বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
শিবু ওরফে শিবেন সরমার ছোট ছেলে। বড় ছেলে হারান পাশেই একটা ঘরে থাকে বউ আর মেয়েকে নিয়ে। সরমার নাতনি ঝুমকো এখন বারো ক্লাসে পড়ে। টাকা পয়সার ব্যাপারে হারানও একেবারে হাত তুলে দিয়েছে। তাই সরমার কয়েক মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি পড়ে গেলেও হারান কোনও সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। কেরোসিন তেলের পেছনেই কি সরমার কম খরচ হচ্ছে? গ্যাসে রান্নাও এখন আপাতত বন্ধ রেখেছে। পুরনো টিভিটাও কতদিন খারাপ হয়ে পড়ে আছে। এই টিভিটা বিনতা বউদিরা দিয়েছিল ওদের বসার ঘরে নতুন দামি টিভি আসার পর। তারপর সেই যে ঝড়বৃষ্টির পরে গতবছর পাকুড় গাছের ডাল পড়ে ছাদের কয়েকটা টালি ভেঙে গিয়ে জল পড়তে শুরু করেছিল তাও আর সারানো সম্ভব হয়নি। শিবু কোনওমতে মোটা প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে ব্যাপারটা সামলেছে।
দুই
সরমার কাজের বাড়ির জয়িতা বউদির সূত্রেই শিবু কিছুদিন আগে একটা ডেলিভারি বয়ের কাজ পেয়েছে। প্রথমে পাঁচ হাজারের বেশি দেবেন না বলেছেন ঊর্মিলা ম্যাডাম। কাজ দেখে মাইনে বাড়াবার আশ্বাসটুকু তিনি অবশ্য দিয়েছেন। সল্টলেকে দশ নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে ওঁর বাড়ি। ওঁকে রান্নায় সাহায্য করে দু’টি মেয়ে। রোজই সারাটা দিন ওদের হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয় রান্নাঘরে ঘেমে নেয়ে। শিবু আপাতত ওর সাইকেল নিয়েই সল্টলেকের এদিক ওদিক খাবার পৌঁছে দেয়। শিবুকে সরমা প্লাস্টিকের টিফিন বক্সে রুটি তরকারি দিয়ে দেয়। কিন্তু এ বাড়ি ও বাড়ি ছুটতে গিয়েই শিবুর নিজেরই আর ঠিকঠাক খাওয়া হয়ে ওঠে না। কয়েকটা বাড়িতে রাতের খাবার ডেলিভারি দিয়ে আর ঊর্মিলা ম্যাডামকে টাকা পয়সা বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। শিবুর ফেরার অপেক্ষায় জেগে থাকতে থাকতে সরমা একসময় ঘুমে ঢুলে পড়ে। আগে তবু সন্ধেবেলা ক্লান্ত হলেও একটু টিভি সিরিয়াল দেখত। এখন তো সেটাও বন্ধ। ডেলিভারির কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে বারোয়ারি কলঘরে সাবান দিয়ে স্নান করে, মাস্ক আর জামাকাপড় কেচে ঘরে এসে খেতে বসতে আরও কিছুটা দেরি হয়ে যায়। ঊর্মিলা ম্যাডাম অপরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরে কাজে যাওয়া একদম পছন্ধ করেন না। রাতের পাতে ডাল ভাত মেখে খেতে খেতে শিবু বলে, ‘মাইনেটা পেলে আমাদের এতটা কষ্ট আর করতে হবে না মা বলো। টালির ছাদটাও আমি তখন সারিয়ে নেব।’ জবাব না দিয়ে সরমা ঘুম জড়ানো চোখে একটু ম্লান হাসে। খাবার সময়ে পাশের ঘর থেকে হারান আর ওর বউ অপর্ণার ঝগড়ার শব্দ শুনতে পায় সরমা। খেতে খেতে শিবু বলে ‘ওই আবার শুরু হয়েছে দু’জনের গালাগালি। শালা শান্তি নেই কোথাও। নির্ঘাত দাদা আজ আবার দেশি মদের ঠেকে ঢুঁ মেরেছিল। তাই বউদি ক্ষেপে গেছে।’ ‘তাই হবে,’ বলে সরমা দাওয়ায় বাসন ধুতে যায়। রাত আরও বাড়তে বস্তি আস্তে আস্তে শুনশান হয়ে যায়। একসময় থেমে যায় হারান-অপর্ণার ঝগড়া।
তিন
দুর্গা ষষ্ঠীর দিন শিবু সন্ধেবেলায় নিয়ম মতোই পৌঁছল সিদ্ধার্থ মুখার্জির বাড়িতে রাতের খাবার নিয়ে। বাড়ির দোতলায় থাকেন নিঃসঙ্গ এই প্রবীণ দম্পতি। ছেলেমেয়ে থাকে বিদেশে— শিবু এইটুকুই শুনেছে শ্রীলা মাসিমার কাছে। ফোনেই কথা হয় তাদের সঙ্গে। একতলাটা ভাড়া দেওয়া আছে। রাস্তার ধারে বেড়া দেওয়া বাগানটার ছন্নছাড়া অবস্থা এখন। ওই দু’-একটা নয়নতারা, জবা, সূর্যমুখী এসবই আছে এখন। ভাড়াটে পরিবারটি দেখাশোনা করে বাগানের। ভাড়াটে রাঘব সান্যাল তাঁর স্ত্রী আর কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে নিয়েই থাকেন একতলায়। ‘ঊর্মিলা’স কিচেন’-এর সঙ্গে মুখার্জি পরিবারের সারা মাসের চুক্তি। রোজ সাড়ে সাতটার মধ্যেই ওঁদের রাতের খাবার পৌঁছে দিতে হয়। রানা নামের আর একটি ডেলিভারি বয় ওঁদের দুপুরের খাবার দিয়ে যায়।
ঊর্মিলা ম্যাডামের কাছে শিবু শুনেছে যে আজ সিদ্ধার্থবাবুর বাড়িতে অতিথি আসবেন। ঊর্মিলা ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলেই শ্রীলা মাসিমা আজকের মেনু ঠিক করেছেন। সকলেরই বয়েস হয়েছে। তাই খুব তেল গরগরে রান্না ওঁরা কেউই পছন্দ করেন না। ফোনে কথা বলার সময়ে শিবু শুনেছে মাসিমার আজকের অর্ডারের কথা। শিবু আজ মুখার্জি বাড়িতে নিয়ে যাবে বাসন্তী পোলাও, চিকেন রেজালা, মাটন কাটলেট আর ক্যারামেল পুডিং। কোনওদিন এসব খায়নি শিবু। শুধু মাটন কাটলেট খেয়েছে কয়েকবার বন্ধুদের সঙ্গে হাতিবাগানের একটা দোকানে, ঠাকুর দেখতে গিয়ে। এখন পাঁঠার মাংসও আর সরমা কিনতে পারে না। এত দাম। শিবু জানে বাসন্তী পুজো হয় প্রত্যেক বছর চৈত্র মাসে। মায়ের কাছে শুনেছে যে ওটাই নাকি আসল দুর্গাপুজো। কিন্তু বাসন্তী পোলাওটা আবার কী রে বাবা— শিবুর মনে হয়। সরস্বতী পুজোর সময় মেয়েরা যে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে পোলাওটা কি ওইরকম রঙেরই হয়। মায়ের হাতের মুরগির মাংসের ঝোল ছাড়া ও আর কিছুই খায়নি। বেল বাজানোর পরে দাঁড়িয়ে থেকে শিবু লক্ষ করল দোতলাটা আজ কেমন যেন অন্ধকার লাগছে। শুধু ভেতরের বারান্দায় আলো জ্বলছে। ও দ্রুত পায়ে নেমে এসে ভাড়াটেদের দরজায় বেল বাজাল। রাঘববাবুর মেয়ে এসে দরজা খুলল। মেয়েটি বলল, মুখার্জি মেসোমশাই বিকেল পাঁচটা নাগাদ বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলেন। জ্ঞান ছিল না তখন। ভাগ্যিস দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করেননি। মেসোমশাইয়ের বন্ধুও তখন চলে এসেছিলেন। স্থানীয় এক ডাক্তারবাবুকে মাসিমা ফোন করে ডেকে এনেছিলেন। ডাক্তারবাবু আর সময় নষ্ট করে বাড়িতে রাখতে বারণ করে। তাই ওঁরা হুড়োহুড়ি করে বন্ধুর গাড়িতে করেই হাসপাতালে চলে গিয়েছেন। সব শুনে শিবু চিন্তিত মুখেই বললেন, ‘বাইরের গেটে তো তালা দেখলাম না।’ মেয়েটি উত্তর দিলেন ‘হয়তো তাড়াতাড়ি বেরতে গিয়ে কোল্যাপসিবল গেটে তালা দিতে মাসিমা ভুলে গেছেন।’ কোন হাসপাতালে মেসোমশাই ভর্তি হয়েছেন সেটা মেয়েটি জানে না। কারণ রাঘববাবু এখনও কোনও ফোন পাননি। খাবারের প্যাকেটগুলো নিয়ে শিবু বাইরের সিঁড়ির ধাপে বসে পড়ল দু’ হাতে মাথাটা চেপে ধরে। আর বসে বসে শুনতে পেল মেয়েটির দরজা বন্ধ করার শব্দ। দোতলাটা একদম নিঝুম অন্ধকার। আস্তে আস্তে সিঁড়ি থেকে উঠে শিবু খাবারের প্যাকেটগুলো নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল। আশপাশে ভিড় বাড়ছে। আজ অনেক অর্ডারও ছিল। মায়ের দেওয়া রুটি আর আলুর তরকারি কখন হজম হয়ে গিয়েছে। পেটে চনচনে খিদে। আলো ঝলমলে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শিবু ওর কম দামি মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে দিল।
চার
ষষ্ঠীর রাতে শিবু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরল। সরমা একটু অবাকই হল। খাবারের প্যাকেটগুলো ছোট টেবিলটার ওপর নামিয়ে রেখে শিবু বলল, ‘মা আজ অনেকদিন পরে জমিয়ে খাব দু’জনে। কতদিন ভালো কিছু খাইনি বলো।’ শিবুর মুখের দিকে তাকিয়ে সরমা বলল, ‘এতসব খাবার কে দিল রে শিবু?’ চোখটা সরিয়ে নিয়ে শিবু বলল, ‘কেন? ঊর্মিলা ম্যাডাম পুজোর কোনও একদিন সবাইকে খাওয়াবেন বলেছিলেন। আজ কয়েকটা অর্ডার ক্যানসেল হয়েছে বলে শুনেছি। তাই আজকেই দিয়েছেন।’ দু’জনে ভরপেট খাবার পরেও অনেকটা খাবার রয়ে গেল। সরমা তক্তপোশে গা এলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ রে, বাসন্তী পোলাওটা কি হলুদ দিয়ে করা হয়? বেশ খেতে। মাংসটাও দারুণ রেঁধেছে। কী মশলা দিয়েছে কে জানে। বিনতা বউদির কাছে শুনেছি এসব রান্নাকে রেছিপি না কি যেন একটা বলে। ভুলে গেছি। তুই অবশ্য কাটলেট আমাকে আগেও খাইয়েছিস। তবে দোকানের থেকে এটাই অনেক ভালো খেতে শিবু।’ একটু থেমে সরমা আবার বলল, ‘এই পুটিংটাও রীতা বউদির করা পুটিং-এর চেয়ে অনেক ভালো।’ শিবু বলল, ‘ওটা পুডিং মা।’ কথা বলতে বলতেই কখন যেন ঘুম এসে গেল সরমার চোখে। শিবু ইতিমধ্যেই পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে। পরের দিন সকালে শিবু চা-বিস্কুট খেয়ে বলল, ‘মা শরীরটা একটু ম্যাজম্যাজ করছে। আজ আর কাজে যাব না ভাবছি।’ সরমা শিবুর কপাল ছুঁয়ে দেখল জ্বর নেই। একটু নিশ্চিন্ত হয়ে কাজের বাড়ির দিকে রওনা হবার আগে ছেলেকে বলল ঊর্মিলা ম্যাডামকে ফোনে জানিয়ে দিতে যে, ও আজ যাবে না। শিবু হ্যাঁ বলে চুপচাপ পাশ ফিরে শুল। আর কোনও কথাই বলল না। ওর ফোন এখনও বন্ধ।
অষ্টমীর দিন সকালে হঠাৎ রানা এসে উপস্থিত হল শিবুদের বস্তির ঠিকানা খুঁজে খুঁজে। সরমা তখন সামনের পানা পুকুরের ঘাটে বসে দাঁতে মাজছিল। পুকুরের ধারে কচু ঝোপের কাছে এখন দু’-একটা মাছরাঙা বসে আছে। দাঁত মাজতে মাজতে সরমা ওদের বস্তির কয়েকটা বউয়ের সঙ্গে গল্প করছে। আজ একটা কাজের বাড়িতে ছুটি দিয়েছে। তাই তাড়া নেই আজ আর। একটু দূর থেকে ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে। একটু পরেই রাস্তার টাইমকলে জল ভরার জন্যে লম্বা লাইন পড়বে মেয়ে বউদের।
সরমা রানাকে কোনও দিন দেখেনি। তাই ওর মনে হল একটা অচেনা ছেলে চলে যাচ্ছে ওদের ঘরের দিক থেকে বেরিয়ে। ঘরে ঢুকে দেখল শিবু তক্তপোশের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ওর কি শরীর খারাপ হয়েছে আবার— ভাবল সরমা। সরমা স্টোভে চায়ের জল চাপিয়ে শিবুকে জিজ্ঞেস করল ছেলেটার কথা। শিবু হুড়মুড় করে তক্তপোশ থেকে নেমে মেঝেয় বসে মায়ের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, ‘আমি একটা খুব ভুল কাজ করেছি মা। আমার কাজটা আর নেই। যে ক’দিন কাজ করেছি সেই টাকাটা ম্যাডাম রানার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। শুধু খাবারের দামটা কেটে নিয়েছেন।’ সরমার ইচ্ছে হল শিবুর গালে সপাটে একটা চড় মারতে। শেষ পর্যন্ত চুরি করল শিবু। ওর সব কাজের বাড়ির লোকেরাই ওকে খুব বিশ্বাস করে। এমনকী, বউদিরা প্রয়োজন হলে ওর হাতে ফ্ল্যাটের চাবি দিয়েও বেরিয়ে যায়। কোনও দিন একটা জিনিস এদিক থেকে ওদিক হয়নি। বছর কয়েক আগে তো বিনতা বউদির সোনার দুল ও ঝাঁট দিতে গিয়ে খুঁজে দিয়েছিল খাটের তলা থেকে। এক কানের দুল হারিয়ে বউদি একেবারে মুষড়ে পড়েছিল। দাদাবাবুকেও বলতে পারেনি। একখানা পুরনো সিল্কের শাড়ি দিয়েছিল বউদি দারুণ খুশি হয়ে। সরমার চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়ল। শিবুকে ও চড় মারতে পারল না। ছোটবেলা থেকেই ওদের বাবা বউ আর ছেলেদের কোনও দায়িত্বই নেয়নি। পালিয়ে সংসার পেতেছিল অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে। তবু ছেলেদের বাপের মরার খবর যেদিন সরমা পেয়েছিল সেদিন সারাদিন কিছু খায়নি। এখন অনেকদিন পরে শিবুর মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলল, ‘কাজ না থাক। ওই ম্যাডামের কাছে তুই কিন্তু ক্ষমা চেয়ে নিস।’ চায়ের জল ফুটে ফুটে কখন যে ছোট কেটলিটার একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে তা সরমা আর খেয়ালই করতে পারেনি। শিবু শুকনো মুখে কান্না ভেজা গলায় বলল, ‘খাবারের গন্ধে আমি লোভ সামলাতে পারিনি মা। বড্ড খিদেও পেয়েছিল। ষষ্ঠীর দিন ডেলিভারির অনেক চাপ ছিল। আমায় তুমি ক্ষমা করো মা।’ সরমা আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে কাজের বাড়ির দিকে এগল। কী করে জয়িতা বউদির কাছে মুখ দেখাবে ও। এইসব ভাবতে ভাবতেই সরমা অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পেরল।
পাঁচ
লক্ষ্মীপুজোর পরের দিন একেবারে সকালে শ্রীলা মাসিমার ফোন পেল ঊর্মিলা। সিদ্ধার্থবাবু আপাতত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন হাসপাতাল থেকে। মাইল্ড অ্যাটাক হয়েছিল ওঁর— শুধু এইটুকুই ও শুনেছে মাসিমার কাছে। এ ক’দিন উনি কসবায় ওঁর ভাই-এর বাড়িতেই ছিলেন। সন্ধেবেলা শিবুকে দিয়ে উনি রুটির সঙ্গে চিকেন স্টু, পাতলা মুসুর ডাল আর একটা হাল্কা নিরামিষ তরকারি পাঠাতে বললেন। শিবুর কীর্তি কাহিনি ঊর্মিলা শ্রীলা মাসিমাকে বলেনি মেসোমশাই অসুস্থ ছিলেন বলে। ঊর্মিলা বলল, ‘মাসিমা এখন থেকে সন্ধেবেলা আপনাদের বাড়ির খাবার নিয়ে যাবে রাজু বলে একটা নতুন ছেলে।’ শ্রীলা মাসিমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন শিবুর কী হয়েছে?’ ঊর্মিলা জবাব দিল, ‘আর বলবেন না। ষষ্ঠীর দিন আপনার অর্ডার দেওয়া সমস্ত খাবার আমাকে না জানিয়ে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। আবার চালাকি করে ফোনও বন্ধ রেখেছিল। বস্তির এসব হ্যাগার্ড ছেলের জন্যে আমার ব্যবসার বদনাম হোক এটা আমি চাই না। এখন খুব কমপিটিশনের মার্কেট মাসিমা। চিন্তা করবেন না। রাজু ঠিক সময়ে খাবার পৌঁছে দেবে আপনার বাড়িতে। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না।’ শ্রীলা মাসিমা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘শিবুর তো কোনও দোষ নেই ঊর্মিলা। আমি বেরনোর আগে শিবুকে একটা চিরকুটে লিখে দিয়ে গিয়েছিলাম খাবারগুলো ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে। ওটা দরজার নীচেই রেখেছিলাম যাতে ও দেখতে পায়। তবে মেসোমশাই যে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তা আর লেখার সময় পাইনি। আরে দেখ না, আমি তো মেন গেটে তালা দিতেই ভুলে গিয়েছিলাম। এরই মধ্যে শুধু রাঘববাবুকেই বলে গিয়েছিলাম সব ব্যাপারটা। তুমি জানো না ঊর্মিলা, পুজোর আগে যখন টানা বৃষ্টি চলেছিল তখন জমা জল ভেঙে আমার বাড়িতে কোনও ঠিকে কাজের লোক আসেনি। কিন্তু শিবু কাকভিজে অবস্থায় আমাদের খাবার পৌঁছে দিয়েছিল রোজ। ওই অবস্থায় আমাকে পাউরুটি, দুধ, ডিম এসব কিনে এনেও দিয়েছিল।’ ঊর্মিলা বলল, ‘এটাই তো ওর কাজ মাসিমা।’ শ্রীলা মাসিমা উত্তর দিলেন, ‘শুধু শুধু শিবুর মতো একটা অভাবী ছেলেকে কাজ থেকে ছাড়িও না। সেক্ষেত্রে আমি অন্য জায়গা থেকে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করব।’ শ্রীলা মাসিমা ফোন রাখার পরে ঊর্মিলা রানাকে বলল, শিবুকে ফোনে ডেকে নিতে। ডেলিভারির চাপ আছে। রান্নার মেয়েরাও এসে গিয়েছে। শুধু শুধু এত বছরের পুরনো কাস্টমারকে হারানোর কোনও মানেই হয় না। বিশেষ করে মাসচুক্তির। হইহই করে শুরু হয়ে গেল রান্নাবান্না ঊর্মিলা’স কিচেনের দৈনন্দিন কাজকর্মের পর্ব।
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল