পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
‘কথাটা পুরো সত্য নয়। আবার পুরো মিথ্যেও নয়।’ বলেই হেসে উঠল শুভায়ু।
‘একদিন তো আমার ভুলও হয়ে যেতে পারে। নাকি?’
‘জানি আমি, হবে না। কারণ তুমি জানো ওটা আমার সারাদিনের রসদ।’
‘অন্য কোনও রসদ হয় না? এটা তো শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক।’
‘এই এই, তোমার অনুরোধে চার প্যাকেট থেকে দু’প্যাকেটে নামিয়েছি। প্লিজ আর বেশি কড়াকড়ি কোরো না। আমার সাধনাটাই মাটি হয়ে যাবে।’ লিলি আর কোনও তর্ক না করে দু’প্যাকেট সিগারেট নামিয়ে রাখল শুভায়ুর পাশে। সঙ্গে সঙ্গে টেনে নিল শুভায়ু প্যাকেট দুটো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওফ বাঁচলাম, সন্ধের পরই ফুরিয়ে গিয়েছিল। লেখাটাও তারপর থেকে খোঁড়াতে শুরু করেছে।’
লিলি হেসে ফেলল পাশে বসে, ‘এটা আমাকে এক রকমের ব্যাকমেল না?’
‘একেবারে না। দেখো, সারাদিনে কতটা লিখেছি। আর সন্ধের পর থেকে কতটুকু! পড়ব, শুনবে?’ এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে সাগ্রহে বলল শুভায়ু।
‘নিশ্চয়ই শুনব। আগে একটু রান্নাঘরটা ঘুরে আসি?’
‘রান্নাঘরে কিছু দেখার নেই লিলি। মালতী মাসি সব করে রেখে গিয়েছে। তোমার চা-ও ফ্ল্যাক্সে। একটু বেশিই আছে আমিও তোমার সঙ্গে একটু খাব। এখন আমার লেখাটা শোনো, ‘সিরাজ বাংলাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিল, তার সম্মান ধরে রাখতে...।’
‘রাতের ভাতটা বসিয়ে দিয়ে এসে শুনি?’
‘যাও, শুনতে হবে না। এমনভাবে থামিয়ে দাও, পড়ার এনার্জিটাই চলে যায়।’ খাতা বন্ধ করে দিল শুভায়ু। পায়ের উপর পা রেখে সিগারেট টানতে লাগল। লিলি লজ্জা পেয়ে গিয়েছে। একটু অপ্রস্তুতও। রাতের ভাত বেশিরভাগ দিনই শুভায়ু করে। সেই সময়টা লিলি পরীক্ষার খাতা দেখে।
দুই
লিলি আর শুভায়ুর দাম্পত্য জীবনটা অন্য আর পাঁচটা দম্পতিদের থেকে আলাদা। এই সংসারে স্ত্রী চাকরি করে স্বামী বাড়িতে থেকে নিজের কাজ করে। নিজের কাজ মানে শুভায়ু একটা উপন্যাস লিখছে। আর এই লেখার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। বলতে গেলে লিলিই ছাড়িয়ে দিয়েছে। সোজা বলে দিয়েছিল লিলি, ‘উপন্যাসটা পুরো মন দিয়ে লেখ শুভায়ু। ওটার পিছনে তোমার অনেক বেশি সময় দেওয়া দরকার। চাকরি করে সেটা সম্ভব নয়। লাইব্রেরি ওয়ার্ক করতে হবে, অনেক পড়াশোনাও দরকার। আমার স্কুলের চাকরি থেকেই সংসার চালিয়ে নেব।’
‘আমি চাকরি ছেড়ে উপন্যাস লিখব আর তুমি চাকরি করে সংসার চালাবে?’
‘কেন, মানে লাগছে তোমার? নাকি লেখার ইচ্ছেই নেই?’
‘দুটোই ভুল। তোমার ওপর চাপ পরে যাবে সেটাই ভাবছিলাম।’
‘উপন্যাসটা যদি ভালো লেখা না হয় তাহলে আমাদের দু’জনের মনের ওপরেই চাপ পড়ে যাবে শুভ। আমার অনুরোধটা শোনো। সব ছেড়ে লেখায় মন দাও।’
‘বেশ, তাই করব।’
শুভায়ু শুধু মুখেই কথাটা বলেনি কাজেও করেছে। চাকরি শুধু ছাড়েনি, বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা, বেড়ানো-ঘোরা, আত্মীয়-স্বজন সব ছেড়ে লেখাটাকেই আপন করে নিয়েছে। মাঝেমধ্যে শুধু লাইব্রেরি যায়। তাও অনেক বই লিলিই এনে দেয়। সব লিলি করে, সব কাজ। তার মধ্যে প্রত্যেকদিন দু’প্যাকেট সিগারেট আনতে ভোলে না। ওই একটাই নেশা শুভায়ুর। আগে চার প্যাকেট লাগত, বউয়ের অনুরোধে দু’প্যাকেট কমিয়েছে।
লিলি আর যাই ভুলে যাক, এটা আনতে কখনও ভোলে না। যেদিন ফিরতে দেরি হয়ে যায়, পাড়ার দোকানটা বন্ধ হয়ে যায়। লিলি সেদিন মোড়ের মাথার বড় দোকানটা থেকে কিনে নিয়ে আসে। কারণ ও জানে, ঘরে ঢোকামাত্রই হাত বাড়াবে শুভ, ‘আমার টরেগাসি?’
সিগারেট শব্দটা উল্টে বলে শুভায়ু কারণ ওর সিগারেট প্রীতিটা লিলির পছন্দ নয়। আগে আগে বেশ রাগারাগি করত। ‘সিগারেট আমার সতীন। সব সময় সিগারেট সিগারেট শুনতে ভালো লাগে না।’ একদিন শুভায়ু বলল, ‘বেশ! আজ থেকে আর সিগারেট বলব না, টরেগাসি বলব। তাহলে তো আর কানে লাগবে না।’
‘ওঃ, ধন্য করে দিলেন নাম বদলে। একেবারে ছেড়ে দিলে বুঝতাম! উল্টে বলে কী হবে!’
‘যদি সত্যি কোনও দিন ছেড়ে দিই তাহলে সিগারেট বলব। তার আগে ওই টরেগাসি-ই চলুক।’
বাংলার নবাব সিরাজদৌল্লাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখছে শুভায়ু। বলাবাহুল্য এটা ঐতিহাসিক উপন্যাস। আর তার জন্য প্রচুর পড়াশোনা করতে হয় তাকে। ইতিহাসের ছাত্র শুভায়ু চিরকালই সিরাজদৌল্লাকে খুব ভালোবাসত। এই নায়কের দেশপ্রেম, সুশাসন ব্যবস্থা, উদারতা, হৃদয়জোড়া প্রেম মানুষের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছে। বিশ্বাসঘাতকদের কবলে পড়ে এমন একটি মহাপ্রাণ কীভাবে বিনষ্ট হয়ে গেল সেটা জানাতে চেয়েছে। খুব মন দিয়ে লিখছে শুভায়ু। লিলির অনুপ্রেরণা না পেলে এ কাজ তার দ্বারা সম্ভব হতো না। আত্মীয়স্বজনদের বাঁকা কথা, বন্ধুজনদের টীকা-টিপ্পনিকে আমল দেয়নি লিলি। সমস্ত বাধা, কূটবাক্য থেকে তার প্রিয়তমকে আড়াল করে রেখেছে। কারও কোনও কথা শোনেনি। অনেকেই ওর মন ভাঙাতে চেয়েছে। সকলের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছে লিলি। শুভায়ুর লেখার আনন্দটাকে বড় করে নিয়েছে। তার স্বামী লেখক এ কী কম কথা! ও বিশ্বাস করে লেখক আর সাধক একই কথা।
তিন
লিলির এতক্ষণে এসে পড়ার কথা। এমন দেরি তো হয় না। স্কুলের পর দুটো বাচ্চাকে পড়ায়। ব্যস, সেটা সেরেই সোজা বাড়ি আসে। অন্য কোথাও যায় না। আজ কেন দেরি হচ্ছে? কলম বন্ধ করে ঘরবার করছিল শুভায়ু। সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ তাই লেখার মুড আসছে না। তারপর লিলির জন্য চিন্তা।
লিলি যখন বাড়ি এল খুব বিধ্বস্ত লাগছিল ওকে।
‘কী হয়েছে লিলি? এত দেরি হল?’
‘হাসপাতালে গিয়েছিলাম।’
‘কেন, তোমার কিছু হয়েছে লিলি?’
‘আমার না, যে দুটো বাচ্চাকে পড়াই সেই দুটো বাচ্চার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। স্কুলবাস নালায় পড়ে গিয়েছিল। অনেকেই আহত হয়েছে, কিন্তু ওই দুই ভাইয়ের খুবই খারাপ অবস্থা। ওদের বাবা-মায়ের ছটফটানি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না। আমি ওদের সঙ্গে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ওরা বেঁচে যাবে বল?’
লিলির চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।
বউকে কাছে টেনে নিল শুভায়ু। লিলি এই রকমই সফট। সকলের জন্য ভাবে। খুব নরম মনের মানুষ। ওর দুই ছাত্রের দুর্ঘটনা ওকে কতখানি ব্যাকুল করে দিয়েছে বুঝতে পারছিল শুভায়ু। এই নরম, দরদী বউটার জন্য খুব গর্ব হয় তার। ও লিলির চোখের জল মুছিয়ে দিল।
একটু পরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও জিজ্ঞাসা করে ফেলল, ‘আমার টরেগাসি? আনোনি না?
চকিতে উঠে দাঁড়াল লিলি। জিভ কেটে বলল, ‘এ মা! এক্কেবারে ভুলে গিয়েছি। দাঁড়াও সামনের দোকানটা থেকে নিয়ে আসছি।’
‘একদম না। আমি যাচ্ছি। তুমি রেস্ট নাও।’
এই বলে শুভায়ু তার টরেগাসির সন্ধানে চলল। হাঁটতে হাঁটতে এল বাড়ির সামনের দোকানটাতে। এসে দেখল, এক পাল্লা ঝাঁপ বন্ধ। তবু শুভায়ু ওর ব্র্যান্ডটা চাইল। ঠিক সেই সময়ে পাশের কয়েকটা ছেলের কথাবার্তা কানে এল, ‘আজ বউয়ের জন্য দাদা নিজেই সিগারেট কিনতে এসেছে দেখ।’
‘সত্যিই তো। মহিলাটি রোজ দু’প্যাকেট সিগারেট কিনে নিয়ে যায়। আজকাল দেখছি, মেয়েদের সিগারেট প্রীতি বেড়ে গিয়েছে।
‘রোজ দু’প্যাকেট লাগবে তাই বলে? ভাব, মেয়ে মানুষ রোজ দু’প্যাকেট সিগারেট কেনে। একটু লজ্জাও করে না! দাদা সহ্য করে কী করে!’
শুভায়ু সব শুনে আকাশ থেকে পড়ল। কিছু বলতে পারছিল না। কিন্তু ওর তো বলা উচিত। আর একটা ছেলে বলে উঠল, ‘কীরকম টিচার বোঝ, এই রকম টিচার তার ছাত্র-ছাত্রীদের কী শিক্ষা দেবে?’ আর একজন প্রতিবাদ করল, ‘এটা বাড়াবাড়ি হল তোদের। বাবা সিগারেট খেলে দোষ নেই, মা খেলেই দোষ? খাক না, আমাদের কী?’
শুভায়ু এগিয়ে গেল ওদের দিকে, ‘কিছু বলছ তোমরা?’
‘বলছি, সোজা মোড়ের মাথায় চলে যান, পেয়ে যাবেন। এখানে না পেলে বউদি ওখান থেকেই কিনে নিয়ে যান।’
‘তাছাড়া আর কিছু বলছিলে?’
‘আর কিছু? না তো!’
ঘুরে দাঁড়াল শুভায়ু। এদের সঙ্গে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল ও। তাড়াতাড়ি ফিরতে চাইছিল লিলির কাছে।
পিছন থেকে একটা কথা উড়ে এল, ‘দাদা কেমন হন্তদন্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছে দেখ। মুখটা কেমন মিইয়ে গেছে। সিগারেট না কিনেই ফিরে গেল।’
এই কথাটা সমর্থন করে খ্যাঁক খ্যাঁক করে খ্যাঁকশেয়ালি হাসি হাসল আর একজন, ‘বউয়ের কাছে প্রচুর ঝাড় খাবে আজ।’
শুভায়ু ঘরে ঢোকামাত্র লিলি বলে উঠল, ‘পেয়েছ, তোমার টরেগাসি?’
‘আজ থেকে আমি সিগারেট ছেড়ে দিলাম লিলি।’
‘তাই টরেগাসি না বলে সিগারেট বললে? পারবে না ছাড়তে, বোলো না।’ লিলির ঠোঁটের ফাঁকে বিষণ্ণ কৌতুক। শুভায়ু কিন্তু খুব গম্ভীর হয়ে আছে। মনে মনে ভাবছিল, মেয়েরা যত ভালো মনেই কাজ করুক, যত স্যাক্রিফাইসই করুক, সমাজ মেয়েদেরই দায়ী করে। তাদেরই দোষ দেয়।
সমাজটাকে কি পাল্টানো যায় না? সে তো একজন লেখক, দায় তো তারও আছে। নিজের কলমটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। এই-ই তার একমাত্র শক্তি। কলমেই ও এর জবাব দেবে। উপন্যাসটা শেষ হোক। তারপর। আপাতত পাড়ার ছেলেগুলোর ভুল ধারণার প্রতিবাদে সিগারেটটা ছাড়বে।
‘কী ভাবছ? কতজন কতবার করে সিগারেট ছাড়ে, আবার ধরে।’
‘লিলি, যারা বার বার ছাড়ে তারা কখনওই ছাড়ে না। আমি একবারই ছাড়লাম, এক্কেবারে।’