পঠন-পাঠনে আগ্রহ বাড়লেও মন চঞ্চল থাকবে। কোনও হিতৈষী দ্বারা উপকৃত হবার সম্ভাবনা। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
একজন মানুষের মধ্যে যে কতগুলো মানুষ লুকিয়ে থাকে তার বুঝি ইয়ত্তা নেই।
তা তো হবেই। মনুষ্য-চরিত্র তো কখনওই কেবল সাদা অথবা কালো দিয়ে তৈরি হয় না। এই দুনিয়ায় কোনও মানুষই তেমনটা নয়। হরেক রঙের শেড নিয়েই মানুষ।
এসব কথা বলতে গিয়ে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে কাঞ্জিলালের কথা।
তারক কাঞ্জিলাল। মেদিনীপুর জেলার বিখ্যাত ‘চণ্ডী অপেরা’র নামকরা গায়ক তিনি। বাংলা-বিহার-অসম জুড়ে তাঁর বিপুল নামডাক। ওই বিশাল এলাকার যাত্রামোদী সমাজ তাঁকে কেবল কাঞ্জিলাল নামেই একডাকে চেনে। তিনি দলে আছেন শুনলেই সেই অপেরার দু’দশটা বাড়তি বায়না হয়। আর, গোটা বাংলা-বিহার-অসম জুড়ে ছড়িয়ে ছিল তাঁর শত শত ভক্ত।
আমিও তখন চণ্ডী অপেরা’য় রয়েছি। একেবারে কাছ থেকে শুনেছি কাঞ্জিলালের গান। সত্যি, অসাধারণ কণ্ঠ ছিল ভদ্রলোকের। একেবারে সাজঘর থেকে যখন ভরাট কণ্ঠে গান ধরতেন, গোটা আসরটা বুঝি গমগম করত। আবার করুণ রসের গান গেয়ে আসরের সব মানুষকে কাঁদিয়ে ছাড়তেন।
পালাগানের বাইরের সময়টুকু একা একা থাকতেই ভালোবাসতেন মানুষটি। সঙ্গী বলতে ছিল মদের বোতল। দিনভর দেশি মদ খেয়ে সারাক্ষণ একেবারে চুর হয়ে থাকতেন। এমনকী, পালাগান শুরু হওয়ার আগেও গলায় ঢেলে নিতেন আধ বোতল মদ। কিন্তু নিজের সময়টি আসামাত্র টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়াতেন। টলতে টলতে বেরিয়ে আসতেন সাজঘরের মুখ পর্যন্ত। ওখান থেকেই ধরতেন গান। তখন কে বলবে, আকণ্ঠ মদ খেয়ে একেবারে বেহেড হয়ে রয়েছেন ! সুরে, তালে, লয়ে এক্কেবারে নিখুঁতভাবে গানটি গাইতে গাইতে আসরে ঢুকতেন, একেবারে স্বাভাবিক ঢংয়ে গানটি গেয়ে, শ্রোতাদের একেবারে মজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসতেন আসর থেকে। সাজঘরে ঢুকেই আরও ক’ঢোঁক খেতেন।
দলের কোনও শিল্পী প্রকাশ্যে এমনটা করলে, যেকোনও অপেরা-মালিকেরই দলের সামগ্রিক শৃঙ্খলার প্রশ্নে আপত্তি তোলারই কথা। কিন্তু স্রেফ এমন একটি ঈশ্বর-প্রদত্ত কণ্ঠে’র কারণেই তিনি মাফ পেয়ে গিয়েছেন চিরকাল।
একবার ঝাড়গ্রামের কাছাকাছি একটি গাঁয়ে পালাগান চলছে আমাদের। কার্তিক মাসের মাঝামাঝি। আমাদের ঠাঁই হয়েছে গাঁয়ের একটি স্কুলে। গাওনের শেষ রাত ছিল ওটা। রাত পোহালেই চলে যাব ঝাড়গ্রাম শহরে। সেখানে রাজবাড়িতে আমাদের গাওন রয়েছে।
তো, পালাগান সাঙ্গ হতেই সাজঘরে এক যুবক এসে হাজির। প্রথমেই সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পড়ল কাঞ্জিলালের পায়ের তলায়। ভক্তিভরে প্রণাম সেরে বলল, ওস্তাদজি, আজ বহু বছর আমি আপনার গানে পাগল হয়ে রয়েছি। কাছে-দূরে যেখানেই আপনার দলের গাওন হয়, খবর পেলেই চলে যাই, কেবল আপনার গলায় গান শুনব বলে। আমিও অল্পস্বল্প গান-বাজনা করি। তাতেই বুঝি, কী অমূল্য সম্পদ লুকিয়ে রয়েছে আপনার কণ্ঠে !
পালাগানের শেষে বোতলের বাকি মদটুকু গলায় ঢেলে নিয়ে কাঞ্জিলাল তখন পুরোপুরি বেহেড। ওই অবস্থায়ও ঢুলুঢুলু চোখে হাসেন তিনি।
ঠিক তখনই যুবকটি বলে ওঠে, আপনার মতো ওস্তাদ এই মাটির স্কুলঘরে মেঝের ওপর শোবেন ? ঠান্ডায় আপনার খুবই কষ্ট হবে। ঠান্ডা লেগে গলাটা খারাপও হয়ে যেতে পারে। তাই, বলছিলাম, দয়া করে যদি আমার বাড়িতে পায়ের ধুলো দেন, যদি রাতটা আমার বাড়িতে কাটান, তবে একেবারে ধন্য হয়ে যাই!
যুবকের কাতর মিনতির জবাবে কাঞ্জিলাল একপায়ে খাড়া। জড়ানো গলায় বলেন, এ আর বেশি কথা কি! যেখানে খুশি থাকলেই হল।
আহ্লাদে গদগদ যুবক কাঞ্জিলালকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল নিজের বাড়িতে।
পরদিন একটু বেশি বেলায়, গোটা দল তখন ঝাড়গ্রামের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার জন্যে তৈরি, এমনি সময়ে যুবকটি হন্তদন্ত হয়ে এল।
জিজ্ঞেস করল, ওস্তাদজি আসেননি?
— কই না তো।
কেমন জানি উদ্ভ্রান্ত লাগছিল যুবককে। আমাদের জেরার জবাবে অতিশয় কুণ্ঠিত গলায় যা জানাল, তার মর্মার্থ হল, গতকাল রাতে ওর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে যৎপরোনাস্তি খাতিরযত্ন করেছে কাঞ্জিলালকে। চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় দিয়ে খাইয়েছিল। বৈঠকখানায় বাহারি খাটে পরিপাটি বিছানা পেতে, নতুন কেনা নেটের মশারি টাঙিয়ে, শুতে দিয়েছিল। রাতে যদি তেষ্টা পায়, এই ভেবে মাথার কাছে কাঁসার ঘটিতে একঘটি জলও রেখে দিয়েছিল। রাতে যদি ওস্তাদের প্রয়োজন পড়ে এই ভেবে বালিশের পাশে রেখে দিয়েছিল একটি পাঁচ শেলের টর্চ। এমনকী, ওস্তাদজি বিছানায় ঢুকে পড়ার পর বাইরে থেকে মশারিটা পর্যন্ত বিছানায় গুজে দিয়েছিল।
একটু বাদে কাঞ্জিলাল ঘুমিয়ে পড়লে যুবকটিও ঘুমতে যায়।
পালাগান শোনার সুবাদে ঘুমতে যেতে বেশ দেরিই হয়েছিল বাড়ির সকলের। কাজেই, পরের দিন সকালে বেশ দেরি করেই ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু সাত-তাড়াতাড়ি বৈঠকখানায় এসে যুবক দেখে, কাঞ্জিলাল নেই। সেই সঙ্গে বিছানায় পাতা নতুন বেড-কভারটা নেই, নেটের মশারিটাও নেই। এমনকী, জলের ঘটি এবং পাঁচ শেলের টর্চটাও নেই। শুধু তাই নয় বৈঠকখানার দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা মাছ ধরবার নতুন জালটাও নেই।
যুবক তৎক্ষণাৎ গাঁয়ের প্রায় সমস্ত সম্ভাব্য জায়গায় খুঁজেটুজে, অবশেষে এসেছে স্কুলে।
যেমনই উদ্ভ্রান্তের মতো এসেছিল, ওইভাবেই একসময় চলে গেল যুবক। যাওয়ার সময় অবশ্য আমাদের জনে জনে অনুরোধ জানিয়ে যায়, যেন কথাটি পাঁচকান না-হয়। এত বড় ওস্তাদের মান যাবে তাতে।
দলের তরফেও গোটা গ্রাম জুড়ে কাঞ্জিলালকে তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। কিন্তু কোথাও তার হদিস পর্যন্ত পাওয়া গেল না।
গোটা দলের ততক্ষণে অকূলপাথারে পড়বার মতো অবস্থা। রাতের বেলায় ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে গাওন, অথচ দলের তুরুপের তাস কাঞ্জিলালের কোনও খোঁজই নেই !
দিনভর আমাদের যারপরনাই উৎকণ্ঠার মধ্যে রেখে সন্ধে নাগাদ অবশ্য ফিরলেন কাঞ্জিলাল। মদে একেবারে চুর হয়ে রয়েছেন। বুঝতে পারছিলাম, যুবকের বাড়ি থেকে হাতানো জিনিসগুলো জলের দামে কাউকে বেচে দিয়ে ওই টাকায় দেশি কিনে দিনভর খেয়েছেন।
ওই অবস্থায় মুখে রং মাখতে বসে গেলেন তিনি। আর, ওই রাতে আসরে যা গাইলেন, তার কোনও তুলনা হয় না!
আজও মানুষটার কথা মনে পড়লে কেবল একটা কথাই ভাবি। এতবড় শিল্পীর বুকের মধ্যে একজন ছিঁচকে চোরও বাস করে!