কর্মে অগ্রগতি ও নতুন কাজের বরাত প্রাপ্তি। আইটি কর্মীদের শুভ। মানসিক চঞ্চলতার জন্য বিদ্যাচর্চায় বাধা। ... বিশদ
প্রশান্ত মহাসাগর— এপারে আমেরিকা ওপারে জাপান। আমরা আছি আমেরিকার দিকে হাইওয়েতে। পুত্র সুজন তার কর্মস্থল সিয়াটেল থেকে গাড়ি চালিয়ে চলেছে। আমি আর সুনন্দা। বাবা আর মাকে নিয়ে সে চলেছে। সান্তা বারবারার দিকে। গন্তব্য সেখানেই।
সকালে সিয়াটেল থেকে শুরু হয়েছে আমাদের যাত্রা। ডানদিকে প্রশান্ত মহাসাগর, বাঁদিকে উঁচু পাহাড়-অরণ্য। সুন্দর দৃশ্য। গাড়ির সংখ্যা খুব বেশি নয়। এদেশে সকলকেই আইন মেনে গাড়ি চলতে হয়।
সহসা আমার মনের মধ্যে খেলে গেল এক অসীম নীল বিস্তারের রহস্যময় রূপ। আমাদের গ্রহের সবচেয়ে বিশাল এই মহাসাগর। পৃথিবীর তিরিশ শতাংশ এলাকা অধিকার করে রয়েছে এই মহাবিস্ময়। পৃথুলা বিশ্বের গভীর বিস্তৃত সুনীল সিন্ধু।
তাহলে আমাদের গর্ব শুধু মানুষ বলেই, এর মাহাত্ম্য আমরা সবাই উপভোগ করতে পারছি। মনুষ্য জন্ম আমাদের সার্থক। এই বিশ্বের সমগ্র মানবজাতির।
আমাদের গাড়ি এখন এসে থামল এই সাগরের পাড়ে। এখানে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। আমরা দু’চোখ ভরে দেখলাম, এই সমুদ্রের ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস। যেন লম্ফ দিয়ে আকাশ ছোঁবে এমন উলম্ফন।
এরপর আমরা এগিয়ে গেলাম একটি মোটেলে— যেখানে আমরা আজ রাত্রিবাস করব। এখানে ঢুকে পড়লাম সংলগ্ন একটি রেস্তরাঁয়। সেখানে সমুদ্রের দিকটা কাচের দেয়াল। প্রশান্ত মহাসাগরের উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই আমাদের দেখতে পেয়ে। কাচের দেওয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আমরা তো বিস্ময়ে হতবাক। আরও অবাক হবার মতো রসদ আছে। যখন প্রশ্ন উড়ে এল— তোমরা কি কখনও ঝিনুকের মাংস খেয়েছ?
সুনন্দা তাজ্জব হয়ে বলে— ঝিনুকের মাংস? জীবনে কোনওদিন দেখিইনি বাবা, খাওয়া দূরঅস্ত। আমি ওসব খেতে পারব না।
—বেশ তোমার জন্য আলাদা খাবার বলছি? মেক্সিকান রাইস খেয়ে দেখো!
আমি বলি— মেক্সিকোয় ধান চাষ হয় প্রচুর পরিমাণে, কাজেই ওরা ভাতের ভক্ত আমাদের মতো।
— হ্যাঁ, ওদের প্রিপারেশন কিন্তু আলাদা।
সুনন্দা বলে— ভয় দেখাস না বাবা, ভাত তো ঠিক খেয়ে নেব।
অতএব মেক্সিকান রাইস অর্ডার দেওয়া হয়।
এবার মিটিমিটি হাসির সঙ্গে আমার দিকে প্রশ্ন উড়ে এল, কী বাবা, আমি তো গেঁড়ি-গুগলি-শামুক-ঝিনুক দিয়ে টোস্ট খাব, তুমি?
আমিও হেসে বলি— কী ভেবেছিস আমি ভয় পাব? তোর আর আমার একই অর্ডার যাবে। আমি সানন্দে হাত বাড়িয়ে দিই, ওর হাতের পাঞ্জা এগিয়ে এসে করমর্দনে মিশে যায়।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নানান রকম অ্যাপেটাইজার এসে পড়ে। আমরাও তার সদ্ব্যবহারে আলস্য করি না। হালকা স্যুপ আর তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক সমস্ত রকম আস্বাদ বাড়ানোর ব্যবস্থা।
আমরা একসঙ্গে উপভোগ করি মূল আহার খাওয়ার আগেকার এই খিদে বাড়াবার প্রক্রিয়া। ধীরে ধীরে ক্ষুধা বৃদ্ধি হতে থাকে।
এরপরে একে একে সুসজ্জিত টেবলের সঙ্গে মানানসই সব খাবার। ধূমায়িত গেঁড়ি-গুগলি-ঝিনুক ইত্যাদির দুটি প্রশস্ত প্লেট। আর একটা রোল। সেই রোল খুলতেই মেক্সিকান রাইস বেরিয়ে আসে। তবে তার দুটি স্তর-মেশামেশি। তার রং দেখে তো বেশ ভয় লাগে। বেশ ঝাল হবে নাকি? রংটা লাল আর সেই ভাতের সঙ্গে কিছু সব্জি-মাংস।
চামচে করে কিছুটা মুখে দেয় সুনন্দা। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখটা স্থির আর চোখে জল এসে পড়ে। তারপর আর ঝালের এক্সপ্রেশন না দিয়ে পারে না— উঃ, সমস্ত মুখ জ্বলে যাচ্ছে। সুজন একটা এমন ঝোল এগিয়ে দেয় বাটিতে, সুনন্দা চুমুক দিয়েই বলে— আঃ, এবার খুব সুস্বাদু লাগছে।
এরপর আমরা তিনজনেই খুব রেলিশ করে সানন্দে খাই।
খুব ধীরে ধীরে এক সুন্দর অনুভূতি আমার মনের মধ্যে, রক্তপ্রবাহে ছড়িয়ে যেতে থাকে। এক আন্তর্জাতিক স্তরের অনুভূতি— আমি আমার স্বদেশকে যেমন ভালোবাসি, তেমনই আমাদের এই বিশ্বের যত দেশ আছে তাদের সকলকেই আমি ভালোবাসি। ভালোবাসতে শুরু করে দিয়েছি। এই বিশাল অনুভূতি যেন দিগন্তলুপ্ত প্রশান্ত মহাসাগরের মতো বিস্তৃত হতে থাকে মনের গভীরে।
আমার গভীর ধ্যানের ভেতর থেকেই যেন আরও তীব্র তৃষ্ণার মতো জেগে ওঠে সান্তা বারবারা। কাল সকালেই ব্রেকফাস্টের পর আমাদের গাড়ি চলবে সেদিকেই।
সকালে যথারীতি ব্রেকফাস্টের পরে আমাদের যাত্রা পুনরায় শুরু। সেই ডানদিকে প্রশান্ত মহাসাগর বাঁয়ে উঁচু পাহাড়। নীল আর সবুজের সমারোহ। এই বিশালত্বের যেন কোনও আহ্বান আছে। আমাদের সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত অবচেতনায় কখনও এমন কম্পন হয়। এমন উদ্ভাসন!
এই মহাসমারোহে আপ্লুত হতে হতে আমরা চলছি। এদিকটাতে জমিজমা খুব কস্টলি, আসলে হলিউডের কাছাকাছি এলাকা। সারা পৃথিবীর দর্শকদের— চলচ্চিত্রের এক বর্ণময় সিন্ধু। না, যদিও সেবার আর হলিউডে যাওয়া হয়নি।
সান্তা বারবারার দিকে যত এগচ্ছি, তত বেশি তালজাতীয় গাছের সারি দেখতে পাচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা শহরাঞ্চলে ঢুকে পড়ি। সুসজ্জিত দোকানপাট, রেস্তরাঁ চোখে পড়ছে। কখনও কোথাও সুন্দর পার্ক, অপরূপ ভাস্কর্য, আর তালগাছ সহ অন্যান্য গাছগাছালি, জলের ফোয়ারা থেকে উচ্ছ্বসিত জলধারা ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত।
দু’দিন কেটে যায় এক সুন্দর চেতনার ভেতরে! এই সুন্দর শহর দেখে, শহর ছাড়িয়েও আরও সজীব পরিবেশের দৃশ্যের মধ্যে অগাধ ধ্যানের মধ্যে লিপ্ত হই, যেন এই গ্রহের মানুষ শুধু নই সমগ্র বিশ্বের অংশ হয়ে যাই। আমার জন্মভূমি বঙ্গদেশ, ভারতবর্ষ। সেই স্বপ্নের ঘোর নিয়ে এখানে ফিরে আসার পালা। ফিরে আসি ফের জন্মভূমিতে। সেই চিরকালীন জল-মাটি-হাওয়া আর সৌন্দর্যে।