি বৈদেশিক শাসনকে উচ্ছেদ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই কারণেই তিনি হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত ভ্রমণ করেছেন এবং বন্দুক-নির্মাতা হিরাম ম্যাক্সিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু স্বামীজি দেখলেন যে, দেশ প্রস্তুত নয়— তাই তিনি জাতিগঠনের কাজে হাত দিলেন।’
বিপ্লবী দল গড়ার কাজে বিবেকানন্দ আর কী করেছিলেন, তা তিনি বলেছিলেন ভগিনী ক্রিস্টিনকে। কিন্তু মন্ত্রগুপ্তির জন্য ভগিনী ক্রিস্টিন তা বলেননি ভূপেন্দ্রনাথকে।
দেশীয় রাজন্যবর্গের সঙ্গে এক সময় ছিল স্বামীজির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। তাঁদের সঙ্গে বিপ্লব সংক্রান্ত যোগাযোগের সন্দেহের কারণেই সক্রিয় হয়ে ওঠে তৎকালীন ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ।
সন্ন্যাসী হয়েও রাজন্যবর্গের সঙ্গে স্বামীজির ঘনিষ্ঠতা বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে তিনি বলতেন, শাসক সম্প্রদায়ের মনে ‘প্রজারঞ্জনের বীজ’ উপ্ত করার জন্যই তিনি রাজদ্বারে ঘুরেছিলেন।
বিবেকানন্দের প্রেরণায় আত্মোৎসর্গে অগ্নিবজ্র বহু বিপ্লবী পরবর্তী সময়ে সান্নিধ্যে আসেন বিপ্লবী অরবিন্দের।
বাংলার প্রথম যুগের বিপ্লব-আন্দোলনের অগ্নিপুরুষদের কাছে স্বামীজি প্রতিভাত ছিলেন বিপ্লবীরূপেই। অরবিন্দের অভিমত ‘... সন্ন্যাসী হয়েও তিনি দেশের স্বাধীনতার কথা অবিরত চিন্তা করতেন।
এমনও বলা হয় যে, তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের কথাও ভাবতেন। ... প্রত্যক্ষভাবে যে কাজ নিজে করেননি, তাঁর শিষ্যাকে তিনি সে কাজের ভার দিয়ে যান।’
দেহান্তের কিছুদিন আগে অধ্যাপক কামাখ্যা মিত্রকে স্বামীজি বলেছিলেন ‘What India needs today is bomb.’
‘খাপ-খোলা তলোয়ার’ বিবেকানন্দের এই বিপ্লবী চরিত্র অজানা ছিল না শ্রীমা সারদা দেবীরও। স্বদেশি আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোয় স্নেহময়ী জননী বলেন, ‘ও বাবা, নরেন আমার আজ থাকলে কোম্পানি কি তাকে ছেড়ে দিত? জেলে পুরে রাখত।’
স্বামীজির সান্নিধ্যে অগ্নিতাপস সখারাম গণেশ দেউস্কর জন্মসূত্রে মারাঠি হলেও নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন। অরবিন্দের মামা ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসুর কাছে ছাত্রাবস্থায় সখারামের দেশপ্রেমের প্রথম পাঠ।
আবার বিপ্লবী বারীন ঘোষের স্বদেশপ্রেমের উন্মেষ সখারামের ছাত্র হওয়ার সুবাদে। আত্মকথায় বারীন্দ্রকুমার জানিয়েছেন, তাঁর বড়মামা যোগীন্দ্রনাথ বসুর মুখে ‘ইংরেজবিদ্বেষের কথা শুনে শুনে’ এবং ‘সখারামবাবুর প্রদত্ত শিক্ষার দ্বারা’ প্রস্তুত হয়েছিল তাঁর বিপ্লবী মননের ভিত।
অনেক বিপ্লবীর মতো তিনিও গুরুপদে বরণ করে নিয়েছেন সখারাম গণেশ দেউস্করকে। তাঁর বর্ণনায় বারীন্দ্রকুমার লিখছেন ‘নেষ্ঠিক ব্রাহ্মণ, মাথায় ছিল তাঁর বেশ মোটা একগোছা শিখা, ভুঁড়ির উপর থাকতো লম্বিত দুগ্ধশুভ্র উপবীত।’
কলকাতার ১০৮ নম্বর সার্কুলার রোডের বাড়িতে অনুশীলন সমিতির পাঠচর্চা কেন্দ্র— অনেকে বলতেন ভগিনী নিবেদিতার লাইব্রেরি। সেখানে নিয়মিত আসতেন সখারাম। অংশ নিতেন বিভিন্ন পাঠক্রমে।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর আসতেন অর্থনীতির ক্লাস নিতে। তাঁর অনুপস্থিতিতে ক্লাস নিতেন সখারাম। বারীন ঘোষ জানিয়েছেন, এই বিপ্লবকেন্দ্রটির সঙ্গে দেউস্করের যোগাযোগের মূলে ছিলেন তিনি।
বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাসের বক্তব্য অনুযায়ী, ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রের ‘পরম ভক্ত’ ছিলেন সখারাম। সেখানে প্রমথনাথ পড়াতে আসতেন ইতিহাস। আর সখারাম ক্লাস নিতেন অর্থনীতির। বিপ্লবতাপসদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বোঝাতেন ব্রিটিশ ভারতে অর্থনৈতিক শোষণের ইতিহাস।
এই ক্লাস নিতে গিয়ে তাঁর বক্তব্য ও ভাবনার পথ ধরে লিখতে থাকেন নিয়মিত, সৃষ্টি হয় অগ্নিযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘দেশের কথা’, প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে।
সখারাম তাঁর গ্রন্থে ডিগবি সাহেবকে উদ্ধৃত করে বলেন, ১৭৯৩ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত—১০৮ বছরে সারা পৃথিবীতে যুদ্ধবিগ্রহে পঞ্চাশ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যায়নি। অথচ এই সময়ে ভারতবর্ষে অনাহারে, দুর্ভিক্ষে মৃত্যু হয় তিন কোটি মানুষের। তিনি সুস্পষ্টভাবে জানান, কেবলমাত্র শস্যাভাব দুর্ভিক্ষের প্রকৃত কারণ নয়। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যেখানে জনসংখ্যার তুলনায় উৎপাদনযোগ্য জমির পরিমাণ অনেক কম, অথচ সেখানকার মানুষদের মরতে হয় না অনাহারে। ইংল্যান্ডের দৃষ্টান্ত টেনে সখারাম লেখেন, সেখানে চাষযোগ্য জমির যে পরিমাণ তাতে সেখানকার মানুষের পক্ষে বছরে ৯১ দিনের বেশি খাদ্যের সংস্থান করা সম্ভব নয়। অথচ সেখানকার মানুষ বছরে একদিনও অনাহারে দিন কাটান না। সেই সময় ভারতবর্ষ থেকে প্রতি বছর সাড়ে ষোলো কোটি টাকার ‘গোধূম-তণ্ডুলাদি’ জাহাজযোগে ‘ঐ সকল দেশে গমন করিয়া’ সেখানকার দেশীয় মানুষের আহারের সংস্থান করে, আর ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায় অনাহারে।
‘দেশের কথা’য় বিমুগ্ধ অরবিন্দ। তাঁর মতে— সখারামই ‘দেশের কথা’-য় সর্বপ্রথম ‘স্বরাজ’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। অরবিন্দের কথায়— এই বইটির মাধ্যমে এ দেশের যুবকরা বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিল।
বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র এবং ‘সাহিত্য’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সখারামকে অভিহিত করেছেন ‘দেশমাতৃকার একনিষ্ঠ সাধক’ বলে।
‘দেশের কথা’ গ্রন্থটির ছত্রে ছত্রে উন্মোচিত ইংরেজ-শোষণের নির্মম চিত্র, এ দেশ লুণ্ঠনের ভয়াল চিত্র— সেই সঙ্গে ধ্বনিত গভীর দেশাত্মবোধ— যা বাংলাদেশে অগ্নিযুগকে আবাহন করে।
সখারামের আর এক আরাধ্য আদর্শ-নায়ক লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক। তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে বহু বিপ্লবী তৈরির কর্মযজ্ঞের মাঝেও অনন্যসাধারণ নিষ্ঠায় সম্পূর্ণ করে যান তিলকের জীবনী গ্রন্থ।
১৯১০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইংরেজ সরকার নিষিদ্ধ করে ‘দেশের কথা’। দু-বছর পরে ১৯১২ সালের ২৩ নভেম্বর দেওঘরে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে অকস্মাৎ তিরোধান অগ্নিযুগের অগ্নিসাধক সংশপ্তক সখারাম গণেশ দেউস্করের।