কর্মে অগ্রগতি ও নতুন কাজের বরাত প্রাপ্তি। আইটি কর্মীদের শুভ। মানসিক চঞ্চলতার জন্য বিদ্যাচর্চায় বাধা। ... বিশদ
১০
শারদোৎসবের আলো ঝলমলে কলকাতা নগরীকে পিছনে ফেলে আমরা যাত্রা করলাম জলদাপাড়া অভয়ারণ্য দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে। এনজিপি’তে নেমে একখানি গাড়ি ভাড়া করে যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম হলং ফরেস্ট বাংলোয়। এক বন্ধুকে বলা ছিল, ঘর পেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু অসুবিধাই হল। এক ভিভিআইপি-র হলং সফরে আসার কথা। তাই ওখানে ঘর পাওয়া যাবে না।
সেই বন্ধুবর আমাদের হতাশ হতে না দিয়ে তখনই পাঠিয়ে দিল মাদারিহাট ফরেস্ট বাংলোয়। গাড়ি ঘুরল মাদারিহাটের রাস্তায়। একটু পরেই মন ভালো হয়ে গেল। দু’পাশে অনন্ত চা-বাগিচা যেন সবুজ গালিচা পেতে রেখেছে। সেখানে রং-বেরঙের পোশাক পরে পিঠে ঝুড়ি নিয়ে ঠোঁটে মোহিনী সুর গুনগুনিয়ে ‘পাতি’ তুলে চলেছে পাহাড়ি রমণীরা।
কিছুক্ষণ পরে পৌঁছে গেলাম ফরেস্ট বাংলোয়। বেশ একটা অ্যান্টিক ভাব আছে পুরনো দিনের এই হোটেলটায়। এখান থেকেও যাওয়া যাবে অভয়ারণ্য পরিদর্শনে। হাতির পিঠে সওয়ারি হয়ে এক শৃঙ্গ গণ্ডার দর্শনও করা যাবে। এইসব শুনতে শুনতে আমি বাংলো ধরনের ঘরগুলির দিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। প্রত্যেকটা ঘরই আলাদা আলাদা ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাজানো। এই বিশাল বাগানের মধ্যে ওরা নিজস্বতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যে সময়ের কথা বলছি তখনও নেট দুনিয়ার অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন ঘটে যায়নি আমাদের জীবনে। আমাদের ঘরখানির আয়তন বিশাল, তার মাঝখানে পাতা খাটখানিকে পালঙ্ক বলাই ভালো। বাইরে বাগানের শোভা আর তার সঙ্গে একখানা মস্ত আকাশ দেখা যাচ্ছে। একটু পরেই সূর্য ঢলে গেল আর গোধূলির আলো ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত বাংলোয়, সেই মায়া মাধুরী আমাকে এমন মুগ্ধ করে দিল যে হলং ফরেস্টে জায়গা না পাওয়ার দুঃখ নিমেষেই ভুলে গেলাম।
রাত নেমেছে নিঃশব্দে। আমি বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছি। রাত বাড়তেই ঘরের অন্যসব আলো নিভে গিয়েছে। মাত্র একটি রাত-আলো জ্বলছে ঘরের কোণে। তাতে কোনও অসুবিধে নেই। বাগান থেকে আলো আসছে। অষ্টমী কিংবা নবমীর চাঁদ থেকেও মোহিনী আলো আসছে ঘরে।
হঠাৎ খট-খট-খট করে তিনবার শব্দ হল।
আমি চমকে উঠলাম। আবার থেকে থেকেই সেই শব্দ। কোথা থেকে আসছে আওয়াজটা, বুঝতে পারছি না। সঙ্গের মানুষটিকে না ডেকে পারলাম না। সেও বুঝতে পারছে না, আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে। বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়ো। বাইরে হয়তো কোনও রাত জাগা পাখি ডাকছে।’
আমি পারছি না। কেবলই সেই খট-খট-খট। যেন কেউ নক করছে। যেন কিছু বলতে চাইছে। কৌতূহলে আমি মনে মনে রীতিমতো বিপর্যস্ত। হাত বাড়িয়ে বেলটা টিপেই ফেললাম।
জানতাম টুয়েন্টি-ফোর আওয়ার্স রুম সার্ভিস এখানে। কেউ না কেউ আসবেনই। সত্যিই দরজায় এসে বেল টিপলেন কেউ। আমিই গিয়ে দরজা খুললাম। একজন বয়স্ক বেয়ারা ঘরে এলেন ‘কিছু চাই ম্যাডাম?’
‘কিছু চাই না। একটা শব্দ আসছে থেকে থেকে। ওটা কীসের শব্দ?’
‘শব্দ?’ লোকটি অবাক হলেন। ‘কোন শব্দ?’
‘একটু দাঁড়ান। এখনই শুনতে পাবেন।’
সঙ্গে সঙ্গে সেই শব্দটি হল? কট-কট-কট।
‘ও কিছু না। তক্ষক ডাকছে।’
‘তক্ষক? তক্ষক তো সাপ! কোথায় ডাকছে?’ আমি ভয় পেয়ে গেলাম। লোকটি হাসলেন, বললেন, ‘আপনার মাথার ওপরে। কোনও ভয় নেই।’
‘মানে? আমরা দু’জনেই চমকে উঠলাম। তাকালাম সিলিংয়ের দিকে। ঝকঝকে সিলিং!’ কী বলছেন ভাই? সিলিংয়ে তো কিছু নেই।’
‘দেখা যাবে না। ওপরে টালি আর ঘরের ফলস সিলিং, এই দুইয়ের মধ্যে ওরা আছে। থাক না। ওরা বেরিয়ে আসবে না।’
‘না-না-না। প্লিজ তাড়িয়ে দিন তক্ষকটাকে।’ আমার ভয়ার্ত গলা।
আমার ভয়কে ছাপিয়ে হেসে উঠলেন লোকটি, ‘তাড়িয়ে দেব? কটা তাড়াব ম্যাডাম। ওরা অগুনতি। টালি আর সিলিংয়ের মধ্যে ওদের বাসা।’
‘বাসা? সিলিংয়ের পিছনে অসংখ্য তক্ষকের বাস? কী বলছেন!’
‘ঠিকই বলছি। ওরা আমাদের কখনও ক্ষতি করে না। আমরাও ওদের ঘাঁটাই না। সে সাহসও কারও নেই।’
‘যদি রাতে জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে আসে? কামড়ে দেয়?’
‘কিছু করে না। কখনও বেরয় না ওরা। ওই শুধু একটু ডাকে খট খট খট।’
আমার শরীর কাঁপছিল, ‘আমাদের ঘরটা চেঞ্জ করে দিন।’
হা হা করে হেসে উঠলেন তিনি, যেন মজার কথা শুনছেন। বলে উঠলেন, সব ঘরের সিলিংয়েই ওরা আছে। কত বছর ধরে আছে কেউ জানে না। পাহারা দেয় ওরা বাংলোটাকে রাতে। ঘুমিয়ে পড়ুন আপনারা। কোনও ভয় নেই। গুড নাইট।’
‘খট খট খট।’ আবার ওদের কেউ একজন ডাকল। গুডনাইট জানাচ্ছে নাকি আমাদের? আমার বীরপুরুষটি শুয়ে পড়ল এই উপদেশ দিয়ে, ‘ঘুমিয়ে পড়। এক ঘুমে রাত কেটে যাবে। তাছাড়া শুনলে তো ওরা কিছু করে না।’ আমার পক্ষে ঘুমনো অসম্ভব। ছোট মেয়েটা সঙ্গে রয়েছে। শোনো, আমরা পালা করে পাহারা দেব রাতটা। জানলা দিয়ে ঢুকছে যদি দেখি...।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ছোট মেয়ের বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে।
খাটে বালিশ হেলান দিয়ে আমি জেগে বসে রইলাম। একাই পাহারা দেব সারা রাত। ঘুমবই না। চোখ রইল জানলার দিকে। মাঝে মাঝেই জানান আসছে খট-খট-খট। ওরাও জেগে আছে।
বড় বড় জানলা। শার্সি নেই। বন্ধও করা যাবে না। আমার নির্নিমেষ নয়ন আটকে রইল জানলায়, ঢুকলেই দেখতে পাব।
রাত বেড়ে চলেছে। কোনও সৌন্দর্য আমাকে আর টানছে না। আমার সাবধানি দৃষ্টি জানলায় নিবদ্ধ। হঠাৎ মনে হল একটা বড়সড় টিকটিকির মতো প্রাণী। ধীরে ধীরে জানলা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিল। আস্তে আস্তে ঢুকছে। খুব ধীরে সন্তর্পণে। একজন পাহারাদার মা জেগে আছে আন্দাজ করছে নাকি? জানলার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছি না। ঢুকে আসছে বুকে হেঁটে। তক্ষক সাপ এইরকম দেখতে হয় নাকি? শুনেছিলাম যেন এরকমই। কী করে আটকাব ওকে? প্রাণপণে সঙ্গের মানুষটিকে ডাকতে লাগলাম। এই এই, ওঠো ওঠো। বুক ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছি কিন্তু আওয়াজ বেরচ্ছে না। ভয়ে, উৎকণ্ঠায়, বেদনায় চোখ থেকে জল গড়িয়ে আসছে। ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় কেউ নক করছে শুনতে পেলাম।
ধড়মড় করে উঠে বসলাম। দেখলাম সকাল হয়ে গিয়েছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতেই পারিনি। স্বপ্ন দেখছিলাম তাহলে? আসল বিপদ আসেনি! কান পেতে শুনতে চাইলাম সেই আওয়াজটা। না, সেই নাইট ওয়াচারদের ডাক থেমে গিয়েছে। ভোর হতে আমরা উঠে পড়েছি। ওরা বোধহয় ঘুমতে গিয়েছে এখন।
বুক থেকে আতঙ্কের ভার নেমে গেল। কিন্তু মাথার মধ্যে জেগে থাকল সেই রোমাঞ্চকর অসাধারণ রাতের স্মৃতি। অসংখ্য তক্ষকের সঙ্গে একটি রাত পাশাপাশি কাটিয়েছি। অশান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে।