কর্মপ্রার্থীরা বেশ কিছু সুযোগের সংবাদে আনন্দিত হবেন। বিদ্যার্থীরা পরিশ্রমের সুফল নিশ্চয় পাবে। ভুল সিদ্ধান্ত থেকে ... বিশদ
কথাটা সোনার পাথর বাটির মতো। এর মর্ম একদিন বুঝেছিলাম।
অপমান কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি এমন মিথ্যে কথা বলতে পারব না। সুখ-দুঃখের মতো মান-অপমান আমাদের নিত্য সঙ্গী। কেবল এইসব নয়। জীবনের নানা দিকে ছড়িয়ে আছে কত মজা, প্রীতি, ভালোবাসার অশ্রুকণা। মনে হয় জীবন যেন নিজে আমার কাছে এসে তারই গল্প বলে। কুড়িয়ে নিই সেই কণাকাহিনীগুলি। তা দিয়ে অবশ্য মালা গাঁথি না। মনে সঞ্চয় করে রাখি। নাকি মনই সঞ্চয় করে রাখে!
একদিন এই কণাকাহিনী নিয়ে লিখতে বসি। তখন কণা বর্জিত হয়ে পুরোপুরি এক কাহিনী হয়ে ওঠে। সেই কাহিনী কখনও ভালো হয় কখনও হয় না। ছেলেবেলায় শীতের সকালে আবছা কুয়াশার ভিতর দেখেছিলাম আপার সার্কুলার রোডের ওপারে মূক-বধির ইস্কুলের সামনে দিয়ে ঘড় ঘড় করে মালগাড়ি চলে যাচ্ছে। সময় তখন ভোর। শীতকাল। চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন। আমার বয়স তখন ওই ভোরের মতো। তিন বছর। ধরেছিলাম বাবার হাত। কী দেখতে কী দেখেছি কে জানে।
আরও খানিকটা বড় হয়ে, বয়স তখন বারো, তখন তিন বছর বয়সের স্মৃতিকে মনে হয় অলীক। স্বপ্ন দেখেছিলাম। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দেখি উলটো দিকে লেডিজ পার্ক, ব্রাহ্মবালিকা বিদ্যালয়, মূক-বধির ইস্কুল— যে যার নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় মান্ধাতার আমলে যেটি মারহাটা ডিচ ছিল তা হয়েছে সার্কুলার রোড।
আমার সেই বারো বছর বয়সের সামনে তখন ওই রাজপথ। ঘন্টি বাজাতে বাজাতে উত্তরের ট্রাম যাচ্ছে গ্যালিফ স্ট্রিটে আর দক্ষিণমুখী ট্রাম গড়ের মাঠের দিকে। রাস্তায় সেই সময় কত ধরনের মোটরগাড়ি। পন্টিয়াক, ডজ, প্লি-মাউথ, অস্টিন, ফোর্ড, মরিস, স্টুডিবেকার, হিলম্যান, বুইক ইত্যাদি।
তখন আমার বয়স বারো। তখন উড়ালপুলহীন কলকাতা একেবারে অন্যরকম। লাল কিংবা নীল দোতলা বাসের জানলার ধারের সিটে বসে একটি বালক ললিপপ খেতে খেতে চলে যাচ্ছে যাদবপুর। এইট-বি বাস।
কিন্তু কোথায় সেই ট্রেনলাইন! নেই। নেই। বালকের স্বপ্নে এসেছিল রেলগাড়ি। ভোরবেলায় স্বপ্ন দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, দাদুকে জিজ্ঞেস করব। জিজ্ঞেস করা আর হল না। ওই বছরেই দাদু মারা যান।
আমার বয়স যখন তেরো তখন একবার রাস্তা পেরিয়ে চলে যাই ওই মূক-বধির ইস্কুলের সামনে। মাথা নিচু করে খুঁজি ট্রেনলাইন। পাই না। খুঁজতে খুঁজতে আরও উত্তরের দিকে এগিয়ে যাই। মাঝে মাঝে মনে হয় পাচ্ছি। একটু-আধটু আভাস পাচ্ছি। মনে হচ্ছে একদিন এখানে রেলগাড়ি চলত। ট্রেনলাইন ছিল। হেলে দুলে চলত মালগাড়ি। ওপারে দাঁড়িয়ে একটি শিশু দেখেছিল সেই চলমান রেলগাড়ি।
আরও একটু বড় হয়ে বাবার কাছে শুনেছিলাম ওই মালগাড়ির কথা। কলকাতা শহরের জঞ্জাল নিয়ে মালগাড়ি চলে যেত ধাপার মাঠের দিকে।
শৈশব যা দেখে সব অলীক নয়। স্বপ্ন নয়। অফুরন্ত কল্পনা নয়।
তবু শৈশবেই আমরা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে হেসে বা কেঁদে উঠি। কবি দেবেন্দ্রনাথ সেন ঠিকই বলেছেন, ‘শৈশবের আবছায়ে শিশুর দেয়ালা।’
আমরা ক্রমশ বড় হয়ে উঠি। ইস্কুলে যাই। সেখানে কতরকম মাস্টারমশাই। কেউ কেউ পড়ার বাইরে অনেক জানা-অজানা জ্ঞানের কথা বলেন। মাঝে মাঝে গল্পও বলেন। নিরীহ ভালোমানুষ মাস্টারমশাইয়ের ক্লাসে আমরা গন্ডগোল করি। আর রাগী মাস্টারমশাই ক্লাসে ঢুকলে আমরা সুবোধ বালক হয়ে যাই।
বিকেলে পাড়ার মাঠে খেলাধুলো করি। সন্ধেবেলায় বাড়িতে বাড়িতে বেজে ওঠে শাঁখ। আমরা বাড়ি ফিরি।
ছুটির দিনে হয়তো মেজোমাসিমা এবং মেসোমশাই কালীঘাট থেকে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন।
রেডিওতে স্থানীয় সংবাদ হয়, হয় পল্লিমঙ্গল আসর কিংবা শ্রীধর ভট্টাচার্যের প্রযোজনায় বেতার-নাটক।
ভোরে ঘুম ভেঙে যায় অমলাদির চিৎকারে। পাশের বাড়ির অমলাদি ভোরে উঠে গলা সাধেন।
ছুটির দুপুরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি দুটো বুড়ি কাঁখে পুঁটলি নিয়ে যাচ্ছে আর বলছে, ‘দাঁতের পোকা বার কো..র্...ই।’
আমরা বড় হয়ে উঠি। কেউ হই ইঞ্জিনিয়ার, কেউ উকিল, কেউ কেরানি, কেউ সাংবাদিক, আবার কেউ মাস্টারমশাই। আমরা অমলকান্তি হতে পারি না।
ভোরবেলায় খিদিরপুরের দিকে একটি ইস্কুলে সে পড়াতে যেত। সে কে! আপনি! এমন প্রশ্নের উত্তরে বলব, ‘আমি নই। সে। আপনিও হতে পারেন। গল্পটা শুনুন।’
কোনও দিন দোতলা বাসে চেপে সোজা খিদিরপুর। মাঝে মাঝে ধর্মতলায় নেমে খিদিরপুরগামী ট্রাম ধরত। সবুজ ময়দানের বুক চিরে পানসির মতো তরতর করে ছুটে যেত ট্রাম। অদূরে ভোরের আলোয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। রেসকোর্স। রেড রোডে অশ্বারোহী পুলিস। আর চারদিকে ময়দানের সবুজ গাছপালা। কোথাও কোথাও রঙিন ফুল ফুটে থাকত গাছে।
সেদিন বাড়ি ফেরার সময় ট্রাম থেকে নেমে সে বাসে উঠল। সিট ফাঁকা বলতে একটি লেডিজ সিট। দু’জনের সিট। বাস ডালহৌসি হয়ে যাবে। ভোরের স্কুল ছুটি হয় দশটা কুড়িতে। তখন এগারোটা পাঁচ। অফিস টাইম। কিন্তু এসপ্ল্যানেড থেকে কোন মহিলা এমন সময় এই বাসে উঠবেন!
সে বসার পাঁচ মিনিট পরে এক তরুণী যে এই বাসে উঠেছেন খেয়াল করেনি। সে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। রুক্ষ নারীকণ্ঠে তার সম্বিৎ ফিরল, ‘এটা লেডিস সিট।’
সে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। তরুণী বসলেন। দেখে মনে হয় অফিসে কাজ করেন। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পের নায়িকার মতো। অনেকটা।
এখন ওই তরুণী ব্যাগ খুলে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করলেন। তরুণ মাস্টারমশাইয়ের খুব চেনা পত্রিকা। পেজমার্ক ছিল বাসের টিকিট। একটি গল্প পড়তে শুরু করলেন। সে চমকে উঠল। তারই লেখা গল্প। তরুণী মন দিয়ে পড়ছেন। এই শনিবার গল্পটি বেরিয়েছে। আজ সোমবার। বাস ছুটছে। সে লোহার রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এই সিটের সামনে। বাসে বড় ভিড়। একপা সরে যাওয়ার উপায় নেই।