গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
ও বেশ কিছুক্ষণ আলো-আঁধারে ওখানকার প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আবছায়া ভাব কেটে গেল। প্রভাত সূর্যের অরুণরাগে একটু একটু করে দিনের আলো ফুটে উঠতেই ঝলমলিয়ে উঠল চারদিক। প্রকৃতির সেই অপরূপ রূপের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা রিকশ নিয়ে সোজা চলে এল বিলাসী টাউনে।
রজনী ওর ছেলেবেলার বন্ধু। ওরা এখানকার বাঙালি। হাওড়া শিবপুরেও ওদের নিজস্ব ঘরবাড়ি আছে। জ্ঞাতিরা সেখানেই থাকেন। অতএব ছোটবেলা থেকেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ। তাই দেওঘরে আসা তমালের কাছে নতুন নয়। তবে এবারের আসাটা ওকে একটু চমক দেবার জন্য। তাই হঠাৎ করে না জানিয়েই এসেছে ও।
দিনের আলোয় এখন চারদিক ঝলমল করছে।
তমাল রিকশ থেকে নেমে ওদের দরজায় নক করতেই রজনীর বউ নিশা এসে দরজা খুলে দিল। তার পরেই চোখ কপালে উঠিয়ে বলল, ‘এ কাকে দেখছি আমি!’
তমাল হেসে বলল, ‘এতদিন যাকে দেখে এসেছ তাকেই দেখছ।’
‘আসুন-আসুন, ভিতরে আসুন। একটা খবর দিয়ে আসবেন তো।’
‘কেন, হঠাৎ করে কি আসা যায় না?’
‘নিশ্চয়ই যায়। কিন্তু যদি কেউ না থাকতাম?’
‘তাহলে অবশ্য একটু বেশি রকম ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যেত। তবে আমি রজনীকে যতটুকু জানি তাতে হুট করেই কোথাও যাবার ছেলে ও নয়। কিন্তু রজনী কই?’
‘এখনই আসছে। শিবগঙ্গার কাছে লিত্তি আনতে গিয়েছে।’
‘এখনও ওর ওই উপাদেয় খাওয়ার নেশাটি গেল না।’
‘ওর সঙ্গে থেকে থেকে আমিও এখন লিত্তিতে মজেছি। আপনিও খেয়ে দেখবেন, দারুণ লাগবে। তার আগে ফ্রেস হয়ে নিন।’
পরিচিত ঘরদোর। ওয়াশরুম থেকে বেরতেই মুখোমুখি হল রজনীর। উল্লসিত রজনী অবাক বিস্ময়ে জোর গলায় বলে উঠল, ‘ভাবতেও পারিনি, এভাবে হঠাৎ করে তুই এসে পড়বি! কী যে আনন্দ হচ্ছে আজ। ফোন করে এলে বাইকটা নিয়ে স্টেশনে চলে যেতাম।’
‘ইচ্ছে করেই ফোন করিনি। মাঝরাত থেকে তুই ভোরের অপেক্ষায় জেগে থাকতিস। তার চেয়ে এই তো বেশ হল। না জানিয়ে আসার চমকটা কেমন মধুময় বল?’
‘তুই প্রায় বছর দুই হল আসিসনি তাই না?’
‘ঠিক তাই। নানা কাজে খুব ব্যস্ত ছিলাম। এখন অনেকটা হালকা হয়েছি। তাই হঠাৎ করেই না জানিয়ে চলে এলাম এখানে।’
‘বেশ করেছিস। সত্যি, কী আনন্দ যে হচ্ছে।’
এইসব কথার মাঝেই নিশা ওদের জন্য চা-বিস্কুট আর গরমাগরম লিত্তি নিয়ে টেবিলে রাখল।
তমাল নিশাকে বলল, ‘তোমার কই?’
‘আনছি। একসঙ্গেই খাব আমরা। লিত্তি খাও তো তুমি?’
‘আমাদের ওখানে কোথায় পাব যে খাব? তবে এখানেই রজনী একবার খাইয়েছিল আমাকে। দারুণ মুখরোচক।’
ওরা দু’বন্ধুতে খাওয়া শুরু করলে নিশাও এসে যোগ দিল। চা-পর্ব শুরু করেই বলল, ‘তা অনেকদিন তো হল, এবার আসল কাজটা কবে হচ্ছে শুনি?’
তমাল বলল, ‘হবে হবে। সময় হলেই হবে।’
নিশা হেসে বলল, ‘না। সময় পার হলেও হবে না আপনার। আসলে আপনাদের ওখানকার মেয়েগুলোও যা-তা। ভালো চাকরি করেন, একা থাকেন, এমন সুদর্শন পুরুষ। কেউ একটু এগিয়ে এসে ফাঁসিয়ে দিতে পারল না আপনাকে? আমি হলে কবেই—।’
এবার ধমকের সুরে গর্জে উঠল রজনী, ‘অ্যাই! খবরদার।’
তমাল হেসে ফেলল।
নিশা বলল, ‘এবার খবরদারিটা আমিই করছি। এই দেওঘরেই যদি এঁকে বন্দি করতে না পারি তো আমার নাম নিশা নয়, মহানিশা।’
এইভাবেই নানা রঙ্গরসে চা-চক্র চলল বেশ কিছুক্ষণ।
রজনী বলল, ‘আর নয়।’ তারপর তমালকে বলল, ‘তুই আর কী করবি, সারারাত ট্রেন জার্নি করে এসেছিস, এখন ঘরে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নে।’
তমাল বলল, ‘আমার প্রকৃতি তুই তো জানিস। দিবানিদ্রা আমার হয় না। আমি বরং এদিক সেদিক করে একটু চক্কর দিয়ে আসি।’ বলে উঠে দাঁড়াতেই নিশা বলল, ‘এখনই কী? দুটো লিত্তিতে কি পেট ভরে? আপনার জন্যে কয়েকটা লুচি, হালুয়া আর ঘরে প্যাঁড়া আছে এনে দিই। লুচি, হালুয়া অবশ্য বানাতে হবে। একটু বসে যান।’
অতএব বসতেই হল।
রজনী বাজারের ব্যাগ নিয়ে চলে গেলে নিশা খুব তৎপরতার সঙ্গে লুচি হালুয়া তৈরি করে ফেলল। জলযোগ পর্ব শেষ করল তমাল। তারপর হাত নেড়ে বিদায় নিল বাইরের জগতের সঙ্গে মিশে যাবে বলে।
ঘর থেকে বেরিয়ে প্রথমেই শিবগঙ্গায় এল তমাল। এই জায়গাটা ওর খুব ভালো লাগে। এখানে স্নানের তৃপ্তি মনে রাখার মতো। তবে এই ফাল্গুনে শীতের আমেজ থাকায় স্নানের ব্যাপারটা আর চিন্তা করল না।
শিবগঙ্গা পার হয়ে বাবা বৈদ্যনাথের মন্দির বাঁয়ে রেখে একসময় বড় রাস্তায় এল।
এখানে এসে একটা দোকানে বসে মশলা দেওয়া চা খেল। জায়গাটা খুবই জমজমাট। তাই এদিক-সেদিক ঘুরে হঠাৎই একটা রিকশ ডেকে বলল, ‘নন্দন পাহাড়।’
রিকশ এগিয়ে চলল। ওর মনের মতো জায়গা নন্দন পাহাড়। পাহাড় হলেও আসলে ওটা একটি টিলা। পাহাড়ের উপরে ছোট্ট একটি মন্দিরও আছে। জায়গাটা অত্যন্ত নিরিবিলি। দেওঘরে এলেই ও এখানে বসে সময় কাটায়। দূরের পাহাড়, রেলপথ, মাঝে মাঝে ট্রেনের আসা-যাওয়াও দেখতে পায়। আর দিনে দিনে গড়ে ওঠা দেওঘরের শহর সৌন্দর্যও দু’চোখ ভরে দেখে।
ও নিশ্চিন্ত হয়ে এক জায়গায় বসে দূরের বনে পাহাড়ে শিমুল, পলাশের অনবদ্য রূপ নয়ন ভরে দেখতে লাগল। সেগুলো ফুলে ভরে লালে লাল হয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে কতক্ষণ যে তন্ময় হয়েছিল ও তা কে জানে? হঠাৎই তাড়া খেয়ে কতকগুলো মেষ শাবক ওর দিকে ছুটে এলে সেগুলোকে ধরবার জন্য বিদ্যুৎ চমকের জন্য যে এল তাকে দেখেই স্থির হয়ে গেল তমাল। সে-ও এই নির্জনে মন্দিরের চাতালে বসে থাকা সম্পূর্ণ অজানা অচেনা একজনকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল।
তমালের দু’চোখে পাতা পড়ল না যেন। মেষ পালিকাদের মেয়ে বলেই মনে হল। ষোড়শী কি অষ্টাদশী। বেঁটে খাটো চেহারা। মলিন বসন। চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রং। আর মুখশ্রী? তার যেন তুলনা নেই। পূর্ণিমার ভরন্ত চাঁদ যেন শোভা পাচ্ছে সেখানে। এই নির্জনে এমন এক মেয়েকে দেখে তমাল যেমন চোখ ফেরাতে পারল না, মেয়েটিরও তমালকে দেখে বিস্ময়ের শেষ রইল না। তমালের মুগ্ধতা মেয়েটির চোখে মুখেও ফুটে উঠল। সে এক পা এক পা করে একটু পিছিয়ে এক জায়গায় বসে বারে বারে আড়চোখে দেখতে লাগল ওকে। এদিকে তমালেরও মেয়েটিকে দেখে বুকের গভীরে যেন জ্বালা ধরে গেল।
সামান্য কিছুটা সময়। এরই মধ্যে অনেকগুলো ছাগল ভেড়া নিয়ে আরও কয়েকজন মেয়ে ছুটে এল এদিকে। তাদেরই একজন একটু দূর থেকে হাঁক দিল, ‘চাঁদনি, তু কাঁহা গয়ি?’
মেয়েটি আর একবার লাজুক লাজুক মুখে ওর দিকে তাকিয়ে হেঁকে বলল, ‘ম্যায় ইধার হুঁ। ইঁয়া পর।’
সবাই এলে ও উঠে দাঁড়াল। তারপর আরও একবার তমালের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওদের সঙ্গে এদিক সেদিক করতে লাগল।
তমালের বুকে তখন জ্বালা ধরেছে। রঙের আগুন দেখতে এসে ওর মনেও শেষে রং ধরল নাকি? মেয়েটিও যেন কেমন হয়ে গেল ওকে দেখে। ও-ও কি তাহলে ওরই মতো জ্বলছে? কিন্তু জ্বলনের উপশম কী করে হবে? ওর দিকে এগবেই বা কী করে? ওদের সমাজব্যবস্থা কীরকম তা তো জানে না ও। অতএব—।
আর এখানে বসে থাকা নয়। এবার স্থান ত্যাগ করতেই হবে। বনের পাখি বনে থাক। মনের খাঁচায় ওকে বন্দি করে চলে যাওয়াই ভালো।
মন্দিরের চাতাল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অবতরণ শুরু করল তমাল। অর্ধপথে এসে একবার উপরের দিকে তাকাতেই দেখল শুধু চাঁদনি নয় ওর সঙ্গিনীরাও দূর থেকে ঝুঁকে পড়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে।
পাহাড় থেকে নেমে বাঁদিকে কয়েকটি ঝোপড়ি বস্তি পার হয়ে বড় রাস্তায় এল। সেখান থেকে একটা রিকশ নিয়ে সোজা বিলাসী টাউনে।
দরজা খোলাই ছিল। তাই ধীর পায়ে উপরে উঠতেই নিশা বলল, ‘কোথায় কোথায় ঘুরলেন?’
‘কোথাও নয়। শুধু আমার প্রিয় নন্দন পাহাড়ে উঠে চুপচাপ বসে বসে দূরের প্রকৃতি দেখছিলাম। ওই জায়গাটা আমার এত ভালো লাগে যে, মনে হয় ওখানেই কোথাও একটা ঘর করে থাকি।’
‘বিয়ের পর প্রথম প্রথম আমিও যেতাম ওদিকে। এখন আর যাই না। যাক, এতটা পথ ঘুরে এলেন এখন একটু চা কিংবা কফি করি?’
‘যা তোমার ইচ্ছা।’ বলেই ওয়াশ রুমে গিয়ে মুখ হাত পা ধুয়ে ওর বিছানায় এসে দেহটা এলিয়ে দিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি নিয়ে এল নিশা।
তমাল বলল, ‘বাইরে টেবিলে রাখো না। ওখানেই যাচ্ছি।’
নিশা দালানের টেবিলে কফি বিস্কুট রাখলে তমাল এসে বসল। তারপর কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘রজনী কোথায়? ওকে দেখছি না কেন?’
‘ও গিয়েছে সঙ্গীতালয়ে। কাল ওদের বড় অনুষ্ঠান। তারই মহড়া দিতে। অনেক নামীদামি শিল্পীর সমাবেশ হবে কাল। যাবেন তো?’
‘অবশ্যই।’
‘আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব। আমার বান্ধবী বা পরিচিতরাও যাবে। দেখি, ওখানেই যদি কারও সঙ্গে আপনার বন্ধুত্বের সম্পর্ক একটা পাতিয়ে দিতে পারি তো নিশ্চিন্ত হব আমি।’
‘বলো কী?’
‘হ্যাঁ। রূপের খনি সব। ওদেরই যে কোনও একজনের সঙ্গে চিরস্থায়ী সম্পর্ক একটা করে দেবই। এটা আমার চ্যালেঞ্জ।’
তমাল মৃদু হেসে বলল, ‘তোমার অসাধ্য যে কিছুই নেই তা বেশ বুঝতে পারছি। আজ নন্দন পাহাড়ে গিয়ে এমন একজনের চোখে চোখ রেখেছি যাকে দেখার পর থেকে আমার মধ্যে আর আমি নেই। সবসময় সে আমায় ভাবাচ্ছে। দেখলে না ঘরে এসেই আমি শুয়ে পড়লাম।’
অবাক বিস্ময়ে নিশা বলল, ‘কে সেই ভাগ্যবতী?’
‘যার সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে তোলা কখনওই সম্ভব নয়। সে এক মেষ পালিকা মেয়ে। দেহাতি। ঝোপড়ির ঘরে থাকে। কিন্তু আমার চোখে সে রাজরাজেশ্বরী। কিন্তু সে বা ওর পরিবারের লোকরা কি আমাকে মেনে নেবে?’
‘নাম জেনেছেন তাঁর?’
‘চাঁদনি।’
‘ওর ব্যাপারে আমি দেখছি। যদি ইতিমধ্যে ওর পরিবারের পক্ষ থেকে অন্য কোথাও ব্যবস্থা না হয়ে থাকে তাহলে ওর দায়িত্ব আমার হাতে।’
তমাল বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘তুমি চেনো ওকে?’
‘না। দেখিওনি কখনও। এখন আপনি ঘরে গিয়ে বসুন, আমি আসছি।’
তমাল বুঝল নিশার অসাধ্য কিছু নেই। তাই চুপচাপ ঘরে গিয়ে শয্যা নিল।
একটু পরেই ফিরে এল নিশা। বলল, ‘রমেশ যাদবকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছি। ও ফিরে এসে শুভ সংবাদটা দিলেই দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আপনাকে নিয়ে আমি গিয়ে আশীর্বাদ করে আসব চাঁদনিকে।’
তমাল বলল, ‘আমি নয়। রজনীকে নিয়েই যেও তুমি।’
নিশা হেসে বলল, ‘কী বুদ্ধি! আপনি না গেলে হয়? ভুলবশত যদি ওই নামের আর কোনও মেয়েকে আশীর্বাদ করে আসি, তখন তো সবই ওলট-পালট হয়ে যাবে।’
‘সত্যি, এটা কিন্তু ভেবে দেখিনি।’
‘এবার থেকে যা করবেন ভেবেচিন্তেই করবেন।’
সত্যি কথাটা বলে মনের বোঝাটা একটু হালকা করলেও ওদিক থেকে সুখবরটা না আসা পর্যন্ত উৎকণ্ঠা একটা রয়েই গেল।
অনেক পরে রজনী এসে নিশার মুখে তমালের ব্যাপারটা শুনেই বিস্ময় প্রকাশ করল। তমালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ রে, যা শুনছি তা কি সত্যি?’
‘সত্যি। ওকে দেখার পর কী যে হল আমার, তা আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।’
বলার সঙ্গে সঙ্গেই সিঁড়িতে পদশব্দ।
নিশা আগ্রহ নিয়ে ছুটে গেল দরজার কাছে, ‘কী হল রমেশভাই? সুখবর তো?’
রমেশ ভিতরে এসে বলল, ‘সুখবর না হলে কি এভাবে ছুটে আসতাম? ওরা রাজি। শুধু রাজি নয়, এককথায় রাজি। হরিরাম যাদবের মেয়ে ও। আজ সকালে এই বাবুজিকে দেখার পর ওর মনেও রং ধরে গিয়েছে। সে কথা অন্য মেয়েদের কাছে বলেওছে। এ নিয়ে তারাও আলোচনা করছে খুব। তবে কিনা এই বাবুজি তো আকাশের চাঁদ, তাই—।’
নিশা বলল, ‘চাঁদ বলেই তো চাঁদনিকে মনে ধরেছে ওর।’
রমেশ বলল, ‘তবে বাবুজি, একটা কথা। ঝোপড়ির বাসিন্দা। ভেড়া, ছাগল পালন করে দিন কাটায় ওরা। খুবই গরিব। ওই মেয়ের রূপ দেখে কতজনে শাদির প্রস্তাব দিয়েছিল ওর বাবাকে। কিন্তু ওর উপযুক্ত না হওয়ায় হরিরাম না করে দিয়েছে সবাইকে। বলেছে, এমন রূপের খনিকে কি যার তার হাতে তুলে দেওয়া যায়? তা আপনারা যদি দয়া করে ওই মেয়েকে চরণে স্থান দেন তা হলে তো বর্তে যায় ওরা। রূপে গুণে লক্ষ্মী মেয়ে। একেবারে আনপড়ও নয়। ছ’ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে।’
নিশা হেসে বলল, ‘তাও হিন্দিতে। কী বলো?’
‘হ্যাঁ, বহিনজি।’
‘ঠিক আছে। তুমি গিয়ে খবর দাও, আজ বিকেলেই আমরা যাচ্ছি চাঁদনিকে দেখতে। তখনি আশীর্বাদের কাজটাও সেরে আসব।’
রমেশ গদ গদ হয়ে বলল, ‘আমি এখনই যাচ্ছি খবর দিতে। এই শুভ সংবাদে ওদের বস্তির সবারই খুব আনন্দ।’
রমেশ চলে গেলে দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে একটা টাঙ্গা ডেকে যাত্রা শুরু করল ওরা। তিনজনে যাত্রা শুভ নয় বলে নিশা ওর এক বান্ধবীকেও সঙ্গে নিল। নন্দন পাহাড়ের গ্রামে পৌঁছতেই রমেশ যাদবের সঙ্গে ওদের সবাই মেয়ে-পুরুষসহ যারা ছিল হাতে ফুল নিয়ে এগিয়ে এল। শঙ্খধ্বনিও করল সবাই। খাটিয়া, মোড়া যা ছিল তাতেই গাছতলায় বসতে দিল সকলকে। বস্তিবাসী ও ঝোপড়ির লোকেরা গোল হয়ে ঘিরে ধরল ওদের।
রমেশ যাদব হরিরামের হাত ধরে নিয়ে এসে বলল, ‘চাঁদনির বাবা।’
নিশা হেসে বলল, ‘আমরা তো বাবাকে দেখতে আসিনি? চাঁদনি কই?’
পরক্ষণেই ওর মা অনেক আদরে নিয়ে এল চাঁদনিকে।
চাঁদনির রূপের ছটায় নিশার দু’চোখ যেন ঝলমলিয়ে উঠল। অস্ফুটে বলল, ‘এত রূপ কারও হয়!’ বলেই তমালের একটা হাত ধরে কাছে টেনে বলল, ‘এই তো—সেই?’
তমাল মৃদু হেসে মাথা নত করল।
নিশা তখনই ওর গলার দামি হারটি খুলে পরিয়ে দিল চাঁদনির গলায়। বলল, ‘আজ থেকেই তুই আমাদের পরিবারের একজন হলি।’
আনন্দে চাঁদনির চোখে তখন জল এসে গিয়েছে। সে একবার তমালের দিকে তাকিয়ে নিশার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।
নিশা বলল, ‘এবার প্রণাম কর তোর পতিদেবতাকে। ওর জন্যই তো সব।’
চাঁদনি আর একবার তমালের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রণাম করতেই শঙ্খধ্বনিতে ভরে উঠল চারদিক।