কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
ছোটবেলাটা বাগবাজারে কাটিয়েছি। লকডাউনের আগে মাসে একবার করে হলেও ওদিকে যেতাম, এ-গলি ও-গলি ঘুরে বেড়িয়ে মনের নানাবিধ ভাবসঞ্চার আস্বাদন করতাম। কেতাবাজ প্রবীর এখন স্থবির। একবার বলেছিল, পকেটে চিরুনি থাকলে বের কর। তারপর বুক পকেট থেকে একটা ডাঁটি বাইরে ঝোলানো সানগ্লাসটা চোখে পরে নিয়ে (সানগ্লাসকে গগলস্ বলতাম, যেমন অমলেটকে মামলেট) বলেছিল দেখ, আমার চোখের কাচে মুখ দেখতে পাচ্ছিস তো, মাথাটা আঁচড়ে নে। কথায় কথায় ঘুষি মেরে দাঁত ফেলে দেব বলা টোকলা এখন পুরো ফোকলা। যে সেলুনটির মালিক নকুলদা একদা অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল—‘দেখে নিস, এই উত্তম ছাঁটটাই উঠে যাবে। দেখে নিস, এই জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাবেন। দেখে নিস, ফুটবল খেলা দেখতে লোক যাবে না।’ আমার বাল্যবয়সে এসব ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। কিন্তু কিছু কিছু ভবিষ্যদ্বাণী ফলেছিল। বছর বারো আগে দেখা— বৃদ্ধ হয়েছেন, নিজে চুল কাটেন না, কর্মচারী রাখা আছে। বললেন, ‘বলে রাখলুম, এই বাগবাজারে আবার বাঘ ফিরে আসবে।’ এটাও মিলে গিয়েছে। বাগবাজারে গেলে দেখতে পাবেন, বাটা মোড়ের কাছাকাছি রয়েল বেঙ্গল টাইগার রোল-চাউমিনের দোকানের দিকে তাকিয়ে হাঁ করে আছে। গিরিশ মঞ্চের কাছাকাছি এক জায়গায় বাঘে হরিণে একসঙ্গে জল খাচ্ছে, ঝরনার জল। সব সৌন্দর্যায়ণ আর কি। ঘুরতে ঘুরতে কখনও যেন মনে হয় মা সারদা গঙ্গাস্নান করে দুর্গাচরণ মুখার্জি স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে গেলেন এইমাত্র। ওঁর সাদা শাড়ি থেকে ঝরা জল ফোঁটাফোঁটা পড়ে আছে, গিরিশ ঘোষের বাড়ির ছাদ থেকে পেটকাটি ঘুড়ি উড়ছে, ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ছাদে মুখপোড়া। ঘুড়ির লড়াই চলছে, পশুপতি বসুর বাড়ির ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধে পাড়া ম’ম’ করছে। (বেণী ঝোলানো শাড়ি পরা মেয়েরা যাচ্ছে নিবেদিতার ইস্কুলে) নিধুবাবুর শিষ্য মোহনচাঁদ গলা সাধছেন, জানলায় দাঁড়িয়ে শুনছেন গোপাল উড়ে।
এরকম কত কিছু। গলিতে গলিতে গুপ্ত গল্প। একদিন মারহাট্টা ডিচ লেন দিয়ে হাঁটছি, দেখছি জজ সাহেবের বাড়ির সিঁড়িতে বসে বিড়ি বাঁধছে কয়েকজন আর সিংহটার মুখের ভিতরে বসে আছে একটা পায়রা। (ফটিক সাহার মুদি দোকানটাকে তিন টুকরো করে তিন ছেলে বসছে) কটকটি-তেলেভাজার দোকানটায় মোবাইল রিচার্জ হয়, জেরক্সও। ডাল বড়াটা কী ভালোই না করত। এমন সময় এক প্রৌঢ়া আমার সামনে এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল।
‘কী গো, চিনতে পারছ?’ চোখ-মুখে কারুকাজ, হাসছে, ও হাসির ব্যাখ্যা কোনও মানে বইতে থাকবে না। একটা চোখ মৃদু টিপে দিল। দাঁতে ঠোঁট টিপল। সামনে দুটো দাঁতই নেই।
খুব চেনা লাগছে, অথচ চিনতে পাচ্ছি না। আমি মাথা নাড়াই, না-তো...।
‘এত ঝাড়ি কত্তে, আমি কলের জলে নাইতে এলে তুমি তোমাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তাছাড়া তুমি আমাকে এই দোকানটা থেকে ডালবড়া খাইয়েচ কত দিন, কাপের আইসকিরিম একদিন, তাছাড়া...’
আমি চিনতে পারি। ওর মাকে আশার মা বলত। মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই দারুণ দেখতে ছিল। ছেলেদের সঙ্গে ডাংগুলি খেলত। কর্পোরেশনের ইস্কুলে পড়ত। জগা, তাপস, মনারা বলত স্কিপিং লাফাত দেখি, কেমন পারিস! একশো লাফালে দুটো ডালবড়া। ও স্কিপিং লাফাত। তখন ও ফ্রক। তেরো-চোদ্দো বছর বয়েস। আমি ক্লাস সিক্স।
তোমার মতন দেখতে একজন আছে, জানো তো, টিভিতে দেখি মাঝে মাঝে।
আমি বলি, তাই বুঝি? কী নাম?
‘কে জানে কী নাম? ওসব ফালতু পোগ্গাম দেখি নাকি তাই? কিন্তু এক্কেবারে তোমার মতোই দেকতে। মাইরি বলছি। থাকগে যাক। আমাকে চিনতে পারছ তো! কতদিন পরে দেকা, আমার নামটা কী বল তো, আমার নামে কিন্তু একজন সিনিমা আর্টিস ছিল, হিরোইন। হিন্টু দিলুম’, হি হি।
হিন্ট লাগত না। তুমি তো আশাদি। কিন্তু তুমি তো বিলেত চলে গিয়েছিলে, পাবলো তোমায় বিয়ে করেছিল না? পাবলো ছিল যুগোশ্লোভিয়ান সাহেব। তখন সল্টলেক ভরাট করার কাজ চলছিল। ড্রেজারে গঙ্গার মাটি কেটে কাদা করে সল্টলেকে পাঠাবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একটা যুগোশ্লাভ কোম্পানিকে। অনেক সাহেব থাকত তখন। কয়েকজনের সঙ্গে আমাদের খুব ভাব হয়েছিল। ডাংগুলি, সাতগুটি এসব খেলত। আমাদের একটা খেলাও ছিল— যেখানে জিতলে বা হারলে ‘টাকা’ দিতে হতো। আমাদের কাছে টাকার বাণ্ডিল থাকত মানে সিগারেটের প্যাকেট থেকে টাকা তৈরি হতো। পাসিং শো-এর প্যাকেটের দাম ছিল কম। ক্যাপস্টেন, গোল্ড ফ্লেকের বেশি। ফাইভ ফিফটি ফাইভ হাজার টাকা। পেতাম না তো। যুগোশ্লাভ সাহেবরা ওদের দেশের সিগারেটের খালি প্যাকেট দিত। সেগুলোর দাম ধরা হতো দু’হাজার টাকা। সাহেবদের নাম ছিল পাবলো, টিটো, ড্যানিয়েল, জোসেফ...। পাবলো এই মেয়েটাকে ড্রেজারে নিয়ে যেত। তারপর উনিশশো ছেষট্টি নাগাদ পাবলো মেয়েটাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল। খিলখিল হেসে উঠল ফোকলা আশাদি। বলল, ‘সে তো সেই কবেকার কথা। তারপর কত জল বয়ে গেল গঙ্গায়। পাবলো বছর পাঁচ রেখেছিল। অ্যাই পুঞ্চু, আয় আয়... ইদিকে আয়!
একটা বছর চারেকের ছেলে রাস্তায় শুয়ে থাকা কুকুরের লেজ সোজা করছে। ‘এই দেকো পাবলোর চিন্নো।’ দেখি ওর চোখের নীল তারা। রং ফর্সা। বলল, ‘আমার নাতি। মানে, আমার আর পাবলোর একটা মেয়ে হয়। মেরি। গোয়াতে গান গায়। নাতিটা আমার কাছেই থাকে। ইংলিশ মিডিয়াম নার্সারিতে দিইচি। ওদেশে যাবার কিছুদিন পর খুব গন্ডগোল। ওদের সার্বিয়ান, বসনিয়ান কোয়েশিয়ান কত রকম গুরুপ। আর মারপিট। পাবলোর মাথায় বোমার টুকরো ঢুকল। ওখানে এক জাহাজির সঙ্গে আলাপ হয়। ইউসুফ। ও আমাকে ইন্ডিয়ায় নিয়ে এল ফের। আন্ধেরিতে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হল— সে অনেক কথা। চলো এক কাপ চা খেয়ে যাও। এই তো আমার ঘর। একটা সেন্টার করেছি। আয়া, রান্নার লোক, বাসন মাজার লোক সাপ্লাই করি।’
ঘরে নিয়ে গেল। খাটে শুয়ে আছে একজন সত্তরোর্ধ্ব মানুষ। সস্তার সোফা সামনে। বলল, ‘ইউসুফও গেল। এখন এই লোকটাই আমার বর। ওই দেখ পাবলো।’
আর অন্য একটি শিশু কোলে আশা।
জিজ্ঞাসা করি, ওই বাচ্চাটা কে?
বলল, ‘ইউসুফের। বাচ্চাটা ও নিয়ে গেছে। আমাকে তালাক দিল তো।
খ্রিস্টান হয়ে ওদের চার্চে পাবলোকে বিয়ে করেছি। মুসলমান হয়ে ইউসুফকে। এই লোকটাকে আর বিয়েটিয়ে করিনি। আমি এখন হিন্দু না খ্রিস্টান না মোসলমান জানি না কিনা...।’
বিছানায় শোওয়া লোকটা ভাবলেশহীন।