বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
১৬
‘আমাকে চিনতে পারছেন? মনে পড়ছে না আমাকে?’
কত বার কত জায়গাতেই না এ প্রশ্ন শুনেছি। জীবনে একবারই যাকে দেখেছি তার মুখ মনে না থাকারই কথা। আপাতনিরীহ এই প্রশ্ন বিশেষ পরিস্থিতিতে শিরদাঁড়ায় হিমেল স্রোত বইয়ে দিতে পারে, যদি ব্যক্তিটি হন ট্রেন কনডাক্টর, জায়গাটা হয় চলন্ত ট্রেনের কামরা, আর আমার সঙ্গী দুই শিশুর একজন ওয়েট লিস্টেড। তাকিয়ে থেকে মনে পড়ল, হ্যাঁ, তিনিই তো। সেই চশমা, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, তথৈবচ গোঁফ। মেটাল ফ্রেমের চশমার পিছনে জ্বলজ্বলে চোখ। সামনের একটা দাঁত নেই। ভোলা উচিত হয়নি মোটেই। মুখটা মনের মধ্যে বাঁধিয়ে রাখা উচিত ছিল।
প্রথম দেখা ১৯৮৮-র কোনও এক গ্রীষ্মকালে। রাতের ট্রেনে যাচ্ছি সম্বলপুর থেকে কলকাতা। সঙ্গে বয়স্ক শ্বশুরমশাই। এসি সহ্য হয় না। তাই ফার্স্ট ক্লাসের উপর নীচের দুটো বার্থ নেওয়া। চার বার্থের কুপ। ট্রেন ছাড়ার পর টিটিই এলেন, আমাদের টিকিট দেখলেন এবং উল্টো দিকের খালি দুটি বার্থের দিকে সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করে বিদায় নিলেন। সেই দৃষ্টিপাতের মর্ম বোঝা গেল মাঝরাতে আমরা যখন গভীর ঘুমে। উক্ত টিটিই হইহই করে আরও চারজন যাত্রীকে নিয়ে হাজির হলেন। দুটো বার্থে দু’জন করে। পাটিগণিতের হিসেব। ঘুমচোখে উঠে বসে প্রতিবাদ করলাম। কুপে চারজনের বেশি যেতে পারবেন না।
এটা কোথায় লেখা আছে? টিটিই বললেন, আপনি আপত্তি করছেন কেন? এরা যদি দু’জন করে নিজেদের বার্থে অ্যাডজাস্ট করেন আপনার কীসের আপত্তি?
চারজনকে ঢুকতেই দেব না, আমি নিজের নৈতিক অবস্থানে অনড়। এত টাকা দিয়ে টিকিট কাটা কি এই জন্য? যাত্রী চতুষ্টয়ের ঈষৎ বেসামাল অবস্থা এবং মুখের আসব গন্ধ আমি উপেক্ষা করতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত আমার জেদ বজায় থাকল। রাগত কনডাক্টর এবং যাত্রীরা বেরিয়ে গেলেন। বাকি রাতটা জেগেই কাটল। সকালে শ্বশুরমশাইকে নিয়ে পৌঁছলাম কলকাতার বাসায়। আমার বাবা স্বল্পভাষী মানুষ। সারা জীবনে কটি বাক্য আমার সঙ্গে বিনিময় করেছেন তা হাতে গোনা যায়। কিন্তু একটি অভ্যেস তিনি আমার মজ্জায় দিয়ে গিয়েছেন। লিখিত অভিযোগ জানানোর পদ্ধতি। রুল টানা কাগজে সুন্দর হাতের লেখায়, সুভদ্র ইংরেজিতে নিজের বক্তব্য লিখে জমা দেওয়া।
ছোটবেলায় একবার দোকানদার আমাদের মাসকাবারি বাজারে একটা মেয়াদ ফুরোনো ‘রোজ’ সিরাপ দিয়েছিল। রেফ্রিজারেটর বিহীন আনন্দময় শৈশবে দইয়ের ঘোলে বরফ আর সিরাপ মিশিয়ে খাওয়া ছিল আমাদের রবিবার বিকেলের বিলাস। সেই কোম্পানিকে উপভোক্তার অধিকার নিয়ে দীর্ঘ চিঠি লিখে বাবা দু’বোতল সিরাপ উপহার পেয়েছিলেন। তাতে আমাদের পারিবারিক মনোবল আরও বেড়ে যায়।
কলকাতায় পৌঁছে আমি বাবার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজারকে একটি দীর্ঘপত্র লিখলাম। রাতের সব ঘটনা ও ট্রেন কনডাক্টরের আচরণ জানিয়ে। তারপর আমার পরিচিত গাড়িচালক গৌরাঙ্গর অ্যাম্বাসাডরে চেপে চিঠিটি দিয়েও এলাম। বলাই বাহুল্য তখন মোবাইল আসেনি, কম্পিউটার অফিসে কয়েকটা থাকলেও বাড়িতে নেই। তাতে কী? হাতে তো আমি তরতরিয়ে লিখি, ঝর্ণা কলম দিয়ে! নানা কাজে ভুলেই গিয়েছিলাম এই সব ঘটনা। মাস ছয়েক পর জেনারেল ম্যানেজারের অফিস থেকে একটি টাইপ করা চিঠি পেলাম। আমার চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করা হয়েছে এবং লেখা হয়েছে, আমার অভিযোগের যথাবিহিত তদন্ত হচ্ছে। দু’বোতল সিরাপ পাওয়ার মতন জবাব পেয়েই আমি খুশি এবং যথারীতি সব ভুলেই গিয়েছি।
ইতিমধ্যে দু’বছর কেটে গিয়েছে। শিশুরা একটু বড়। তাদের নিয়ে যাব কলকাতা। তাড়াহুড়োয় যাওয়া ঠিক হয়েছে। আমার রিজারভেশন কনফার্মড। কন্যা আরএসি, অর্থাৎ খালি হওয়া বার্থের হকদার। ছেলে ওয়েট লিস্টেড। আমার মন খুঁতখুঁত করছে। যাতায়াতে এসব কোনও সমস্যাই নয়, যদি টিটিই-কে প্রসন্ন রাখা যায়। যদি দিন-রাত জোড়া যায়, আমি জীবনের প্রথম অর্ধশতকের তিনভাগের একভাগ ট্রেনেই কাটিয়েছি। নাকি গত জন্মে পরাধীন ভারতের ট্রেনে বিনা ভাড়ায় যাতায়াত করতাম, তাই এ জন্মে বকেয়া ভাড়া রেল কোম্পানিকে শোধ দিচ্ছি। যাইহোক, যতবারই ট্রেনে চাপি না কেন, বিনা রসিদে রেল কোম্পানির কাউকে টাকা দেব না এই আমার নীতি। কাজেই বিনা রিজার্ভেশনে হুট করে কখনও রেলগাড়িতে চড়ে বসি না। জায়গা তো হয়ে যাবে। মেয়ে ছোট, আমার পাশেই শোবে। কিন্তু টিটিই আপত্তি করতে পারেন। ওয়েট লিস্টেড প্যাসেঞ্জারের চড়ার কথা না। অফিসের সহকর্মীরা উদার। বললেন, ছোট বাচ্চাকে নামিয়ে দেবে নাকি ট্রেন থেকে? তাই কখনও হয়? আপনি নিশ্চিন্তে চলে যান। ট্রেন ছাড়ল। সেকেন্ড এসির পর্দা ফেলা কামরা। দুই শিশু ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি হাতে বাংলা লিটল ম্যাগাজিনের বিশেষ সংখ্যা নিয়ে মৌজ করছি। ওয়েট লিস্টের কথা ভুলে গিয়েছি। অনেক রাত হল। টিকিট দেখতে কেউ আসেনি। হয়তো আসবে না। এমন সময়, পর্দার প্রান্ত দু’আঙুলে তুলে ধরে উঁকি দিয়েছে সেই মাথা।
‘চিনতে পারছেন? মনে পড়ছে না আমাকে?’ মনে যখন পড়ে গিয়েছে, মিথ্যে বলার কী দরকার? ইনি সামনের খালি লোওয়ার বার্থে গুছিয়ে বসেছেন। কোলের উপর কাগজপত্র, রসিদ বই।
‘সেই যে সম্বলপুর এক্সপ্রেসে...’
‘হ্যাঁ।’
চশমার উপর দিয়ে জ্বলজ্বলে চোখ দুটো আমাকে দেখছে। ‘আপনি লিখিত কমপ্লেন করেছিলেন। ঠিক তো?’
‘আমি সাসপেন্ড হয়ে গেলাম। চাকরিটা বেঁচেছে কোনওমতে। একবছর পর ডিউটি জয়েন করতে দিয়েছে।’
হাসলে সামনের ভাঙা দাঁতটা প্রকট হল।
‘ও কিন্তু ওয়েট লিস্টেড।’
ঘুমন্ত মেয়ের দিকে মুখ ঘোরাই।
‘জানি। ওদের ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা করছিলাম। বালাসোরে একটা বার্থ খালি হবে। আমি অ্যালট করে দিচ্ছি।’
বসে বসে অনেক কথা বললেন। বাড়িতে ভালো লাগে না। ট্রেনে ট্রেনেই থাকতে ইচ্ছে করে পুরোটা সময়। স্ত্রীর শরীর ভালো থাকে না। ছেলেটা মানুষ হল না। কোনওমতে স্কুল পেরিয়েছে। কলেজ যায় না। কুসঙ্গে পড়েছে বুঝতে পারি। কিন্তু কিছু করতে পারছি না। কাঁচা টাকা যা রোজগার করি, সব উড়ে যায়। কোনও এক রাতের অসদাচারণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা? নাকি পিতৃহৃদয়ের বিষাদ?
বালাসোরে চাওয়ালা নিজেই খুঁজে চলে এল। টিটিই-র খুব প্রতিপত্তি ট্রেনে। জোর করে পয়সা গুঁজে দিতে হল হাতে। কিছুতেই নেবে না। অত রাতের চা। অভ্যেস নেই। নমস্কার করে বিদায় নিলেন তিনি। টিকিটে ঘসঘস করে বার্থ নম্বর লিখে দিলেন। ঘুম আর এল না তারপর। দু’বছর আগেকার এক রাতের মতন।
তবে এ এক অন্য রকমের জেগে থাকা।