রেলগাড়ি ঝমা ঝম
কাকলি দেবনাথ
পিয়ানোর সুরেলা টুং টাং আওয়াজ। রান্না ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে মোবাইলটা দেখলাম।
তিতাসের মেসেজ— তা হলে আমি অনলাইনে টিকিট কেটে নিচ্ছি?
রিমার মেসেজ ঢুকে পড়েছে— আরে না, না। এতদিন পরে দেখা হবে, ছোটবেলার মত শুধু খাব আর গল্প করব। সিনেমা দেখে ফালতু সময় নষ্ট করব না।
আমি টাইপ করলাম— কোথায় মিট করব আমরা?
রিমার পছন্দ কোয়েস্ট মল, আমার নন্দন। তবে, তিতাসের শপিং মল এক্কেবারে না-পসন্দ। ওর ইচ্ছে ইকো পার্ক।
শেষ পর্যন্ত অনেক জল্পনা কল্পনার পর ঠিক হল, যে যার মতো আগে নিউ মার্কেটে চলে যাব। তারপর ওখানে গিয়ে ডিসাইড করব, সারাদিন আমরা কীভাবে কাটাব।
রিমা, আমি আর তিতাস। তিন বান্ধবী। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকে একসঙ্গে বড় হয়ে ওঠা। স্কুলে একসঙ্গে টিফিন ভাগ করে খাওয়া, কিতকিত, মুরগি লড়াই, খো খো খেলা। ক্লাসে এক বেঞ্চে বসে বকবক করার জন্য কতবার তিনজনকে ক্লাস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ওই রকম শাস্তি পেয়ে আমাদের তো তখন খুব আনন্দ হতো। পরে পরে অবশ্য আমাদের তিনজনকে একসঙ্গে কোনও শাস্তি দেওয়া হতো না। একজনকে ক্লাসের বাইরে পাঠানো হতো তো অন্যজনকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো। আর একজনকে মিসের সামনে নিলডাউন করে দেওয়া হতো। কৈশোর পার করে যৌবনে পা রাখার মুহূর্তের পরিবর্তনগুলো একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নিতাম আমরা। না, কখনও লজ্জা বা বিরক্ত লাগেনি। মনে হয়েছে এটাই স্বাভাবিক। বরং ওদের কাছে কিছু লুকোলে কেমন অপরাধ বোধে ভুগতাম। তিনজনের মধ্যে ঝগড়া যে হতো না তা নয়। তবে তা কখনই দীর্ঘস্থায়ী হতো না। যতক্ষণে ওদের কাছে মনের সব কথা উজাড় করে বলতে না পারতাম, ততক্ষণ শান্তি হতো না। যখন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম। রিমা আমাদের থেকে অনেক ভালো রেজাল্ট করল। ইচ্ছে করলেই কলকাতার কোনও নামী কলেজে পড়তে পারত। ওর মা-বাবারও সেই রকমই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রিমা জেদ ধরে বসল, ‘আমি তোদের কলেজেই পড়ব, না হলে পড়া ছেড়ে দেব।’ শেষ পর্যন্ত তিনজনে একই কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। ভিড় ট্রেনে, বাসে, রাস্তার জ্যামে দাঁড়িয়ে আমরা তিনজনে গল্প করতাম। অনর্গল কথা বলতে পারতাম সে সময়। এখনকার মতো একটা কথা বলার আগে মনে মনে পরিকল্পনা করতে হতো না। কত বিষয় নিয়ে যে কথা বলতাম তখন— কখনও সিনেমার নায়ক তো কখনও ক্রিকেট প্লেয়ার। আবার কখনও আমাদের আলোচনার বিষয় হতো পাশে দাঁড়ানো লাজুক লাজুক মুখের ছেলেটা অথবা সিটে বসে বিশাল ভুঁড়ি নিয়ে হাঁ করে নাকডাকা কাকু। কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিই আমাদের গল্প করা বন্ধ করতে পারতো না।
(দুই)
কাল সারা রাত ভালো করে ঘুম হয়নি। কত দিন পরে দেখা হবে তিনজনের। প্রায় ছাব্বিশ বছর পর। ফেসবুকে তিতাস আর রিমা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। তিতাস খুব সুন্দরী ছিল। কলেজে কত ছেলে যে ওকে প্রেম নিবেদন করেছে তার ইয়ত্তা নেই। এমনকী ইয়াং প্রোফেসররাও ওর দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকাত। নিশ্চয়ই খুব বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে হয়েছে ওর।
আর রিমা? টম বয় মার্কা লুক ছিল। কত স্বপ্ন ছিল ওর চোখে। বিদেশে যাবে, রিসার্চ করবে। আমিই ছিলাম তিনজনের মধ্যে অতি সাধারণ। সেই কারণেই কী... যখন থেকে প্ল্যান হয়েছে দেখা করার, মনের মধ্যে আনন্দ হলেও কেমন একটা আড়ষ্ট ভাব বুকের কাছে সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে। কিন্তু যখন কলেজে পড়তাম, তখন তো কখনও এমন হীনমন্যতায় ভুগিনি। এটাকেই হয়তো ইংরেজিতে বলে ‘ম্যাচিওর ব্রেন’। যার শিক্ষা আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের সন্তানদের দিয়ে চলি। অন্যের সামনে নিজেকে পারফেক্ট করে প্রেজেন্ট করার ক্ষমতা। যে যত তাড়াতাড়ি ম্যাচিওর হবে, সে তত দ্রুত অন্যকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার দক্ষতা শিখে যাবে।
দশটার মধ্যে নিউ মার্কেটে পৌঁছে গেলাম। শীত গুটি গুটি পায়ে বিদায় নিচ্ছে। যদিও কলকাতায় শীত হাত-পা ছড়িয়ে আস্তানা গাড়ার আগেই তার যাওয়ার সময় হয়ে যায়। নিউ মার্কেট জুড়ে রং-বেরঙের টুপি, সোয়াটার, হালকা স্টোলের মেলা চলছে। ইচ্ছে করেই একটু আগে এসেছি। কে জানে, ওরা হয়তো নিজেদের গাড়ি নিয়ে আসবে। আমাকে তো সোনারপুর থেকে ভিড় ট্রেনে গাদাগাদি করে আসতে হবে। চুল, শাড়ির যা ছিরি হবে! তা নিয়ে ওদের সামনে দাঁড়ানো যাবে না। তার চাইতে একটু আগে এলে কোনও শপিং মলের ওয়াশ রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেওয়া যাবে। বেছে বেছে সবচেয়ে দামি সিল্কের শাড়িটা পরেছি। জড়সড় হয়ে নিজের সাইড ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। যদি ওরা খুব বেশি অহংকার দেখায়, তখন আমিও নিজের শেষ তিরটা ছাড়ব। খানিকক্ষণের মধ্যেই তিতাস চলে এল। ফেসবুকে আগেই ছবি দেখেছি, তাই চিনতে অসুবিধা হল না। তিতাস পরেছে সমুদ্র নীল রংয়ের স্লিভ লেস চুড়িদার। এখনও যেন বয়সটাকে তিরিশের কোঠায় ধরে রেখেছে। মাখনের মতো উজ্জ্বল ত্বকে সূর্যের আলো পড়ে আভিজাত্যের রস যেন চুঁইয়ে পড়ছে। আমার দিকে এগিয়ে এসে সিনেমার নায়িকাদের কায়দায় ‘হাই’ বলে জড়িয়ে ধরল। কেন যে সেই আলিঙ্গনের মধ্যে আগের মতো উষ্ণতা পেলাম না! তিতাসের ডান হাতে একটা বড় ডায়ালের ঘড়ি। অন্য হাতে মকরমুখী বালা। এয়োতির কোনও চিহ্ন আছে কি না ভালো করে খোঁজার চেষ্টা করি। না, সিঁথির ভিতরে একফোঁটা লাল রং দেখা যাচ্ছে। খুব ভালো করে নজর না করলে বোঝা যাবে না।
‘কী রে ? কী দেখছিস অমন করে?’
ধরা পড়ে যাওয়ায় অপ্রস্তুত হয়ে একটু হাসলাম।
‘তুই তো অনেক রোগা হয়ে গেছিস। বর খুব খাটাচ্ছে?’ তিতাস হেসে জিজ্ঞেস করল।
মনে মনে রাগ হল, কী বলতে চাইছে তিতাস? আমার স্বামীর ইনকাম কম? কাজের লোক রাখার ক্ষমতা নেই? একটা যুতসই উত্তর দেব বলে প্রস্তুত হচ্ছি, এমন সময় পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরল রিমা।
তিতাস হইহই করে উঠল, রিমা তখনও আমায় জড়িয়ে ধরে আছে। তিতাস, আমি আর রিমা উষ্ণ আলিঙ্গনে একে অপরকে কুশল বিনিময় করছি। আশপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে জনসমুদ্র। কেউ একপলক তাকাচ্ছে। কারও বা ওইটুকু দৃষ্টিপাত করারও সময় নেই । সত্যি তো! এই পৃথিবীতে কারই বা এত সময় আছে অন্যের দিকে তাকানোর। তবুও আমরা একটা কাজ করার আগে কে কী মনে করবে ভেবে মাথা গরম করি, ভয় পাই, কষ্ট পাই, রাতের ঘুম নষ্ট করি। রিমার বয়েজ কাট চুল। ও পরেছে নীল জিন্সের সঙ্গে সাদা শার্ট। দু’কানে ছোট্ট দুটো হীরে বসানো টপ। সাদা পাথর থেকে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পরছে ওর গোলাপি আভা ছড়ানো গ্রীবায়। নিজেকে কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছে ওদের সামনে। আবার ব্যাগটা জড়িয়ে ধরলাম। মনে মনে বললাম, আমারও আছে । সময় হলেই দেখাব।
‘এই, কী অত ভাবছিস?’এক ঠেলা দিয়ে রিমা জিজ্ঞেস করল।
তিতাস বলল, ‘চল আগে একটা রেস্তরাঁতে গিয়ে বসি। ওখানে বসেই প্ল্যান করব, আজ সারাদিনটা কীভাবে কাটাব।’
রিমা বলল, কোনও রেস্তরাঁ নয়, চল আমি অন্য এক জায়গায় আজ তোদের নিয়ে যাব।’
আমি মনে মনে ভেবে নিলাম, কত আছে আমার ব্যাগে। সংসারের খরচ সামলে একটু একটু করে হাত খরচ যা জমিয়েছিলাম সবটাই আজ নিয়ে এসেছি। কিছুতেই বন্ধুদের কাছে নিজের অভাবের কথা প্রকাশ হতে দেওয়া চলবে না।
একটা ক্যাব বুক করে আমরা তিনজনে এগিয়ে চলেছি।
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ তিতাস জিজ্ঞেস করল।
‘সারপ্রাইজ।’ রিমা কাঁধ ঝাকিয়ে উত্তর দিল। সেই ছোটবেলা থেকেই রিমার এমন সারপ্রাইজ দেওয়ার অভ্যেস। এখনও সেই আগের মতোই রয়েছে।
‘বল না প্লিজ।’ তিতাস আবার বলল।
‘তুই একটুও পাল্টাসনি তিতাস। এত বয়স হল এখনও একটু ধৈর্য ধরতে পারিস না। ’ আমি হেসে বললাম।
তিতাস আমার গাল টিপে বলল, ‘আর নিজে বুঝি খুব বদলে গিয়েছিস? এখনও সেই ছোটবেলার মতো ব্যাগটাকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে বসে আছিস। রাখ ওটা পাশে।’
মনে পড়ে গেল, স্কুলে বন্ধুরা আমায় এইভাবে বুকের কাছে ব্যাগ জড়িয়ে ধরার জন্য কত খ্যাপাত। কী রাগ হতো সেই সময়! কিন্তু এখন তিতাসের এই সামান্য কথায় মনটা আনন্দে ভরে উঠল। হয়তো ফেলে আসা দিনগুলিকে সবারই এমন মধুর লাগে। অথচ যে মুহূর্তটা হাতের মুঠোয় আছে সেটাকে...
‘এই দাঁড়াও, দাঁড়াও এখানে, দাঁড় করাও গাড়িটা,’ রিমা বলে উঠল।
কী আছে এখানে? জানলা দিয়ে মুখ বের করে দেখলাম। কিছুই তো নেই।
‘এখানে এলাম কেন?’ তিতাস জিজ্ঞেস করল।
রিমা বলল, ‘বলছি, চল আগে ওই গাছের নীচে বেদিটায় বসি।’ বলেই বলল, ‘কে আগে ওখানে যেতে পারে দেখি।’ রিমা ছুটতে থাকল।
আমারাও দৌড় লাগালাম। আমি পৌঁছনোর আগেই ব্যাগটা ছুঁড়ে বেদিটায় রেখে দিলাম।
‘না, না এটা হবে না। এটা চিটিং, এটা চিটিং,’ বলে ওরা দু’জন চেঁচিয়ে উঠে আমাকে মারবার জন্য তাড়া করল।
আমি সামনের খোলা মাঠে দৌড়তে থাকলাম। ওরাও আমার পিছু পিছু দৌড়চ্ছে। এক সময় ক্লান্ত হয়ে তিনজনেই বসে পড়লাম। কত দিন এভাবে দৌড়ইনি। বুকের ভেতর যেন হাপর চলছে। ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছে। দূরে দেখি তিনটে মেয়ে কাঠি আইসক্রিম খেতে খেতে ফিরছে। আমরা তিনজনে একে অপরের দিকে তাকালাম। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল। গাছতলায় বসে আইসক্রিম খাচ্ছি। এ ওকে জিভ বের করে দেখাচ্ছি, কার জিভ বেশি রঙিন হল তা নিয়ে তর্ক করছি। পাশ দিয়ে কয়েকটা উঠতি বয়সের ছেলে যাচ্ছিল। রিমা হঠাৎ ওদের দেখে সিটি দিল। ছেলেগুলোও একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল। তিনজন মাঝবয়সি মহিলার ছেলেমানুষি দেখে হয়তো ওরা মনে মনে মজা পেল। এরপর আমরা ফুচকা খেলাম, আলুকাবলি খেলাম। ভুলে গেলাম এসব খেলে আমার অম্বল হয়। বেলুন ফুলিয়ে আকাশে ওড়ালাম। বহুদিন বাদে গলা ছেড়ে গান গাইলাম। কে শুনছে, কে তাকাচ্ছে সে দিকে আমাদের কারও ভ্রুক্ষেপই নেই। আজকের দিনটা যেন শুধুই আমাদের।
(তিন)
ট্রেনে জানলার পাশে সিট পেয়েছি। চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছি। বুকের ভিতর বিয়ের পর বাবা-মাকে ছেড়ে আসার দিনের মতো কষ্ট হচ্ছে!
‘দিদি আপনার ফোন বাজছে।’ পাশে বসা ভদ্রলোকের কথায় সম্বিত ফিরল।
মোবাইল ফোনটা খুলে দেখি অনেকগুলো মিসড কল। ছেলের। আইআইটি-তে পড়ে। ওকে নিয়ে খুব গর্ব আমার। যেখানেই যাই, কোনও না কোনও অছিলায় সবাইকে ওর ছবি দেখাই। অথচ আজ এটার কোনও প্রয়োজনই হল না। স্বামী আর ছেলেকে ভুলে এতটা সময় বিয়ের পর কবে কাটিয়েছি মনে করতে পারলাম না। অনেকখানি অক্সিজেন বুকের মধ্যে ভরে নিয়ে গাড়িটার তালে তালে ছোটবেলার মতো গুন গুন করে গেয়ে উঠলাম , রেলগাড়ি ঝমা ঝম...।
20th September, 2020