লাস্ট ট্রেনের বিভীষিকা
পার্থসারথি গুহ
বহুদিনের ইচ্ছেটা এভাবে ফলতে চলেছে। আনন্দে আত্মহারা পিন্টু। পিন্টুর ভালো নামটা নাই বা বললাম। ডাকনামেই কাফি সে। গোপন থাক ওর এই অভিযানের পুরো রুটটার বৃত্তান্ত। কারণ, রাত-বিরতে ওইসব অঞ্চল দিয়ে ফেরার সময়ে হয়তো আপনারা ভয়ে কাঁটা হয়ে যেতে পারেন।
ধরে নিন না, অমুক স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু হওয়ার কথা। এবার উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব না পশ্চিম গন্তব্য কোথায় সে ব্যাপারেও আর কিচ্ছুটি বলা যাবে না।
এতক্ষণে এটুকু বোঝা গিয়েছে পিন্টুর এই অভিযানটা রেলপথে। এক্কেবারে শেষ ট্রেনে চেপে অন্তত ঘন্টাখানেকের পথ পাড়ি দেওয়া। আর এই অ্যাডভেঞ্চারাস ট্রেন যাত্রার সুযোগ করে দিয়েছে পিন্টুর দূর সম্পর্কের এক জামাইবাবু। অসীম পাল। হয়তো তার প্রকৃত নামটাও অসীম পাল নয়।
অসীম হল এই ট্রেনের ড্রাইভার। লাস্ট ট্রেনের চালক হতে হয়েছে অগুনতিবার। অত্যন্ত সাহসী অসীম এমন কিছু দেখেছে এই নৈশ যাত্রাপথে যা সাধারণ বুদ্ধি বিবেচনার বাইরে।
যুক্তিবাদীরা অবশ্য হেসে উড়িয়ে দেয়। পাত্তাই দিতে চায় না অসীমের স্বচক্ষে দেখা অভিজ্ঞতাকে। ওদের পাড়ারই বিজয় ঢালি এ ব্যাপারে সবার আগে।
কী কুক্ষণেই যে অসীম একবার বলে ফেলেছিল, ‘মুখে অনেক কিছু বলা যায়। কিন্তু, নিজের চোখে দেখে আমি বুঝেছি রাতের রেললাইন কত ভয়ঙ্কর।’
‘তা তুমি কি রেললাইনে স্কন্ধকাটা দেখেছ?’ টিপ্পনি কেটেছিলেন বিজয়।
অসীম কথা বাড়ায়নি। অবিশ্বাসী মানুষকে বোঝানো তো আর ওর দায় নয়। তবে বলেছিল, ‘বিজয়দা একদিন না হয় চাক্ষুষ করেই আসবেন।’
বিজয় ঢালি প্রথমদিকে খুব উৎসাহ দেখাতেন। সরেজমিনে দেখে আসবে লাস্ট ট্রেন কেমনভাবে চলে। কিন্তু, যখনই অসীম বলত, ‘বিজয়দা, অমুকদিন তাহলে চলুন। নিজের চোখেই দেখবেন।’
সে সময়ই বিজয়ের কোনও না কোনও কাজ পড়ে যেত। ফলে বিজয় ঢালি প্রকৃতই দুঃসাহসী কিনা সেটার আর হাতেগরম প্রমাণ মেলেনি।
বিজয়কে যখন তার অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল, তখন চাকরিতে একেবারেই নবীশ অসীম। রাতের ট্রেনেই ঘন ঘন ডিউটি পড়ত। ফলে উত্তেজনাও ছিল পুরোদস্তুর। প্রায়ই রেললাইনে এমন কিছু দেখত, যা কোনওভাবেই যুক্তি দিয়ে মেনে নেওয়া যায় না। এমনই একদিন ট্রেনের সারথি হয়ে অত্যন্ত নির্জন একটা এলাকায় নজরে এসেছিল কুয়াশার কুণ্ডলীর মতো কিছু একটা নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে।
মে মাসের খটখটে গরমের নিশুত রাত। কুয়াশা কোনওভাবেই আসা সম্ভব নয়। লাইনের সেই কুয়াশাকুণ্ডলী নিমেষের মধ্যে জমাট বেঁধে একটা অবয়বে পরিণত হয়েছিল। অসীম পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে কোনও একটা মানুষের কুয়াশাচিত্র যেন কেউ এঁকে চলেছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে ট্রেন থামাবার উপক্রম করত প্রথম প্রথম। কিন্তু, পাশে থাকা সিনিয়ররা বলতেন, ‘কোনওভাবে ট্রেন থামাবে না।’
‘তাহলে তো গায়ের ওপর দিয়ে চলে যেতে হয়।’
পাশে বসা সিনিয়র ড্রাইভার তারকবাবু স্মিত হেসে বলেন, ‘লাইনে নতুন তো। বুঝতে পারছ না। ওদের কী আমাদের মতো শরীর আছে নাকি? সবটাই তো একটা মায়া।’
‘মায়া মানে? পরিষ্কার দেখছি, মানুষের মতো কিছু হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে...’ উদ্বেগের অভিব্যক্তি অসীমের কণ্ঠে।
‘আরে বাবা! বললাম না, কয়েকটাদিন গেলে সবটাই গা সওয়া হয়ে যাবে। শরীরী আর অশরীরীর ফারাকটা স্পষ্ট বুঝে যাবে।’ আরও বিশদে গিয়েছেন তারক মল্লিক।
সত্যিই এরপর সবটাই গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল অসীমের। রাতের ট্রেনের ডিউটি যখনই তার ওপর ন্যস্ত হতো, এমন অনেক অবিশ্বাস্য ছবি ওর সামনে ভেসে উঠত।
কোনও কোনওদিন তো কুণ্ডলীটা বিশাল আকার নিত। তা থেকে অসংখ্য অবয়ব ফুটে উঠত। অসীম বুঝতে পারত ওরা কারা। ভয় লাগত না তা নয়। তাও জীবিকার জন্য আপস করা ছাড়া তো উপায় নেই। ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করে ওই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি কাটাত।
এটা ঠিক অসীম ওদের দেখত, ভয়ও পেত। কিন্তু, ওই ধোঁয়ার কুণ্ডলীরূপী অশরীরীরা কোনও ক্ষতি করেনি ওর। শুধু অসীম বলেই নয়, কোনও ড্রাইভারেরই ক্ষতি হয়নি। আসলে রাতের ট্রেনের ড্রাইভারদের কাছে এই অলৌকিক অভিজ্ঞতা একটা সময়ে গিয়ে খুবই স্বাভাবিক হয়ে যায়। অসীমের ক্ষেত্রেও অনুরূপ হয়েছে।
প্রথমদিকে কাঁচা বয়স বা অনভিজ্ঞতার জন্য বিজয় ঢালির মতো কারও কারও কাছে রোমহর্ষক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরলেও পরে এই বিষয় নিয়ে স্পিকটি নট হয়ে থাকত অসীম পাল।
তবে, একজনের কাছে অনর্গল এই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরত। বলাবাহুল্য, এই গল্পের নায়ক পিন্টুই অসীমের এই ভয় ধরানো অভিজ্ঞতার প্রধান শ্রোতা।
অসীমদের যাদবপুরের বাড়িতে ছুটিছাটার দিন হলেই অবারিত দ্বার পিন্টুর। শ্রীরামপুর থেকে অসীম জামাইবাবুর আকর্ষণেই বারবার ছুটে আসে পিন্টু। ক্লাস এইটে পড়ে। তবে পড়াশোনা বা খেলাধুলোর চেয়েও ওর অনেক বেশি আগ্রহের বিষয় হল ভূতপ্রেত। পিন্টু অসীমের গিন্নি রূপার তুতো ভাই। রূপার নিজের ভাই নেই। তাই এই পিন্টুই সব। ভাইফোঁটা দেওয়া থেকে রাখী পরানো সবই চলে।
জামাইবাবুও তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। ওদের একমাত্র মেয়ে তিন্নি অর্থাৎ মনোরমাও পিন্টুমামার খুব ভক্ত। তবে বাবার সঙ্গে মামার ভৌতিক বৈঠকীতে মোটে থাকে না তিন্নি। ভূত নামটাতেই ওর বেজায় ভয়।
রান্নাঘর থেকে রূপা অবশ্য ফোড়ন কাটে, ‘এই শালা-জামাইবাবুতে শুরু হল। যতসব আজেবাজে গপ্প।’
অসীম বলতো, ‘দেখো শালাবাবু, তোমার দিদি কেমন আওয়াজ দিচ্ছে।’
‘ছাড়ো তো অসীমদা, দিদির কত সাহস জানা আছে,’ বলে শ্যালক-জামাইবাবুতে ফের ভৌতিক আলোচনায় মেতে উঠত।
পিন্টু আগে জামাইবাবুই বলত। অসীম আর রূপাদি সেই অভ্যাসটা ছাড়িয়েছে। এখন পিন্টুর মুখে তাই শুধুই অসীমদা
সেই অসীমদাই পিন্টুর ইচ্ছে-পূরণের দূত হয়ে উঠেছে।
সে ছোট থেকেই ভূতের গল্পের পোকা। তেমনই ডাকাবুকো। তার মনের সবচেয়ে বড় বাসনাটাই হল ভূত দেখবে। ওদের শ্রীরামপুর বা আশপাশের এমন কোনও ভূতুড়ে বাড়ি, কবরখানা বা পরিত্যক্ত নির্জন অঞ্চল নেই যেখানে পিন্টু যায়নি। বন্ধুবান্ধব বা চেনাজানা কারও থেকে খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছে। কিন্তু ভূতের ‘ভ’ টুকু চোখে পড়েনি। একটা জায়গায় তো আবার ভূতের খোঁজে গিয়ে দুষ্কৃতীদের মুখোমুখি হয়েছিল।
অবশ্য, দুষ্কৃতীদের এড়াতে পারলেও বাড়িতে তো সবসময় ফাঁকি দেওয়া যায় না। ফলে মায়ের কাছে উত্তমমাধ্যম জুটেছে প্রায়ই। পিন্টুর বাবা অবশ্য ছেলের এই সাহসিকতার তারিফই করেন। কিন্তু, মা হলেন ওদের বাড়ির সর্বময়ী কর্ত্রী। ফলে বাবার ইচ্ছে থাকলেও ছেলের পাশে সেভাবে থাকতে পারেন না। যদিও মায়ের রুদ্রমূর্তির হাত থেকে শেষপর্যন্ত বাবা-ই ওকে বাঁচায়। এই যেমন এবারটির জন্য পিন্টু যে রূপাদিদের বাড়িতে একটা রাত থাকার সুযোগ পেয়েছে সেটাও ওই বাবার সৌজন্যেই।
অবশ্য মা ফোন করে রূপাদিকে পইপই করে বলে দিয়েছেন, ‘আজকের দিনটা থাকছে থাক। কাল কিন্তু অবশ্যই ভাইকে বাড়ি পাঠাবি। সামনে কিন্তু ওর পরীক্ষা।’
কথা ছিল পিন্টু সকাল সকাল যাদবপুর চলে আসবে। তারপর দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম নেবে। এক্কেবারে রাতের খাবার সেরে জামাইবাবুর সঙ্গে বেরবে। রূপাদিকে অনেক করে বোঝানোও হয়ে গিয়েছে।
রূপাদি বারবার তার বরকে বলেছে, ‘মঞ্জুলা কাকিমাকে তো চেনো। এতটুকু একটা ছেলেকে ওইসব ভূতপ্রেত দেখাতে নিয়ে যাচ্ছ। যদি কিছু উনিশ-বিশ হয়, কাকিমা কিন্তু আমাকে ছিঁড়ে খাবে।’
অসীম স্ত্রীকে আশ্বাস দেয়, ‘দেখো শালাবাবু এতদিন ধরে বলছে। আজ আমার নাইট ডিউটি। দেখুক না একদিন নিঝুম রাতের রেলপথ। আর তোমায় আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, ওর কোনও ক্ষতি হবে না। কারণ, যাঁদের আমরা দেখি তাঁরা যাবতীয় সীমা পরিসীমার বাইরে।’
এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সেদিন ঘোর দুর্যোগ শুরু হয়েছে। ফলে পিন্টুর আর সকালে আসা হয়নি। মা নিদান দিয়েছিলেন, ‘আজ আর এই দুর্যোগে বেরতে হবে না।’
বাবাকে দিয়ে মাকে ম্যানেজ করে পিন্টু যখন শ্রীরামপুর থেকে বেরল তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বৃষ্টি একটু কম। হাওড়া পৌঁছতে পারলে নিশ্চয়ই যাদবপুরগামী বাস পেতে অসুবিধা হবে না। আর তাতে চেপেই এক্কেবারে সোজা...
কিন্তু ওই যে বলে ম্যান প্রোপোজেস গড ডিসপোজেস। হাওড়ায় পৌঁছতে পৌঁছতেই সন্ধে সাতটা বেজে গেল। এবার ওখান থেকে যাদবপুর যেতে গেলে তো অনেক রাত হয়ে যাবে। অসীমদা ডিউটি বেরিয়ে যাবে। আর ওর সেই কাঙ্ক্ষিত ভূত দর্শন হবে না। আপশোসে মরে যাচ্ছিল পিন্টু। তাড়াহুড়োর মধ্যে মোবাইলটা নিতেও ভুলে গিয়েছে।
একটা মুদিখানার দোকানে ফোন করার ব্যবস্থা আছে দেখে তড়িঘড়ি ফোনে ধরল জামাইবাবুকে।
‘অসীমদা, হাওড়া পৌঁছতেই আজ এত দেরি হয়ে গেল। ভাবছি, সোজা তোমার কাছে চলে যাব। স্টেশনে গিয়ে না হয় তোমায় একটা ফোন করব।’
অসীমও মনেপ্রাণে চাইছিল প্রিয় শ্যালকবাবুর শখ মেটাতে। তাই সামান্য আপত্তি দেখালেও শেষপর্যন্ত বলল, ‘ঠিক আছে শালাবাবু। তুমি স্টেশনে এসেই আমাকে ফোন করো। আমি তোমার দিদিকে বলে দিচ্ছি সব। আর হ্যাঁ, সাবধানে এসো।’
‘সে তোমার চিন্তা নেই। তুমি খালি দিদিকে বলে দিও বাবাকে যেন জানিয়ে দেয় আমি যাদবপুরে আছি। বোঝই তো, মা যদি কোনওভাবে টের পায়..’
‘সে তোমায় ভাবতে হবে না। তুমি সাবধানে চলে আসো খালি। আজকের এই বৃষ্টিভরা রাতে আশা করি তোমার সাধ পূরণ হবে।’
রাত ১১টা ২০ শেষ ট্রেন ছাড়বে ছাড়বে। অসীম ড্রাইভারের আসনে। সমানে ঘামছে। পিন্টুর চিন্তা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ছেলেটার সঙ্গে শেষ যখন কথা হল তখন সাতটা বেজে গিয়েছে। ওখান থেকে বাসে এখানে আসতে এমনিতে যদি ঘণ্টাখানেক লাগে, তবে আজকের এই বৃষ্টিবহুল দিনে আরও ঘণ্টাখানেক বেশিই লাগুক। তাহলেও তো ন’টা-সাড়ে ন’টার মধ্যে ছেলেটার পৌঁছে যাওয়ার কথা।
এদিকে রূপা ঘন ঘন ফোন করছে। তার উপর ছেলেটা মোবাইলও আনেনি। ওর বাড়িতে ফোন করাও যাবে না। মঞ্জুলা কাকিমা সবটা জানলে খেপে লাল হয়ে যাবেন।
সবে ট্রেনটা ছাড়বে। এমন সময় কোত্থেকে হাঁফাতে হাঁফাতে এল পিন্টু। উঠে এল একেবারে অসীমের পাশে।
‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আমরা তো পাগলের মতো চিন্তা করছি। তুমি জানলেই বা কী করে আমার এই ট্রেনে ডিউটি?’
‘আরে সেসব অনেক কথা। জ্যামে আটকে মাঝপথে বাস দাঁড়িয়ে গেল। জল ঠেঙিয়ে কোনওরকমে এলাম। তারপর যা বাজ পড়ছিল। একটা তো মনে হয় কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। স্টেশনে এসেই এনকোয়ারিতে তোমার নাম বলায় ওরাই বলে দিল।
পিন্টুর কথায় তখনও হাঁফ ধরার লক্ষণ।
এদিকে ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে ১১টা ২০। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। পিন্টুরও এক অনন্য অভিজ্ঞতা বটে। একেবারে সামনে থেকে এভাবে ট্রেন চলা দেখছে। শেষ ট্রেনে এমনিতেই প্যাসেঞ্জার কম হয়। তার ওপর এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগ।
অর্ধেক রাস্তায় পেরিয়েও কুয়াশার কুণ্ডলীর আড়ালে তেনাদের দর্শন মিলল না। এদিকে তখন পিন্টু বেজায় হতাশ হয়ে পড়েছে। একবার বলেওছে, ‘কি গো অসীমদা। তোমার রেলভূতেরা গেল কোথায় সব? নাকি বৃষ্টি দেখে ওরাও গা ঢাকা দিয়েছে।’
অসীমেরও খুব অবাক লাগছে। এতদিন লাস্ট ট্রেন চালাচ্ছে। এমন কোনওদিন হয়নি যে, ওই কুণ্ডলীগুলোর দর্শন মেলেনি। প্রতিদিনই মনে হয়েছে ওরা যেন ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। অথচ আজ যেদিন শালাবাবুকে দেখানোর কথা, সেদিনই ওরা রণেভঙ্গ দিল। তাহলে আত্মারাও এভাবে মানুষকে জব্দ করে!
এমন সময় দেখা গেল এক অদ্ভূত দৃশ্য। তবে এটা সেই চেনা সাদা কুয়াশার মতো কুণ্ডলী পাকানো নয়। ট্রেনের জোরালো আলোয় অদূরেই দেখা গেল বিজয় ঢালি দাঁড়িয়ে। এমন একটা পজিশনে দাঁড়িয়ে যে অসীমের পক্ষে গাড়ি থামানো কোনওমতেই সম্ভব নয়।
কিন্তু, বিজয়দা এত রাতে এই পাণ্ডববর্জিত অঞ্চলের রেললাইনে কেন? ‘বিজয়দা, ও বিজয়দা, সরে যাও।’ ব্যর্থ চিৎকার করে প্রতিবেশী মানুষটিকে সরাতে চাইল অসীম। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। বিজয়ের ওপর দিয়েই ট্রেন চলে গিয়েছে।
এরপর হল আরও সাংঘাতিক কাণ্ড!
ট্রেন যত এগচ্ছে ততবারই অসীমের সামনে ভেসে উঠতে থাকল বিজয় ঢালির শরীরটা। মানুষটা কী তাহলে মরেনি? সেটাও বা কি করে সম্ভব? একটা লোক কতবার কাটা পড়তে পারে?
অনুশোচনা আর বিস্ময়ের যুগপৎ দশায় তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অসীম। পাশে পিন্টু কিন্তু নির্বিকার। একবার খালি বলল, ‘অসীমদা এই তাহলে তোমার রেলভূত? দাঁড়াও আমি ওর ব্যবস্থা করছি...’
‘তুমি কী করবে? বসো চুপটি করে।’ অসীম আপ্রাণ চেষ্টা করছে পিন্টুকে বাধা দিতে।
কিন্তু পিন্টু এটা কী করল! জামাইবাবুকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দরজা খুলে সোজা ঝাঁপ দিল রেললাইনে।
কোনওমতে ট্রেনটা এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে অসীমের চোখে পড়ল অদ্ভুত এক দৃশ্য। দুটো ছায়ামূর্তি সামনের রেললাইনে প্রবল ঝটপট করছে। শেষপর্যন্ত বিজয়ের মতো পূর্ণবয়স্ক মানুষকে ঠেলে সরিয়ে পিন্টুর সে কী উল্লাস।
পরক্ষণেই ছবিটা অবশ্য পালটে গেল। অসীমের চোখের সামনে নিমেষের মধ্যে কাচের গুঁড়োর মতো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল পিন্টুর পার্থিব শরীরটা। পড়ে রইল সদ্য জমাট বাঁধতে থাকা কুয়াশার একটি কুণ্ডলী।
এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখার পর অসীম কীভাবে শেষ স্টেশনে পৌঁছেছিল সেটা আরেক অধ্যায়। তবে পরের দিন খবরের কাগজে দু’-দুটো মৃত্যুসংবাদ বেরিয়েছিল রীতিমতো বক্স করে।
‘বাজ পড়ে শিয়ালদহের কাছে এক বছর চোদ্দোর ছেলের মৃত্যু।’
‘যাদবপুরে ছেঁড়া ইলেকট্রিক তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত বিজয় ঢালি নামে এক প্রৌঢ়।’ আর কী আশ্চর্য দুটো দুর্ঘটনাই ঘটেছে রাত দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে।
অঙ্কন: সুব্রত মাজী
06th September, 2020