পঠন-পাঠনে আগ্রহ বাড়লেও মন চঞ্চল থাকবে। কোনও হিতৈষী দ্বারা উপকৃত হবার সম্ভাবনা। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
মলিনাদেবীই শুধু নয়, রাজলক্ষ্মী দেবীর সঙ্গেও তুলসী চক্রবর্তীর জুটি ছিল মেগাহিট। বাংলা ছবির দর্শকদের নিশ্চয়ই স্মরণে থাকবে ‘হাসি শুধু হাসি নয়’ ছবিটির কথা। নায়ক বিশ্বজিৎ আর জহর রায়। ছবিতে তুলসীর আটখানা বাড়ি ছিল। আরও চারখানা বানিয়েছেন তিনি। আট মেয়ের বিয়েতে দশ দশ করে আশি হাজার টাকা খরচ করেছেন, তবু স্ত্রী রাজলক্ষ্মীর মন পাননি। তেরো বার তুলসীর সন্তান গর্ভে ধারণ করেছেন রাজলক্ষ্মী। যদিও তুলসী বলেন তাঁর নয়টি সন্তান। রাত বিরেতে মদ গিলে মুখে গন্ধ নিয়ে রোজ বাড়ি ফেরেন। ‘ধিঙ্গি’ মেয়েদের নিয়ে হুল্লোড় করেন বলে তুলসীর রোজগার করা টাকার মুখে ঝাঁটা মারেন রাজলক্ষ্মী। তাই ৩০ বছর সংসার করার পরেও অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে উকিলের চেম্বারে ডিভোর্স করতে ছুটে আসেন তুলসী-রাজলক্ষ্মী।
—ডিভোর্স চাই, ডিভোর্স চাই, ডিভোর্স চাই...
ওই একটা দৃশ্যেই মাত করে দিয়েছেন দু’জনে। এই দৃশ্যটা দেখার জন্যই ছবিটা বারবার দেখা যায়। কী অভিনয়ের দাপট দু’জনের! তুলসীর সংলাপের মতোই বলতে হয়, ‘বাপরে বাপরে বাপরে বাপ...।’
‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবি ছাড়াও তুলসীর অভিনয় জীবনে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকা। ‘পথের পাঁচালি’র পণ্ডিতমশাইয়ের পাঠশালা আর মুদির দোকানের মিলমিশ। পণ্ডিত মশাইয়ের ছিল একখানা ছড়ি। সেই ছড়ি কিন্তু তিনি শুধু ছাত্র পেটাতেই কাজে লাগাতেন না। নিজের পিঠ চুলকানো, মশা-মাছি তাড়ানোর বা নিজের পিঠের ঘাম মোছা সবই চলত। ‘পথের পাঁচালি’ ছবিতে পণ্ডিতমশাইয়ের চরিত্রে অভিনয় দেখেই পরবর্তীকালে সত্যজিৎ ‘পরশপাথর’ ছবিতে তাঁকে মূল চরিত্রে বেছেছিলেন। সত্যজিৎ নিজে তুলসীর বাড়ি গিয়ে ‘পরশপাথর’-এ অভিনয়ের অফার দিয়েছিলেন। এত বড় পরিচালক তাঁর বাড়িতে যাওয়ায় আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন অভিনেতা।
তুলসী চক্রবর্তীর চলচ্চিত্রপঞ্জিতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ থেকে ‘পরশপাথর’-এর ব্যবধানে মুখ্য চরিত্রে তাকে রেখে আর ছবি কোথায়? এ নিয়ে তাঁর মনেও কি একটা চাপা অভিমান ছিল? দুঃখ করে বলতেন, ‘সিনেমায় বেশকিছু ভালো কাজ পেয়েছি সেটা সত্যি, কিন্তু তার সংখ্যা হাতে গোনা। এতগুলো ছবিতে অভিনয় করলেও ক’টা মাত্র ছবিতে অভিনয় করে আনন্দ পেয়েছি সেটা আঙুল গুনেই বলা যায়। এসবের জন্য অভিমান আমার নেই। আর হবেই বা কেন? আমার কতটা কী কেরদানি দেখাবার ক্ষমতা সেটা তো আমি সবথেকে ভালো জানি। যেটুকু যা ভালোবাসা পেয়েছি, তা আমার মা-বাবা আর জ্যাঠামশাইয়ের আশীর্বাদের ফল।’
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জহর রায় চ্যাপলিন, বাস্টার কিটন, হ্যারি ল্যাংডেন প্রমুখ হলিউডের মহান ক্লাউনদের কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তাই এঁদের কিছু প্রভাব ভানু-জহরের অভিনয়-শিল্পে কোথাও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়ে কোথাও কোনও বিদেশি অভিনতোর প্রভাব লক্ষ করা যায় না। তাঁর অভিনয় নিতান্তই দেশজ। দেশের মানুষের চরিত্র লক্ষণের মধ্যেই তার শিকড় নিহিত।
এমন এক অভিনেতা তুলসী যিনি বেশিদূর লেখাপড়া করেননি। পৃথিবীর সিনেমা বা থিয়েটারের এমন কিছু খবর যিনি রাখতেন না, তিনি কী করে এমন ক্ষণজন্মা শিল্পী হয়ে উঠলেন, এটা সত্যিই বিস্ময়ের। শুধুমাত্র অভিনয়-কলার কুশলতা থাকলেই তো আর অত বড় শিল্পী হওয়া যায় না! কুশলী অভিনেতা থেকে মহৎ শিল্পীতে উত্তরণের পথে সবথেকে বড় প্রয়োজন জীবনবোধের। এই জীবনবোধ কেউ শিল্পীকে শেখাতে পারে না। এ একান্তই তাঁর নিজস্ব। মানবজীবনের নানা সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই এই জীবনবোধ গড়ে ওঠে।
তুলসী চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে এই বোধ পুঁথিপত্র থেকে আহরণ করা জ্ঞান সঞ্চয়ের মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়নি। ছোট থেকেই দুঃখ-দারিদ্র্য জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। মানুষকে চিনেছেন, জেনেছেন। ঠিক একইভাবে তাঁর স্বভাবের মধ্যেও এমন একটা জিনিস ছিল, যা তাঁকে সারাজীবন সাধারণ মানুষের জীবনপ্রবাহে ডুবিয়ে রেখেছে। আচারে, ব্যবহারে তো বটেই, মনের দিক থেকেও তুলসী ছিলেন একেবারে সাধারণ ঘরোয়া মধ্যবিত্ত বাঙালি। এত সাধারণত্বের মধ্যেও একটা অসাধারণত্ব ছিল তাঁর। তা হল মানুষকে চেনার আগ্রহ ও দেখার চোখ।
নটশ্রেষ্ঠ অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি বলেছিলেন, ‘আমি দেখি, তোমরা দেখিতে জানো না। তাই তোমাদের শিখিতে এক কষ্ট হয়। অভিনয় শিক্ষা কোনও ব্যক্তিবিশেষের নিকট হয় না— প্রকৃত অভিনয় সমাজের কাছে শিখিতে হয়। দেখিতে শিখিতে হয়— দেখিয়া বিচার করিতে হয়।... এবং উপযুক্ত অবসরে তা আরোপ করিতে চেষ্টা করিতে হয়।’
তুলসী চক্রবর্তী যেন অর্ধেন্দু শেখরের উদ্ধৃত কথাগুলোই নিজের জীবনের সঙ্গে সমানুপাত করে নিয়েছিলেন। ওঁর নাম শুনলেই আমাদের মনে যে ছবিটা ভেসে ওঠে তার থেকে বেরিয়ে একদল অন্য ধারায় দুটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। একটি ছবির নাম ‘জনক-নন্দিনী’। ওই ছবিতে সীতার বাবা জনক রাজার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। জনক রাজার ভূমিকায় তাঁর যে রাজকীয় আভিজাত্য প্রকাশ পেয়েছিল, তা যাঁরা সেই ছবিটি দেখেছিলেন তাঁরাই জানেন।
অন্য ছবিটির নাম ‘ভাবিকাল।’ পরিচালনায় নীরেন লাহিড়ী। কাহিনীকার ছিলেন সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র। ছবিটা সে বছর শ্রেষ্ঠ ছবির ‘বিএফজেএ’ পুরস্কার পেয়েছিল। তুলসী সেখানে একটি জটিল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। চরিত্রটি শুরুতে আদর্শবাদী ছিল। পরে ধীরে ধীরে ক্ষমতার মোহ, অর্থলালসা তাকে পাল্টে দিতে থাকে। পরবর্তীকালে বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলায়। একসময় আদর্শবাদী, আবার সেই কিছু পরে ক্ষমতালিপ্সু বিরোধী মতাদর্শের মানুষ। এই দ্বৈতসত্তাটি অভিনয়ের মাধ্যমে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তুলসী। এখানেও যে তিনি অসাধারণ অভিনয় করেছেন, তা কিছুতেই মানতে চাইতেন না তিনি। এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ওই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য ভালো অভিনেতা হওয়ার দরকার হয় না। তুমি যে সমাজে বসবাস করো, একটু চোখ-কান খোলা রেখে যদি সেই সমাজের মানুষগুলোকে দেখ, তাহলেই হবে। চোখের সামনেই তো দেখলাম কত মানুষের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেল। তাদেরই একজনের ধাঁচে চরিত্রটা করেছি। এতে আমার কোনও ক্রেডিট নেই।’