কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
সঙ্গীতময় এই বিবাহ-অনুষ্ঠানটি সম্বন্ধে ‘আত্ম-চরিত’-এ রাজনারায়ণ বসু লেখেন— ‘বিবাহকার্য্য এত জাঁকজমকের সহিত সম্পন্ন হয় যে, দেবেন্দ্রবাবু পরে বলিয়াছিলেন যে— রাজারাজড়ার বিবাহে এমন হয় না।’
অরবিন্দের পিতামহ কালীপ্রসাদ ঘোষ সরকারি চাকরি করতেন উচ্চপদে। পিতার মৃত্যুর সময় কৃষ্ণধন বারো বছরের কিশোর। কৃষ্ণধনের মা শেষ বয়সে চলে যান কাশী। অরবিন্দের মাতৃভক্ত পিতা বছরে দু’বার কাশী যেতেন মাকে দেখতে।
বারীন্দ্রকুমার ঘোষ জানিয়েছেন, ‘আমাদের পৈতৃক বাস কোন্নগরে। সে ভিটা শুনছি এখনও আছে, তবে আমি কখনও চোখে দেখিনি। আমার ঠাকুরদার মৃত্যুর পরে বাবা ও কাকা নিজের নিজের কর্ম্মক্ষেত্রে চলে গেলে ঠাকুরমা কাশীবাস করেন,— সেই থেকে কোন্নগরের বাস আমাদের উঠলো।’
ডাঃ কৃষ্ণধন বিলেত থেকে ফিরে আসার পর কোন্নগরের কট্টর হিন্দু সমাজ বিধান দেন প্রায়শ্চিত্ত করবার। মেধাবী ও নবীন চিকিৎসক সে বিধান উপেক্ষা করে চলে যান কোন্নগর ছেড়ে। ডাক্তারি পাশের পর কৃষ্ণধন উচ্চশিক্ষার জন্য স্ত্রী ও দুই পুত্রকে নিয়ে ইংল্যান্ড যান ১৮৬৯ সালে। দু’বছর পরে এমডি করে দেশে ফেরেন পুরোদস্তুর সাহেব হয়ে।
ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষ ছিলেন ডাঃ কৃষ্ণধনের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। দুই অন্তরঙ্গ সুহৃদের স্ত্রীর একই নাম স্বর্ণলতা, দুই সখী— ‘গোলাপ’ পাতানো সই। অরবিন্দের জন্ম ১৮৭২ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতায় পিতৃবন্ধু ব্যারিস্টার মনোমোহন ঘোষের ৮ নং থিয়েটার রোডের বাড়িতে।
তাঁর শৈশব কাটে রংপুর ও খুলনায়— পিতা তখন সিভিল সার্জেন। ডাঃ কৃষ্ণধন ছিলেন ইঙ্গবঙ্গ সমাজের ভিন্নতর জীবনযাপনে অভ্যস্ত। অরবিন্দ-জননী পরমাসুন্দরী স্বর্ণলতা দেবীকে রংপুরের অধিবাসীরা নাম দিয়েছিলেন ‘রংপুরের গোলাপ’। প্রতীচ্য জীবনধারায় আবিষ্ট ডাঃ কৃষ্ণধন, পত্নী স্বর্ণলতা পরতেন গাউন, কখনও ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন শহরের এক প্রান্ত হতে আর এক প্রান্তে।
আসলে কৃষ্ণধনের ছিল দ্বৈতসত্তা। একদিকে সাহেবিয়ানা-প্রীতি, অন্যদিকে সহায়সম্বলহীন মানুষের সেবক। নিঃসহায় রোগীদের কাছ থেকে ‘ভিজিট’ নেওয়া তো দূরের কথা, নিজের পকেট থেকে দিতেন ওষুধ-পথ্যের টাকা। তিনি যখনই কোনও শহর থেকে বদলি হতেন, শোনা যেত সেখানকার নিঃসম্বল বেদনার্ত মানুষের আর্তরব।
‘নারায়ণ’ পত্রিকায় মহামহোপাধ্যায় যাদবেশ্বর তর্করত্ন লেখেন ‘পূর্ণবাবু (বঙ্কিমচন্দ্রের সর্বকনিষ্ঠ সহোদর) কিছুদিন রঙ্গপুরে ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। সে-সময়ে ডাক্তার কে.ডি ঘোষ (কৃষ্ণধন ঘোষ) রঙ্গপুরের সর্ব্বেসের্ব্বা। তিনি ছিলেন, ইংরেজ-বাঙ্গালীর সুয়েজ যোজক। তাঁহার বাড়িটি ছিল ইংরেজ-বাঙ্গালীর সম্মিলনক্ষেত্র। প্রত্যহ তাঁহার বাড়ীতে বাঙ্গালীদের একটি বিশেষ আড্ডা বসিত।’
পিতার স্মৃতিচারণায় বারীন ঘোষ ‘আমার আত্মকথা’য় জানিয়েছেন— ‘বাবার চেহারা এখনও আমার মনে আছে। শ্যামবর্ণ, বড় বড় ভাসা চোখ, মাইকেল মধুসূদনের মত মুখাকৃতি, নাতিদীর্ঘ ঋজু দৃঢ়পেশী শরীর, নতুন গুড়ের মত মিষ্টি স্বভাব, সদাপ্রসন্ন মূর্তি, অথচ একরোখা শক্তিমান পুরুষ। ডাক্তারীতে তাঁর যশ ছিল প্রচুর, ঠাকুর দেবতার কাছে মানতের মত রোগী তাঁর কাছে এসে জীবন ও পরমায়ু ভিক্ষা করতো। টাকা তিনি উপার্জ্জন করতেন প্রচুর আর ব্যয়ও করতেন অপরিমিতভাবে। তাঁর দয়া ও মমতার কাহিনী খুলনায় এখনও কিংবদন্তির মত মানুষের মুখে মুখে রয়েছে। নারীর মত কোমল প্রাণ ও প্রেমপ্রবণ চিত্ত নিয়ে এই শক্তিধর মানুষটি সংসারের সুখের নীড় বাঁধতে এসেই আঘাত পেলেন নিদারুণ— কোথা থেকে ক্রূর বাজের মত উন্মাদ ব্যাধি এসে তাঁর অন্তরের মানুষ জীবনের সঙ্গিনীটিকে দিলে ক্ষেপিয়ে। প্রেমের একটা অকূল সাগর বুকে করে যে মানুষ মমতাময় প্রাণ নিয়ে জগতে এসেছে, তার একমাত্র ভালবাসার বস্তুকে কেড়ে নিলে সে যদি পথভ্রষ্ট হয় তা হলে তার দোষ দেওয়া চলে কি?’
রংপুরের গোলাপ, রূপসী ও অসামান্য প্রতিভাবতী স্বর্ণলতা দেবী গভীর অবসাদ থেকে একসময় মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
আসলে পাগল ও প্রতিভাবানে তো সামান্য হেরফের, প্রায়ই দেখা যায় সহাবস্থান, গলাগলি করে চলা।
মায়ের জন্য অরবিন্দের গভীর ভালোবাসার টান। বরোদায় আসার পর বেতন পেলে সবার আগে মানিঅর্ডার করে টাকা পাঠাতেন মাকে। তাঁর অনেক আশ্চর্য সব ব্যাপারস্যাপারে বিস্মিত ও বিমুগ্ধ দীনেন্দ্রকুমার রায়কে এক এক সময় অরবিন্দ হেসে বলতেন, ‘আমি পাগল মায়ের পাগ্লা ছেলে!’
১৯৩৯ সালের ৯ ডিসেম্বর সংখ্যা ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায় লেখা হয়— ‘কয়েকটি সন্তানের পর পর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে অরবিন্দের মা, স্বর্ণলতাতে হিস্টিরিয়া ও কিছু-কিছু উন্মাদ রোগের চিহ্ন দেখা যায়। ... প্রতিভাবান রাজনারায়ণের বংশে কিছু উন্মাদ রোগের বীজ ছিল।’অনেকের কিছুটা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, স্বর্ণলতা দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান বারীন্দ্রকুমারের জন্ম সমুদ্রবক্ষে। ইংল্যান্ডে জাহাজ পৌঁছবার পূর্বে।
এ সম্বন্ধে বারীন ঘোষ স্বয়ং আত্মকথায় লিখেছেন— ‘আমাকে গর্ভে নিয়ে বিলাতে পৌঁছিয়া সেখানে (Crystal Palace) মর্ম্মর প্রাসাদের সামনে লণ্ডন-উপকণ্ঠে নরউডে (Norwood) আমার জন্ম। প্রায় সমুদ্রগর্ভে জন্ম বলে নাম হোলো বারীন্দ্রকুমার। ... মায়ের ডাক্তারের নাম ছিল ম্যাথিউ। আর ক্রাইষ্টের জন্মের পরেই ৫ই জানুয়ারী আমার জন্ম বলে পাগলী মা আমার এক উদ্ভট বাইবেলী নাম রাখলেন ইম্যানিউয়েল ম্যাথিউ ঘোষ।...
সেজদার নাম যে হয়েছিল অরবিন্দ এক্রয়েড ঘোষ সেই এক্রয়েড (Akroyd) পরিবার এই ড্রুইডের আত্মীয় ও তাঁরাও বাবার পরম বন্ধু ছিলেন।’
অরবিন্দ-সহোদরা সরোজিনী ঘোষ জানিয়েছেন— ‘বাবা ও মার সঙ্গে Miss Akroyd-এর খুব ভাব ছিল।’
‘কুমারী এক্রয়েড হইতেই বঙ্গনারীর উচ্চশিক্ষার প্রথম আয়োজন’ লিখেছেন শিবনাথ শাস্ত্রী ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে। অরবিন্দের মাতামহ রাজনারায়ণ বসুর ‘আত্মচরিত’-এ রয়েছে, তাঁর ও কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে মিস এক্রয়েডের ঝগড়ার এক মজার বিবরণ।
‘Miss Akroyd-এর সঙ্গে আমাদিগের সামাজিক অনেক বিষয়ে কথোপকথন হইতে লাগিল। আমি বলিলাম— যদি আমরা ইংলণ্ড জয় করিয়া তথাকার লোক দ্বারা আমাদিগের রীতিনীতি অনুকরণকার্য্যে আমরা উৎসাহ প্রদান করিতাম তাহা হইলে আপনারা কি পছন্দ করিতেন? তিনি বলেন— না। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম— কোন সাহেব যদি ধুতি পরিয়া লণ্ডনের রাস্তায় বেড়ান তাহা হইলে আপনারা তাঁহাকে কি করেন? Miss Akroyd তাহাতে উত্তর করিলেন— We instantly clap him to Bedlam, অর্থাৎ আমরা তাহাকে পাগলাগারদে দিই। তাহাতে আমি বলিলাম— আপনারা যেমন ঐ কার্য্য ঘৃণা করেন, আমরাও সেইরূপ বিলাতফেরৎ বাঙ্গালী দ্বারা ইংরেজ পরিচ্ছদ ব্যবহারে সেইরূপ ঘৃণা করি।... তিনি এইরূপ আমার সকল কথা মানিয়া যাইতেছিলেন, কিন্তু ভিতরে ভিতরে রাগিতেছিলেন, তাহা আমি বুঝিতে পারি নাই। তাহার পর আমার দুর্ভাগ্যক্রমে আমি বলিলাম— You consider English manners to be perfect? এই কথা বলাতেই তিনি টেবিল চাপড়াইতে লাগিলেন, গৃহের মেজেতে পদাঘাত করিতে লাগিলেন, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তাহার চক্ষু হইতে বিনির্গত হইতে লাগিল। আমার আশঙ্কা হইতে লাগিল আমাকে বা প্রহার করেন। আমি কম্পিতকলেবর হইয়া বলিলাম— I beg to be excused madam, I didn’t mean anything wrong.
...Miss Akroyd কোপন স্বভাবা স্ত্রীলোক। কেশববাবু একবার তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান। তাহাতে তর্ক উপস্থিত হইয়া দুইজনে রাগারাগি হয়। কেশববাবু বাড়ী ফিরিয়া আসিবার সময় সিঁড়িতে নামিতেছিলেন এমন সময় Miss Akroyd সিঁড়ি পর্য্যন্ত আসিয়া পুনরায় তাঁহার সহিত আর একবার ঝগড়া করিয়া গেলেন।’ কৃষ্ণধন ঘোষ যখন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সেই সময় তাঁর বিবাহ হয় স্বর্ণলতা দেবীর সঙ্গে। রাজনারায়ণ বসুর বড় মেয়ে স্বর্ণলতা।
চিকিৎসা-বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠতে বিলেত যাওয়ার সময় তাঁকে আশীর্বাদ করে রাজনারায়ণ লেখেন চারটি ইংরেজি সনেট। তাঁর লেখা ‘ধর্ম্মতত্ত্ব দীপিকা’ গ্রন্থখানি জামাতাকে উৎসর্গ করে উৎসর্গপত্রে আশা ব্যক্ত করেন, তিনি যেন ধর্ম্মোপদেশ দ্বারা লোকের আধ্যাত্মিক রোগ নিবারণ করেন। কিন্তু অরবিন্দের পিতা তখন ঈশ্বরে বিশ্বাস হারান। ‘সংশয়বাদিতা তাঁহার মনে প্রবেশ করিয়াছে।’ শ্রীঅরবিন্দ স্বয়ং বলেছেন যে, তিনিও এককালে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন ‘সংশয়বাদে’।
ডাঃ কৃষ্ণধন দু’বছর পর বিলেত থেকে ফিরে আসেন সাহেব বেশে। ‘আত্মচরিত’-এ রাজনারায়ণ বসু লিখলেন, ‘১৮৭১ সালের শেষে আমার জ্যেষ্ঠ জামাতা বিলাত হইতে ফিরিয়া আসেন। আমি আমার ইংরাজীতে লিখিত চতুর্দ্দশপদী কবিতাতে এমন আশা প্রকাশ করিয়াছিলাম যে, তিনি বোধহয় বিলাতে অবস্থিতি নিবন্ধন দেশীয় ভাব হারাইবেন না। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিলাত হইতে তিনি সম্পূর্ণ ইংরাজ হইয়া ফিরিয়া আসিলেন। বিলাত যাইবার পূর্বে তিনি একজন নিষ্ঠাবান উৎসাহী ব্রাহ্ম ছিলেন, বিলাত হইতে আসিবার পর তাঁহার বিপর্য্যয় দেখিলাম। দেখিলাম সংশয়বাদিতা তাঁহার মনে কিয়ৎপরিমাণে প্রবেশ করিয়াছে। ধর্ম্মতত্ত্ব-দীপিকা তাঁহাকে আমি উৎসর্গ করি, সে উৎসর্গপত্রে এমন আশা প্রকাশ করিয়াছিলাম যে— তিনি ডাক্তার স্বরূপে যেরূপ লোকের শারীরিক রোগ দূর করিবেন, সেইরূপ ধর্ম্মোপদেশ দ্বারা লোকের আধ্যাত্মিক রোগ নিবারণ করিবেন। আমার আশা বিফল হওয়াতে আমি মর্ম্মাহত আছি। ...তাঁহার অনেক অসাধারণ গুণ আছে, তিনি যারপরনাই ভদ্র, অমায়িক ও পরোপকারী। বিলাতে অবস্থিতির জন্য এই সকল গুণ তিনি হারান নাই। তাঁহার মন অতিশয় মধুর। সেই মাধুর্য্য তাঁহার মুখশ্রীতে প্রতিফলিত হইয়াছে। আমি যখন কানপুরে ছিলাম তথাকার ইংরাজী পল্টনের পাদরী Rev. Mill সাহেব আমাকে বলিয়াছিলেন, I have never seen such a sweet face as his.’
স্বর্ণলতার পিতা বা অরবিন্দের মাতামহ ঋষি রাজনারায়ণ বসু ছিলেন সেকালের অন্যতম মহান সমাজ সংস্কারক। কর্মজীবন আরম্ভ হয় তত্ত্ববোধিনী সভায় উপনিষদের ইংরেজি অনুবাদক হিসেবে। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের লোভনীয় চাকরি উপেক্ষা করে তিনি বেছে নেন মেদিনীপুরে শিক্ষকতার কাজ। সেখানে স্থাপন করেন নৈশ বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয়, পাঠাগার। তিনি রচনা করেন ‘আত্মচরিত’, ‘সেকাল আর একাল’, ‘হিন্দু বা প্রেসিডেন্সী কলেজের ইতিবৃত্ত’, ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা’ প্রভৃতি গ্রন্থ। ইংরেজিতেও লেখেন ধর্মবিষয়ক কয়েকখানি বই। জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে রাজনারায়ণের ছিল ঘনিষ্ঠ যোগ। ‘জীবনস্মৃতি’তে তাঁর সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লেখেন—
‘ছেলেবেলায় রাজনারায়ণবাবুর সঙ্গে যখন আমাদের পরিচয় ছিল তখন সকল দিক হইতে তাঁহাকে বুঝিবার শক্তি আমাদের ছিল না। তাঁহার মধ্যে নানা বৈপরীত্যের সমাবেশ ঘটিয়াছিল। তখনই তাঁহার চুলদাড়ি প্রায় সম্পূর্ণ পাকিয়াছে কিন্তু আমাদের দলের মধ্যে বয়সে সকলের চেয়ে যে ব্যক্তি ছোটো তাহার সঙ্গেও তাঁহার বয়সের কোনো অনৈক্য ছিল না। তাঁহার বাহিরের প্রবীণতা শুভ্র মোড়কটির মতো হইয়া তাঁহার অন্তরের নবীনতাকে চিরদিন তাজা করিয়া রাখিয়া দিয়াছিল। এমন-কি, প্রচুর পাণ্ডিত্যও তাঁহার কোনো ক্ষতি করিতে পারে নাই, তিনি একেবারেই সহজ মানুষটির মতোই ছিলেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত অজস্র হাস্যোচ্ছ্বাস কোনো বাধাই মানিল না— না বয়সের গাম্ভীর্য, না অস্বাস্থ্য, না সংসারের দুঃখকষ্ট, ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন, কিছুতেই তাঁহার হাসির বেগকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারে নাই।’
রাজনারায়ণের প্রাণখোলা হাস্যোচ্ছ্বাসের অনুষঙ্গে এসে পড়ে কবির ভাবুক ও দার্শনিক বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সুগভীর হৃদ্যতা ও হাস্যরসের অনুপম চিত্র। বরোদায় আসার পর অরবিন্দ প্রায় প্রতি বছর পুজোর ছুটিতে কলকাতা ও দেওঘর গিয়ে কাটিয়ে আসতেন কিছুদিন। দেওঘরে নিভৃতে নানা বিষয়ে কথা হতো দুই নক্ষত্রপুরুষ মাতামহ ও দৌহিত্রের। ১৮৯৮-এর অক্টোবরে তাঁদের শেষ দেখা। অরবিন্দের সঙ্গে গিয়েছিলেন দীনেন্দ্রকুমার রায়। ১৮৯৯-এর সেপ্টেম্বরে যখন দেওঘরে রাজনারায়ণ বসুর তিরোধান— তখন অরবিন্দ ছিলেন বরোদায়। রাজনারায়ণের বিদায়ের কিছুকাল পরে অরবিন্দের সঙ্গে ফের দেওঘর গিয়েছিলেন দীনেন্দ্রকুমার। তিনি লিখছেন—
‘সেই তাঁহার (রাজনারায়ণ বসু) সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ— প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ। তাহার পরও বরোদা যাইবার সময় প্রত্যেকবারই অরবিন্দের সঙ্গে দেওঘর দিয়া গিয়াছি; কিন্তু রাজনারায়ণবাবুর গৃহে উপস্থিত হইয়া তেমন সুখ আর কখনও পাই নাই। দেবগৃহের দেবতা মন্দির শূন্য করিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন, শূন্য মন্দিরের আর কোনও আকর্ষণ ছিল না; কেবল তাঁহার পবিত্র স্মৃতি পুষ্পগন্ধের ন্যায় সেই পবিত্র ভবন তখনও আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছিল। যোগীনবাবুকে কথা প্রসঙ্গে বলিয়াছিলাম, আপনার বাবা খুব হাসিতে পারেন, এমন প্রাণ খুলিয়া আর কাহাকেও হাসিতে দেখি নাই; এই দারুণ রোগ-যন্ত্রণা সহ্য করিয়াও এত হাসি। আমার কথা শুনিয়া যোগীনবাবু বলিয়াছিলেন, এত কি হাসি দেখিলেন, বাবা যখন দ্বিজেন্দ্রবাবুর (রাজনারায়ণবাবুর পরম বন্ধু শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর) সঙ্গে গল্প করেন, আর দুই বন্ধুতে হাসিতে থাকেন, তখন মনে হয় বাড়ীর ছাদটা হাসির তরঙ্গে ভাসিয়া যাইবে।’ বিধবাবিবাহ, স্ত্রীশিক্ষা প্রচার প্রভৃতি সেকালের বহু প্রগতিশীল আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন রাজনারায়ণ বসু। স্বামী বিবেকানন্দের অত্যন্ত প্রিয় গ্রন্থ মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যের প্রথম রসবোদ্ধা সমঝদার ও সার্থক সমালোচক ভাষ্যকার তিনি। রাজনারায়ণ ও মধুসূদনের মধ্যে পরস্পর লিখিত পত্রাবলী বাংলার অন্যতম সাহিত্য সম্পদ। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলনের কথা বলতেন তিনি। রাজনারায়ণ মনে করতেন, ‘ইংরেজি শিক্ষার দ্বারা অতি শুভ ফল উৎপন্ন হইয়াছে।’ আবার এই মহান দেশপ্রেমিকই বলতেন— ‘ক্রীতদাসের ন্যায় অন্য জাতির অনুকরণ করিলে আভ্যন্তরিক বীর্যের হানি হয় এবং কোন মতেই স্বীয় মহত্ত্ব সাধন হইতে পারে না।’
বিমুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্বন্ধে বলেন— ‘একদিকে তিনি আপনার জীবন এবং সংসারটিকে ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণ নিবেদন করিয়া দিয়াছিলেন, আর একদিকে দেশের উন্নতিসাধন করিবার জন্য তিনি সর্বদাই কত রকম সাধ্য ও অসাধ্য প্ল্যান করিতেন তাহার আর অন্ত নাই। রিচার্ডসনের তিনি প্রিয় ছাত্র, ইংরেজি বিদ্যাতেই বাল্যকাল হইতে তিনি মানুষ কিন্তু তবু অনভ্যাসের সমস্ত বাধা ঠেলিয়া ফেলিয়া বাংলাভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে পূর্ণ উৎসাহ ও শ্রদ্ধার বেগে তিনি প্রবেশ করিয়াছিলেন। এদিকে তিনি মাটির মানুষ কিন্তু তেজে একেবারে পরিপূর্ণ ছিলেন। দেশের প্রতি তাঁহার যে প্রবল অনুরাগ সে তাঁহার সেই তেজের জিনিস। দেশের সমস্ত খর্বতা দীনতা অপমানকে তিনি দগ্ধ করিয়া ফেলিতে চাহিতেন। তাঁহার দুই চক্ষু জ্বলিতে থাকিত, তাঁহার হৃদয় দীপ্ত হইয়া উঠিত, উৎসাহের সঙ্গে হাত নাড়িয়া আমাদের সঙ্গে মিলিয়া তিনি গান ধরিতেন— গলায় সুর লাগুক আর না লাগুক সে তিনি খেয়ালই করিতেন না—
‘এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন
এক কার্যে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন।’