কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
দীনেন্দ্রকুমার তাঁর স্মৃতিচারণায় আরও জানিয়েছেন— ‘দু-একদিনের ব্যবহারেই বুঝিলাম, অরবিন্দের হৃদয়ে পৃথিবীর হীনতা ও কুলষতা নাই। তাঁহার হাসি শিশুর হাসির মতো সরল, তরল ও সুকোমল। হৃদয়ের অটল সঙ্কল্প ওষ্ঠপ্রান্তে আত্মপ্রকাশ করিলেও মানবের দুঃখে আত্মবিসর্জনের দেবদুর্লভ আকাঙ্ক্ষা ভিন্ন সে হৃদয়ে পার্থিব উচ্চাভিলাষের বা মনুষ্যসুলভ স্বার্থপরতার লেশমাত্র নাই।
অরবিন্দ তখনও বাংলায় কথা বলিতে পারিতেন না; কিন্তু মাতৃভাষায় কথা কহিবার জন্য তাঁহার কী প্রগাঢ় ব্যাকুলতা! দিবারাত্রি একত্র বাস করিয়া ক্রমে যতই অরবিন্দের হৃদয়ের পরিচয় পাইতে লাগিলাম, ততই বুঝিতে পারিলাম, অরবিন্দ এ পৃথিবীর মানুষ নহেন; অরবিন্দ শাপভ্রষ্ট দেবতা। ভগবান কি ভাবিয়া তাঁহাকে বাঙালী করিয়া অভিশপ্ত ভারতে নির্বাসিত করিয়াছিলেন তা তিনিই বলিতে পারেন।’
১৮৯৪-এর ৮ এপ্রিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তিরোধান। বরোদায় অরবিন্দ লিখলেন ‘SARASWATI WITH THE LOTUS’ শীর্ষক এক অনবদ্য ইংরেজি সনেট। তাঁর স্মরণে কিছুদিন পরে লিখলেন আর একটি কবিতা ‘The sweetest voice that ever spoke in prose.’
অরবিন্দ বলতেন, ‘বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের অতীত ও বর্তমানের ব্যবধানের উপর সুবর্ণ সেতু।’ সে বছর ১৬ জুলাই থেকে ২৭ আগস্ট এই মাস দেড়েকের মধ্যে তিনি বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে লিখলেন সাতটি মূল্যবান নিবন্ধ। উত্তরকালে তাঁকে আখ্যায়িত করেন ‘ঋষি’ অভিধায়।
প্রমোদকুমার সেনের অভিমত— ‘বঙ্কিম সম্বন্ধে তাঁহার সুবিদিত ইংরাজি প্রবন্ধ বঙ্কিমকে যথার্থ অমর করিয়াছে। শ্রীঅরবিন্দ কি তখন বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, বঙ্কিমের ‘বন্দে মাতরম’ মন্ত্র কয়েক বৎসরের মধ্যে জাতিকে জাগাইবে— কোন এক শুভ মুহূর্তে, বিশেষ কাহারও নির্দেশ বিনা জাতি এই প্রাণপ্রদ মন্ত্র গ্রহণ করিবে? বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’কে শ্রীঅরবিন্দ ও তাঁহার অনুচরবর্গই বাস্তব রূপ দিবার চেষ্টা করেন। এককালে ‘আনন্দমঠ’-এর অনুরূপ ‘ভবানী মঠ’ গঠনেরও প্রচেষ্টা হইয়াছিল।’
বিস্ময়ের বিষয়, দীনেন্দ্রকুমার রায়ের কাছে বাংলা শেখা শুরুর প্রায় সাড়ে তিন বছর পূর্বে অরবিন্দ কীভাবে ‘ইন্দুপ্রকাশ’ লিখলেন বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে অমন কালজয়ী সাতটি নিবন্ধ।
গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী, এ প্রশ্ন শুধিয়েছিলেন অরবিন্দের ছোটবোন সরোজিনী ঘোষকে। গিরিজাশঙ্কর লিখেছেন— ‘অরবিন্দের ভগিনী শ্রীযুক্তা সরোজিনী ঘোষ আমাদিগকে বলিয়াছেন যে অরবিন্দ I.C.S পরীক্ষায় বাঙ্গালা ভাষা নিয়াছিলেন এবং বঙ্কিম তাঁহার পাঠ্য ছিল। সুতরাং বাঙ্গালা ভাষাতেই তিনি বঙ্কিমের উপন্যাস কেম্ব্রিজে থাকাকালীন পাঠ করিয়াছিলেন। বাঙ্গালা বলিতে না পারিলেও তিনি উহা পড়িতে ও বুঝিতে পারিতেন।’
বরোদায় অরবিন্দের সঙ্গে এক ঘরে দু-বছর কাটিয়েছেন দীনেন্দ্রকুমার রায়। তাঁর কথায়, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস অরবিন্দ নিজেই পড়িতেন, বেশ বুঝিতে পারিতেন। কথোপকথনের ভাষা ভালো বুঝিতে পারিতেন না।’
অরবিন্দ তাঁর বাংলা শিক্ষক দীনেন্দ্রকুমার রায়কে বরোদায় নিয়ে আসার সময় জীবিত ছিলেন মাতামহ খ্যাতনামা রাজনারায়ণ বসু। ১৮৯৮-এর অক্টোবরে পুজোর ছুটিতে তিনি বরোদা থেকে গিয়েছিলেন মাতুলালয় দেওঘরে। সেখান থেকে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে আসেন ৬ নং কলেজ স্কোয়ারে তাঁর ন-মেসো কৃষ্ণকুমার মিত্রের বাড়িতে।
এখানে স্মর্তব্য, অরবিন্দের ন-মাসি লীলা দেবীর সঙ্গে কৃষ্ণকুমার মিত্রের বিবাহ অনুষ্ঠানটি বিশেষ কারণে বাঙালি ইতিহাসের একটি স্মরণীয় ঘটনা।
১৮৮১ সালের ২৯ জুলাই, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে আড়ম্বরপূর্ণ সেই বিবাহসভায় একসঙ্গে গান গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও নরেন্দ্রনাথ— ভাবীকালের স্বামী বিবেকানন্দ।
মেঘমন্ত্রের মতো গভীর গম্ভীর জোয়ারি কণ্ঠস্বরের অধিকারী বিবেকানন্দ। তাঁর এই কণ্ঠ সম্পদের গুণে বা বিভিন্ন ব্রাহ্ম উপাসনালয়ে সঙ্গীত পরিবেশনে সুগায়কের স্বীকৃতির কারণে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন আদি ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম অগ্রনায়ক রাজনারায়ণ বসুর চতুর্থ কন্যা লীলা দেবীর সঙ্গে ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার ভাবী প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণকুমার মিত্রের বিয়েতে সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের এই বিয়ের অনুষ্ঠানটি সর্বাঙ্গসুন্দর করতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। তিনি কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথকে নির্দেশ দেন বিবাহমঙ্গল গীত রচনা ও সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব নিতে।
রবীন্দ্রনাথ এ উপলক্ষে তিনখানি ধ্রুপদাঙ্গ সঙ্গীত রচনা করেন এবং বিবেকানন্দসহ অন্যান্যদের শেখান। গান তিনখানি—
১। দুই হৃদয়ের নদী (সাহানা, ঝাঁপতাল)
২। জগতের পুরোহিত তুমি (খাম্বাজ, একতাল)
৩। শুভদিনে এসেছ দোঁহে (বেহাগ, তেতাল)
এই সঙ্গীতানুষ্ঠানের সঙ্গীত মহড়ায় একসঙ্গে অংশ নিতেন রবীন্দ্রনাথ ও নরেন্দ্রনাথ। শোনা যায়, মহড়ার সময় রবীন্দ্রনাথ অর্গান বাজাতেন, নরেন্দ্রনাথ বসতেন পাখোয়াজ নিয়ে। সে এক বিরল মুহূর্ত, অপূর্ব দৃশ্য। দুই হৃদয়ের নদী একত্রে মিলিত।
রবীন্দ্র-বিবেকানন্দের সঙ্গীত মুখরিত এই অবিস্মরণীয় বিবাহ-বাসরে অবশ্য অরবিন্দ উপস্থিত ছিলেন না। ন-বছরের অরবিন্দ তখন ইংল্যান্ডে, সম্ভবত ম্যাঞ্চেস্টার, গ্রামার স্কুলে ভর্তির পূর্বে Mr. Druette-এর কাছে লাতিন ও Mrs Druette-এর কাছে ইংরেজির পাঠ নিচ্ছেন।
পরবর্তী সময়ে অরবিন্দ-অনুজ বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ‘আমার আত্মকথা’র গৌরচন্দ্রিকায় ন-মেসো কৃষ্ণকুমার মিত্রের অবতারণা করেছেন সম্পূর্ণ ভিন্নতর প্রেক্ষাপটে। বারীন্দ্রকুমার লেখেন—
‘যখন বিজলীতে ‘বোমার যুগের কথা’ বের হতে আরম্ভ হল তখন ভারতে প্রিন্স অব ওয়েলস্ আসছেন, অশান্ত ভারতকে রাজপুত্র দেখিয়ে শান্ত করবার বিরাট আয়োজন চলছে। সার সুরেন্দ্রনাথ সঞ্জীবনী সম্পাদক শ্রীকৃষ্ণকুমার মিত্রের দ্বারা আমায় ডেকে পাঠিয়ে অনুরোধ করেন ‘বোমার কথা’ বন্ধ রাখতে যে পর্যন্ত রাজপুত্র বহাল তবিয়তে বাপ মায়ের কোলে ফিরে না যান। আমি বিজলীর পাঠকদের এমনভাবে প্রতিশ্রুতি দেবার পর বন্ধ রাখতে নারাজ হওয়ায় চতুরচূড়ামণি সুরেন্দ্রনাথ আমায় রোনাল্ডসে সাহেবের শরণাপন্ন হতে উপদেশ দিলেন এবং খুব সম্ভব ভিতরে ভিতরে কলকাটিটিও টিপে রাখলেন। আমি ডাক পেয়ে একদিন লাটভবনে গিয়ে উপস্থিত হই। বাহিরে অপেক্ষা করবার সময় দেখি সার সুরেন্দ্রনাথ কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রোনাল্ডসে সাহেবের ঘরে আমার ডাক পড়বার পরই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন স্টেটসম্যানের সম্পাদক জোন্স সাহেব। আমি এই অনুরোধের বিরুদ্ধে রোনাল্ডসে সাহেবকে জানাই; বলি, যে, পাঠকদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখন আর ওটা বন্ধ করা যায় না। লাট সাহেব হেসে বলেন— ‘গভর্নমেন্ট আপনাকে বন্ধ করতে বাধ্য করছেন না, অনুরোধ করছেন মাত্র।’ অগত্যা ‘বোমার কথা’ বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশে বোমার সূত্রপাত ও চণ্ডলীলা আবার হওয়ায় আর তা এ পর্যন্ত বের হয়নি।’
বরোদায় অরবিন্দের সঙ্গে পরিচয় এক আশ্চর্য ব্যক্তির। বিরল প্রতিভাবান চিত্রকর শশীকুমার হেশ। এই আলাপ-পরিচয়ের অন্তরালে অরবিন্দের ন-মেসোমহাশয় কৃষ্ণকুমার মিত্রের সম্ভবত ছিল একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। শশীকুমার ইউরোপে থাকতে কৃষ্ণকুমারের ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে লিখতেন বিলাতের পত্র।
বরোদায় চমৎকার সম্পর্ক গড়ে ওঠে অরবিন্দের ছায়াসঙ্গী দীনেন্দ্রকুমার রায়ের সঙ্গেও। তাঁর মতে, শশীকুমার ফরাসি ও ইতালীয় সাহিত্যে সুপণ্ডিত হলেও ইংরেজি ভালো জানতেন না। তাঁদের সঙ্গে গল্প করার সময় ইংরেজি বলতেন থেমে থেমে।
অরবিন্দ তাঁকে বলেছিলেন— শশীকুমার চিত্রকর, এ পরিচয় না পেলেও তাঁকে দেখেই আমি বলতে পারতাম এ যুবক চিত্রকর। তাঁর চেহারায় রয়েছে এক বিশেষ অসাধারণত্ব। প্রথম দর্শনে সাহেবি পোশাকে শশীকুমারকে আমি বাঙালি বলে বুঝতে পারিনি। এমন গৌরবর্ণ বাঙালির ভিতর খুব একটা দেখা যায় না। শশীকুমারকে দেখে ইতালিয়ান বলে মনে হয়। তাঁর গোঁফদাড়িও একটু কটা।
শশীকুমার তাঁর জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনি শোনাতেন অরবিন্দকে। তাঁর অনেক ব্যাপার অরবিন্দ অনুমোদন বা সমর্থন করতেন না— তবু তাঁর কাছে সব বলে যেন স্বস্তি পেতেন শশীকুমার।
চিত্রকলা শেখার জন্য তিনি বহুদিন ছিলেন ফ্লোরেন্স, প্যারিস ও মিউনিকে। প্যারিসে প্রেমে পড়েন এক ফ্রেঞ্চ সুন্দরীর। নাম তাঁর মিস ফ্লামা। কলকাতায় এসে মিস ফ্লামাকে বিয়ের আয়োজন করেন।
কিন্তু কেউ স্বীকৃতি দিতে চায়নি তাঁদের বিবাহের। শশীকুমার হেশ ছিলেন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজভুক্ত ব্রাহ্ম। ‘অজ্ঞাতকুলশীলা’ ফ্রেঞ্চ এক মেয়ের সঙ্গে তাঁর ব্রাহ্ম মতে বিবাহ মেনে নিতে পারেননি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অনেকে। সমস্যা সমাধানে অবশেষে আসরে নামেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র। তাঁর বলিষ্ঠ উদ্যোগ ও দৃঢ়তায় নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হয় শশীকুমার-ফ্লামার বিয়ে।
চিত্রকর শশীকুমার হেশ প্রণয়িনীর সঙ্গে প্রাণের কথা কইতেন ফ্রেঞ্চ ভাষায়— কেন না ফ্লামা ইংরেজি বা বাংলা জানতেন না কোনওটাই।
দীনেন্দ্রকুমার রায় প্রায় প্রতি বিকেলেই যেতেন শশীকুমারের গেস্ট হাউসে। এক একদিন গল্প করতেন অনেক রাত পর্যন্ত। অরবিন্দ যেতেন মাঝে মাঝে। শশীকুমারের স্বদেশপ্রেম, সাহিত্যানুরাগ ও চিত্রকলা-নৈপুণ্যের তিনি প্রশংসা করতেন মুক্তকণ্ঠে কিন্তু একেবারে পছন্দ করতেন না তাঁর বিলাসপ্রিয়তা।
শশীকুমার বরোদার গেস্ট হাউসে অরবিন্দকে দু-তিন দিন সামনে বসিয়ে এঁকেছিলেন একটি তেল রঙের ছবি।
সেই সময় দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’ ও ‘লীলাবতী’ অরবিন্দ পড়েছিলেন তাঁর বাংলা শিক্ষকের কাছে। তবে ‘লীলাবতী’ পড়াবার সময় একটি ছড়ার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হন তাঁর শিক্ষক। ছড়াটি—
‘মদের মজাটি গাঁজা কাটি কচ্ কচ্,
মামীর পিরীতে মামা হ্যাঁকচ প্যাঁকচ।’
দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখছেন— ‘ইহার ঠিক অনুবাদ করা, আমি তো দূরের কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক দিগ্গজেরও অসাধ্য! বিস্তর চেষ্টা করিয়াও হ্যাঁকচ-প্যাঁকচ কি তাহা অরবিন্দকে বুঝাইতে পারি নাই। ‘পিরীতের হ্যাঁকচ প্যাঁকচ’ অরবিন্দ বোধ হয় জীবনে বুঝিতে পারিবেন না; পারিলে তাঁহার এ দুর্দ্দশা হইবে কেন?
‘স্বর্ণলতা’ পাঠ করিয়া অরবিন্দ মুগ্ধ হইয়াছিলেন। চিরপ্রবাসী বাঙ্গালীর ছেলে অরবিন্দ বাঙ্গালার গার্হস্থ্য-চিত্রে পরিতৃপ্ত হইবেন, ইহা বিস্ময়ের কথা নহে; কিন্তু এই উপন্যাসের শেষাংশ পাঠ করিয়া তাঁহাকে কিছু হতাশ হইতে দেখিয়াছিলাম। ‘স্বর্ণলতা’ পাঠ করিতে, শশাঙ্কশেখরের গৃহে যেখানে আগুন লাগিল সেই স্থানে আসিয়া অরবিন্দ পুস্তক বন্ধ করিলেন; বলিলেন— গ্রন্থকার এই স্থানেই গল্পের ‘আর্ট নষ্ট করিয়াছেন’। কথাটি কতদূর সঙ্গত সাহিত্যমোদী পাঠক তাহা ভাবিয়া দেখিবেন।’
ভারতচন্দ্রকে প্রতিভাবান মনে করতেন অরবিন্দ। তাঁর শিল্পরসবোধকে উপেক্ষা করেননি অশ্লীল বলে। বাঙালির ধর্মজীবন ও সাহিত্যের সন্ধানে তিনি গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়েন ‘অন্নদামঙ্গল’।
অরবিন্দ গভীর অভিনিবেশে পড়তেন স্বামী বিবেকানন্দের বাংলা প্রবন্ধগুলি। দীনেন্দ্রকুমারকে বলতেন, ‘স্বামীজির ভাষায় প্রাণের সাড়া পাওয়া যায়, ভাষার ভাবের এরূপ ঝঙ্কার, শক্তি ও তেজ অন্যত্র দুর্লভ।’
কবিত্বে বাল্মীকির শ্রেষ্ঠতা প্রতিষ্ঠায় তিনি লিখেছিলেন এক ইংরেজি নিবন্ধ। অরবিন্দ বলেন, ‘মহাকবি দান্তের কবিত্বে মুগ্ধ হয়েছিলাম, হোমারের ইলিয়াড পাঠে পরিতৃপ্ত হয়েছিলাম; ইউরোপের সাহিত্যে তা অতুলনীয়; কিন্তু কবিত্বে বাল্মীকি সর্বশ্রেষ্ঠ। রামায়ণের তুল্য মহাকাব্য পৃথিবীতে দ্বিতীয় নেই।’
১৯০৫-এর শেষপ্রান্তে অথবা ১৯০৬-এর শুরুতে প্রকাশিত হয় অরবিন্দের ‘ভবানীমন্দির’ ইংরেজি প্রবন্ধ-পুস্তিকা। সেই সময় থেকে তিনি রামায়ণ-মহাভারত বিষয়ে গভীর চর্চা শুরু করেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।
নিভৃতে লিখতে শুরু করেন মহাভারত সম্বন্ধে। তাঁর স্নেহভাজন বিপ্লবী সুধীরকুমার সরকার একদিন তাঁকে সরাসরি শুধোন— ‘আপনি কি মহাভারতের সব কথা বিশ্বাস করেন? এতে নাকি অনেক প্রক্ষিপ্ত আছে?’
অরবিন্দ সম্ভবত তাঁর অনুরাগীর কাছ হতে হঠাৎ এমন প্রশ্ন আশা করেননি। শান্ত ধীর কণ্ঠে বললেন— ‘বাসুকীর পৃথিবীধারণ, এ কথা তোমার আমার অস্তিত্বের মতোই সত্য— তবে যে দৃষ্টিতে সেটা দেখা যায়, তা আমরা হারিয়েছি। আর যে দৃষ্টিতে নানা প্রতিক্রিয়ার ফলে আধুনিক বৈজ্ঞানিক জগৎ দেখছি, সেটাই মানুষের সমগ্র দৃষ্টি নয়। বাসুকী represents vital power, সমগ্র প্রাণশক্তির প্রতীক।’