পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
বাইরে মাঠের এককোণে মাইকে বাজছে আগমনী গানের সুর। পুজো প্রায় এসে গিয়েছে।
গল্পের প্রথম পৃষ্ঠাটা লেখাই সবচেয়ে কঠিন, একবার শুরু করতে পারলে হুড়মুড় করে পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলি হাজির হতে থাকে কলমের ডগায়—এই ভেবে কলম উদ্যত করে আছেন সাদা পৃষ্ঠার উপর, বারবার উল্টে দেখছেন মগজের ছন্দতন্তুজাল, কিন্তু লেখা হয়নি এক লাইনও, সেই মুহূর্তে দরজায় কলিং বেলের শব্দ।
শব্দটা কানে যেতেই ভীষণ বিরক্ত হলেন ভাস্করবাবু। দু-একটা প্লট আসি-আসি করছিল, এ সময়—
খোলা দরজার ওপারে বারান্দা, গ্রিলঘেরা বারান্দায় কোলাপসিবল গেট, গ্রিলের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে হলুদ শাড়ি-পরা এক রমণী-শরীর, ঘোমটা দেওয়া, তার সঙ্গে দুটি বালিকার অবয়ব।
আজ অনেকদিন পরে বাড়িতে একাই আছেন ভাস্করবাবু, বিপাশা সকালে উঠেই গেছে পিত্রালয়ে, ফিরবে বিকেলের দিকে। ফলে ঠিক সময়ে চায়ের কাপ আসছে না, গরম চায়ে চুমুক না দিলে মগজটাও যেন খোলে না।
তাই একা থাকাটা তাঁর মোটেই পছন্দের নয়।
হয়তো সে কারণেই লেখাটা আসছে না কলমের ডগায়।
কলিং বেল বাজার পর অনেকখানি সময় পার, বিপাশা ঘরে থাকলে দরজা খোলার কাজটা সে-ই করে, এখন তাঁকেই উঠে দেখতে হবে কে এল এমন সকালবেলায়! উঠতে একটু দেরিই হয়ে গেল, এমন দ্বিধান্বিত মুহূর্তে দ্বিতীয়বার কলিং বেলের শব্দ।
না, শেষ পর্যন্ত উঠতেই হল লেখার টেবিল ছেড়ে।
গ্রিলের ওপাশে যাদের দেখলেন তাতে বিরক্তির অন্ত রইল না তাঁর। শতছিন্ন কাপড় পরা একটি বউ বসে আছে সিঁড়ির উপর, তার পাশে দুটি বালিকা, একটির বয়স দশ তো অন্যটির বছর সাতেক। ভাস্করবাবুকে দেখেই বউটি বলল, কিছু খেতে দেবেন, বাবু? বাচ্চা দুটো কাল থেকে কিছু খেতে পায়নি।
খেতে দিতে হবে! তার চেয়ে কিছু টাকা দিলেই রেহাই পাওয়া যায় আপাতত।
ঘর থেকে টাকা এনে দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বউটি কাকুতিমিনতি করে বলল, কাল রাত থেকে কিছু খায়নি ওরা। যা হোক কিছু দিন।
ভাস্করবাবু নিজেই বাড়িতে বাস করেন প্রায় পেয়িং গেস্টের মতো, বাড়ির কোথায় কী থাকে তার বিন্দুবিসর্গ খবর রাখেন না, তিনটি প্রাণীকে এখন কী খেতে দেবেন তা ভেবে মাথায় সৌরজগৎ ভেঙে পড়ে আর কী। ভাবলেন বিরক্তি প্রকাশ করে বলে দেবেন, এখন হবে না, যাও। বিকেলে এসো।
বলতে গিয়েও তাঁর চোখ পড়ল বাচ্চা দুটোর চোখের দিকে। তিনটি প্রাণীর শতচ্ছিন্ন অবস্থা দেখে অনুমান করেন নিশ্চয় ফুটপাথবাসী। এ ধরনের পরিবারের ইতিহাস তাঁর ভালোমতো জানা। কোন ফুটপাথবাসী পুরুষ তারই সমগোত্রীয় কোনও একটি মেয়েকে হাতিয়ে নিয়ে এসেছে অন্য কোথাও থেকে, তারপর দু’খানি বাচ্চা। পুরুষটি কেটে পড়েছে এক সময়। গরিব মেয়েটি এখন অগাধ সমুদ্রে।
তিনজোড়া চোখ তাঁর কৃপার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে ভাস্করবাবু বেশ ঝামেলায়। এখন যদি তিনি বদান্যতা দেখাতে যান, বাড়িতে কোথায় কী খাদ্য আছে তা খুঁজতে বসতে হবে, সেই খোঁজা কতক্ষণ ধরে চলবে তা তিনি জানেন না, আর খুঁজতে যাওয়া মানে সকালের লেখাটা গেল!
বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ভিক্ষা করতে বেরিয়েছ কেন? এদের বাবা কোথায় গেল? বউটি বলল, নেই।
—নেই মানে? ভাস্করবাবু খেয়াল করলেন বউটির কপালে সিঁদুরের ফোঁটাও নেই।
—ওদের বাবা কয়লার ঘেঁষের মধ্যে কয়লার টুকরো খুঁজছিল, হঠাৎ ধস নেমে—
আর বলতে পারল না, চোখ দুটো ছলছল করে উঠল, পরক্ষণে বলল, আমি একটুর জন্য চাপা পড়িনি।
একজন একটুর জন্য চাপা পড়ে ভাসিয়ে দিয়ে গিয়েছে ছেলে-মেয়ে, আর একজন একটুর জন্য চাপা না পড়ে লড়াই করছে দুটি মেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার।
কী মনে হতে জিজ্ঞাসা করলেন, কী নাম তোমার?
—দুর্গা।
—তা দুর্গা, তুমি অন্যের বাড়ি খেটে খাও না কেন! শহরে কাজের লোকের তো খুব অভাব!
—কাজ তো করতাম। রান্নার কাজ। দু’বাড়িতে দু’বছর করেছি, হঠাৎ হাতে কী এক ঘা হল, তারা বলল, কী ঘা কে জানে, তুমি আর রান্না করতে এসো না।
বউটি বাঁ-হাত তুলে দেখাল হাতের তেলো।
—ডাক্তার দেখাওনি? বলেই ভাস্করবাবু ভাবলেন ডাক্তার দেখানোর টাকা পাবে কোথায়।
—হাসপাতালের আউটডোরে দেখিয়েছি, কিন্তু মলম কেনার টাকা নেই তো!
সব উত্তরই যথাযথ, এখন তিন ক্ষুধার্তের জন্য কী করবেন ভেবে ভাস্করবাবু ঘামছেন।
হঠাৎ নজর পড়ল দশ বছরের মেয়েটা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখছে তাঁর ঘরের বইয়ের পাহাড়, বলল, আমার খুব বই পড়তে ইচ্ছে করে।
বই! ফুটপাথ-কন্যার কথা শুনে খুবই অবাক লাগে, বলেন, তুই বই পড়তে পারিস?
মেয়েটি নয়, তার মা-ই উত্তর দিল, ও তো ক্লাস থ্রিতে পড়ত। এখন আমার সঙ্গে কয়লার ঘেঁসে যায় কয়লা কুড়োতে। স্কুল ছেড়ে দিয়েছে।
মেয়েটি আবার বলল, আমাকে একটা বই দেবে?
—বই? কী বই?
মেয়েটি তাঁকে আরও অবাক করে বলল, আমার যা পড়তে ভালো লাগবে।
ভাস্করবাবু ফাঁপরে। কী বই আর ভালো লাগবে এ এক বিষম প্রশ্ন। বড়দের বইয়ের সঙ্গে কিছু ছোটদের বইও আছে তাঁর বইয়ের র্যাকে।
র্যাক খুঁজেপেতে তার হাতে তুলে দিলেন ছোটদের উপযোগী একটি গল্পের বই। মেয়েটি অমনি সিঁড়ির উপর বসে পড়তে শুরু করে দিল বইটি। মনে হল তার পেটে আর খিদে নেই।
ছোট মেয়েটি অমনি দিদির দিকে তাকিয়ে কী যেন ভেবে বলল, আমাকে বই দেবে না?
—তোকেও বই দিতে হবে? তোকে কী বই দেব? তুই তো এখনও ঢের ছোট।
—একটা ছবির বই দাও।
র্যাকে খুঁজে সেরকম একটি বইও পাওয়া গেল।
সেও অমনি খিদে ভুলে বসে গেল ছবির বইয়ের পাতায়। বেশ তন্ময় হয়ে উল্টে-উল্টে দেখছে ছবিগুলো।
দুর্গা দুই মেয়ের পাঠভঙ্গি দেখে খুব তৃপ্ত হল, বলল, ওর বাবার খুব ইচ্ছে ছিল মেয়ে দুটোকে লেখাপড়া শিখিয়ে চাকরি করতে দেবে। নিজে তো আর লেখাপড়া শেখেনি।
তারপর বলল, টাকা চাইনে, কিছু খেতে দেবেন?
অতএব লেখার কথা ভুলে ভাস্করবাবু শুরু করলেন এক অভাবনীয় অভিযান।
প্রায় হিমালয় যাত্রার মতো কিচেনের গোলকধাঁধা হাঁটকে আবিষ্কার করতে শুরু করলেন নিজের সংসার। র্যাক থেকে বই খুঁজে পাওয়া তাঁর পক্ষে যতটা সহজ, ঠিক ততটাই কঠিন রান্নাঘরের গলিঘুঁজি ধরে এগনো।
একবার রান্নাঘরের দেরাজ হাঁটকান তো পরের মুহূর্তে ফ্রিজের আঁটোসাটো পরিসর, তারপর দেখতে শুরু করলেন ঘরের যেখানে যা কিছু থাকা সম্ভব।
একটি মিড-সল্ফে খুঁজে পেলেন আধ-পাউন্ড স্লাইসড পাউরুটি। একটি জাল দেওয়া আলমারির মধ্যে একটি মেরি গোল্ড বিস্কুটের প্যাকেট। ফ্রিজের মধ্যে কিছু মিষ্টি। একটি জলের বোতল। তা ছাড়াও একশো টাকার একটি নোট দিয়ে বললেন, ওষুধের দোকান থেকে মলম কিনে এখনই হাতে লাগাতে শুরু কর।
সেগুলি দুর্গার হাতে তুলে দিতেই তার বড় বড় চোখে কৃতজ্ঞতার ছায়া। তাড়াতাড়ি ছোট দুটোকে বিস্কুট আর মিষ্টি খাওয়াতে ব্যস্ত হল।
ভাস্করবাবু এবার নিশ্চিন্ত হয়ে আবার গিয়ে বসলেন লেখার টেবিলে। প্রায় আধঘণ্টা লেগে গেছে সবকিছু খুঁজেপেতে বের করতে। তবে একটু আগে যে বিরক্তিটা ভিতরে বিজবিজ করছিল, তা এখন উধাও। হাতে কলম নিয়ে আবার ভাবতে লাগলেন প্লট।
মাথায় কিছু আসছে না বলে চোখ রাখলেন গ্রিলের ওদিকে বসা দুর্গার খাওয়ানোর দিকে। দুটি মেয়ের গালে কী যে গুঁজে দিচ্ছেন তা দুই বালিকার খেয়াল নেই। দু’জনেই তন্ময় হয়ে বইয়ের পৃষ্ঠায় চোখ রেখেছে, পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছে যথানিয়মে। তাদের এই বই তন্ময়তা দেখে খুব আশ্চর্য হচ্ছিলেন ভাস্করবাবু।
যাদের বাড়িতে অঢেল বই, তাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা বইয়ের পাতা উল্টেও দেখে না, অথচ বালিকা দুটির খাওয়া শেষ হতে, নিজে কিছু খেয়ে, জলের বোতল কিছুটা শেষ করে দুর্গা উঠে দাঁড়ায়। গ্রিলের এদিকে, ভাস্করবাবুর অস্পষ্ট চেহারার দিকে তাকিয়ে কিছু যেন বলল তার দীর্ঘায়ত দুটি চোখ দিয়ে, তারপর বেরিয়ে পড়ল মেয়ে দুটির হাত ধরে। দুই বালিকার বুকে চেপে ধরা দুটি বই। তিনটি তৃপ্ত মুখ।
দুর্গা হাঁটছে—হাঁটছে, দু’হাতে ধরা দুই কন্যা। চলেছে দূর থেকে আরও দূরে। আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছে তাদের চেহারা।
উদ্যত কলম হাতে নিয়ে, আগমনীর গান শুনতে শুনতে ভাস্করবাবু দেখলেন দুই কন্যার হাত ধরে যে মেয়েটি হেঁটে যাচ্ছে, সে যেন আর শুধু দুর্গাটি নেই, দেবী দুর্গা, হেঁটে চলেছেন কৈলাস থেকে মর্তভূমির দিকে।
হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো ভাস্করবাবুর মনে হল তিনি খুঁজে পেয়েছেন তাঁর ঈপ্সিত গল্পের প্লট।