গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
‘তুলসী চক্রবর্তীর ঘরটা ছিল বড়জোর ৮ ফুট বাই ৬ ফুট। সামনের দাওয়ায় চেয়ার নিয়ে বসতেন। সামনে আয়না ধরে চোখ মুখ বেঁকিয়ে অভিনয় প্র্যাকটিস করতেন। ষাঁড়ের তাড়া খেয়ে প্রাণভয়ে সেই ঘরের দরজার পিছনে গিয়ে লুকলাম। আমাকে দেখে তুলসী চক্রবর্তীর সে কী আনন্দ! গিন্নিকে চিৎকার করে বললেন, দেখো কে এসেছে। যাও, ওর জন্য মিষ্টি নিয়ে এস। গিন্নি একটা দানাদার নিয়ে এলেন। ততক্ষণে ষাঁড়টা বিদায় নিয়েছে। একলাফে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে মনে হল যেন যমের হাত থেকে ছাড়া পেলাম। পরবর্তীকালে ভয়টা ধীরে ধীরে কেটে গিয়েছিল।’ উনি দারুণ ঢাক বাজাতে পারতেন। দুর্গাপুজোর সময় ঢাক বাজাচ্ছেন আর ধেই ধেই করে নাচছেন তিনি, এমন দৃশ্য এখনও উজ্জ্বল ষষ্ঠীপদর স্মৃতিতে।
শুধু বালক ষষ্ঠীপদকেই নয়, নিঃসন্তান তুলসী চক্রবর্তী ছোট ছেলেমেয়েদের খুব ভালোবাসতেন। ছোটরাও তাঁকে ‘দাদু’ বলে ডাকত। নাট্যকার দেবনারায়ণ গুপ্ত একদিন কথায় কথায় তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আচ্ছা তুলসীদা, ওরা আপনার কীরকম নাতি?’ তুলসীর উত্তর, ‘ভাইপো, ভাইঝি, ভাগ্নে, ভাগ্নি এদেরই ছেলেপুলে হবে বোধহয়।’ বিস্মিত দেবনারায়ণ বললেন, ‘বোধহয়’। তিনি বুঝিয়ে বললেন, ‘ওদের মা-বাপকে কোনওদিন দেখিনি। জানিও নে। ওরা দাদু বলে, আমিও নাতি পাতিয়েছি।’ পাশেই বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা শ্যাম লাহা বসে বসে এতক্ষণ দু’জনের কথা শুনছিলেন। শ্যাম টিপ্পনি কাটলেন,‘আমাকেই দেখুন না। জাত নয়, জ্ঞাত নয় অথচ আমার ওপর ওর কী টান!’ তুলসী বাধা দিয়ে বললেন, ‘স্নেহ তো দূরের কথা, ওকে আমি এড়িয়ে চলতেই চাই। সব জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে ওকে নাকি আমি পুষ্যি নেব বলেছি।’ একটু দম নিয়ে আবার বললেন, ‘ওকে পুষ্যি নেওয়া মানে ডাইনির কোলে পুত্র সমর্পণ করা। ওকে পুষ্যি নিয়ে বশে আনতে হলে ভীম ভবানীর মতো লোক দরকার।’
সবাই হেসে উঠল। তুলসীর ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি বলে চললেন, ‘হাওড়া থেকে বাসে যাতায়াত করি। শীতে বড় কষ্ট হয়। ভাবলাম একটা ভালো কাপড়ের লং কোট তৈরি করাই। সেই কথা শুনে হুয়া (শ্যাম লাহার ডাকনাম) বলে কিনা, আমার ওপর ভার দিন, সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সে কথায় কান দিইনি। কারণ আমার কোট তৈরির নামে এমন একটা জিনিস বানিয়ে আনবে যা হুয়ার গায়ের জন্য ঠিক, আমার জন্য নয়। তাই সাত-পাঁচ ভেবে অন্য ব্যবস্থা করেছি।’ এই কথোপকথনের মাঝেই হাজির হলেন অনুপকুমার। তুলসী চক্রবর্তীর উদ্দেশে বললেন, ‘জ্যাঠামশাই আসুন।’ অনুপকুমারের বাবা প্রখ্যাত গায়ক-অভিনেতা ধীরেন দাসের সঙ্গে তুলসী মঞ্চে, পর্দায় অনেকদিন কাজ করেছেন। তুলসীকে তাই অনুপ জ্যাঠামশাই বলে ডাকতেন। তাঁকে নিয়ে অনুপকুমার অন্য একটি রুমে গেলেন, গায়ে পরিয়ে দিলেন নতুন গরম কাপড়ের লং কোট। লবিতে এসে অনুপকুমারের দেওয়া কোট সকলকে দেখালেন তুলসী। বললেন, ‘অনুপ আমার ভাইপো, আমার বাপধন। কাপড়ের নমুনা এনে , দর্জি ডেকে সব ব্যবস্থা করে দিল। ভগবান ওর ভালো করুন। ওর বাড়বাড়ন্ত হোক। শুধু লোক দেখিয়ে জ্যাঠা বলে ডাকে না। সত্যিই ও ছেলের কাজ করেছে। অনুপ থাকতে আমার আবার ছেলের ভাবনা।’ বলার সময় চোখ চিকচিক করে উঠেছিল তাঁর।
স্টার থিয়েটারের লবিতে যখন আসর জমিয়ে বসতেন তুলসী তখন একদিন সকলে জানতে চেয়েছিলেন যে, কেন তিনি সস্ত্রীক তীর্থ ভ্রমণে বছরে একবার করে বেরিয়ে পড়েন না? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘যে থিয়েটারে একদা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পায়ের ধুলো পড়েছিল, যে স্টারে স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা, বেলুড় মঠের প্রণম্য সন্ন্যসীরা, গিরিশ ঘোষ এসেছেন। তার থেকে বড় তীর্থ আর কিছু হতে পারে? এই স্টেজই আমার পুণ্যতীর্থ।’ বলার সময় তাঁর ভক্তিমিশ্রিত কণ্ঠ সবাইকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল।
স্ত্রী ঊষারানিকে নিয়ে দোতলা বাড়িতে উঠে যাওয়ার আগে একটা দু’কামরার ফ্ল্যাটে থাকতেন তুলসী। ঘরে আসবাব বলতে ছিল প্রাচীন পালঙ্ক, একটি কাঠের আলমারি, গোটা কয়েক টুল আর একটা ইজিচেয়ার। দোতলা বাড়িটা যখন ৬ হাজার টাকায় কেনেন, স্ত্রী তখন তুলসীকে তাঁর জমানো বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা পেয়ে তিনি যেমন অবাক হন, তেমনই ভয়ও পান। তুলসী অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করে যা পেতেন, তাই দিয়েই সংসার চলত। স্ত্রী যে সেখান থেকেও জমাতে পারেন, ভাবতেও পারেননি। তাই বাড়ি কেনার সময় স্ত্রীকে বলেছিলেন, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, ‘বাপের বাড়ি থেকে দিয়েছে।’ শুনে স্ত্রী হেসেছিলেন। কী-ই বা করবেন! কারণ বিধবা মা বিয়েই দিয়েছিলেন গোটা দু-তিনেক শাড়ি সম্বল করে। প্রচণ্ড অভাব সত্ত্বেও পরে সেই বাড়ি এলাকার দরিদ্র পুরোহিতদের দান করে দিয়েছিলেন তুলসী। স্ত্রীর ভবিষ্যতের কথা ভাবলেও নিজের মহানুভবতা স্ত্রীর জীবনে দুঃখ ডেকে আনে।
শেষ জীবনে তুলসী অসুস্থ হয়ে পড়েন। শরীর ভেঙে গিয়েছিল। একটু ভালো হতেই বাজারে গিয়ে নিয়ে আসেন ফুলকপি, কড়াইশুঁটি আর গলদাচিংড়ি। রাতে যত্ন করে রেঁধে খাওয়ালেন স্ত্রী। ভোররাত থেকে শুরু হল বমি। ডাক্তার আসতে না আসতেই সব শেষ। ১৯৬১ সালের ১১ ডিসেম্বর। ন্যূনতম শেষযাত্রাটুকুও হয়নি। তুলসীর মৃত্যুর পর ঊষারানি একমুঠো অন্নের জন্য লোকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। দারিদ্র্যের কারণে স্বামীর সবকটি মেডেল বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এভাবে কাটিয়েছেন প্রায় ৩৫টি বছর। আর্টিস্ট ফোরাম কিছু সাহায্য করেছিল। শেষের দিকে সাহায্য করতেন মিঠুন চক্রবর্তী। তবে, কোনও সরকারি সাহায্য পাননি। শেষমেশ অন্নকষ্টে চলে যান তিনিও। অভাব অনটন মানুষগুলির সঙ্গে কেড়ে নেয় মেডেলগুলিও। ইতিহাস চলে যায় কালের গর্ভে।
অভিনয়ের ঈশ্বর হয়েও তুলসী চক্রবর্তী ইন্ডাস্ট্রি থেকে প্রাপ্য মর্যাদা পাননি। শতবর্ষ পেরিয়েও তাঁর নামে নেই কোনও পুরস্কার, শহরের কোথাও নেই কোনও মূর্তি। জন্মদিন, মৃত্যুদিনও প্রায় বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গিয়েছে। অথচ পর্দায় তাঁর উপস্থিতি এখনও দর্শকের চোখে পলক ফেলতে দেয় না। আসলে প্রচারসর্বস্ব দুনিয়ায় তুলসী ছিলেন বেমানান। চাইলেই তাঁর শিল্পসত্তার মাধ্যমে বেছে নিতে পারতেন একটা বিলাসবহুল জীবন। কিন্তু চাননি শিল্পের ব্যাপারি হতে। অভিনয় প্রতিভায় ভর করেই আজীবন দর্শক মনোরঞ্জনের চেষ্টা করেছেন তিনি। বাংলা ছবি এই প্রতিভার ছোঁয়া পেয়েছে বহুবার। সেই ছোট ছোট ছোঁয়াতেই সোনা হয়ে উঠেছে কত সাদামাঠা দৃশ্য। দুঃখকে নিজস্ব মনের অনুঘটকে জারিত করে এমন অসামান্য সব কাজ সহজ ভাষায় যিনি লিখতে পারেন, তাঁর মুখেই তো মানায় ‘হলদে সবুজ ওরাং ওটাং...’। টলিউডের সত্যিকারের পরশপাথর যে তিনিই।(ক্রমশ)