বিদ্যার্থীদের কোনও বৃত্তিমূলক পরীক্ষায় ভালো ফল করবে। বিবাহ প্রার্থীদের এখন ভালো সময়। ভাই ও বোনদের ... বিশদ
জ্যাঠামশাইয়ের গাট্টা খেয়েই যে তিনি অভিনয় জগতে চলে এলেন এমনটা নয়। কাজ নিলেন একটি ঘড়ি সারাইয়ের দোকানে। সেখানেও বেশি দিন মন টিকল না। একদিন ভোরবেলা কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালালেন তুলসী চক্রবর্তী। একেবারে চলে গেলেন বার্মায়। তখন ব্রিটিশ রাজত্ব ভারতে। বার্মা যাওয়ার জন্য ভিসা-পাসপোর্টের কোনও ব্যাপার ছিল না। বাড়ি থেকে পালিয়ে চড়ে বসলেন একটি জাহাজে, যেটি বার্মা যাচ্ছিল। সেই জাহাজেই ছিল ‘বোসেস সার্কাস’ নামে একটি সার্কাসের দল। তুলসী বেমালুম সেই সার্কাস পার্টির সঙ্গে ভিড়ে গেলেন।
পরে যখন তুলসী চক্রবর্তী পুরোপুরি অভিনয়ে চলে আসেন, তখন তিনি বাংলা ভাষার ছবির পাশাপাশি বেশ কিছু হিন্দি ও উর্দু ভাষার ছবিতেও চমৎকার অভিনয় করেছেন। সেই সব ছবিতে অভিনয়ের ভিত্তিপ্রস্তর তিনি স্থাপন করেছিলেন ওই সার্কাস দলে কাজ করতে করতে। কীভাবে? সার্কাস দলের মালিক বাঙালি হলেও ‘বোসেস সার্কাস’-এ বাঙালি কর্মচারী বেশি ছিল না। বেশিরভাগই ছিলেন আপ-কান্ট্রির লোক। ওদের সঙ্গে সারাক্ষণ ওদের ভাষাতে কথা বলতে বলতে হিন্দি আর উর্দু দুই ভাষাতেই বেশ সড়গড় হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। যা পরবর্তীকালে তাঁর নতুন পেশাতে সহায়তা করেছিল।
সার্কাসের দলেও বেশি দিন চাকরি করা হয়নি তাঁর। সিংহের খেলা দেখানো আর ট্রাপিজের কসরত ছাড়া সার্কাস দলের প্রায় সব ফাইফরমাস খাটতে হতো তাঁকে। বেশ কিছু ছোটখাট খেলাও শিখে ফেলেছিলেন। মাঝে মধ্যে শো-এর ফাঁকে ফাঁকে জোকার সাজতেন। এভাবেই তিনি হাস্যকৌতুকের দিকে ঝোঁকেন। কিন্তু একদিন এই সার্কাস দল থেকেই চম্পট দিলেন। এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘যেদিন দেখলাম আমার শরীর থেকে জন্তু-জানোয়ারের গন্ধ বেরতে শুরু করেছে, সেদিনই ঠিক করলাম যথেষ্ট হয়েছে আর নয়। কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে এলাম।’
বার্মা থেকে কলকাতায় আসার পর জ্যাঠামশাই প্রসাদ চক্রবর্তী তাঁকে নিয়ে গিয়ে চিৎপুরের এক ছাপাখানায় ভর্তি করে দিলেন। কম্পোজিটরের কাজ করার জন্য মন দিয়ে টাইপের কাজ শিখতে লাগলেন তুলসী। আর এই ছাপাখানার কাজ করতে করতেই আবার তাঁর মাথায় অভিনয়ের পোকা নড়ে উঠল। সেই ছাপাখানায় থিয়েটার পাড়ার পোস্টার আর হ্যান্ডবিল ছাপা হত নিয়মিত। পোস্টারে জ্বল জ্বল করা শিল্পীদের নাম আর হ্যান্ডবিলে বিভিন্ন থিয়েটারের মনোহারী ভাষা পড়ে তুলসীর মন আনচান করে উঠত। ভাবতেন, যদি নিজে কোনওদিন অভিনেতা হতে পারেন তাহলে তাঁর নামও এভাবে পোস্টারে ছাপা হবে। এই ভাবনায় ভর করেই জ্যাঠামশাইয়ের কাছে এসে তাঁকে থিয়েটারে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন তুলসী। এমনিতেই স্টারে জ্যাঠামশাইয়ের টিফিন বাক্স পৌঁছতে যেতেন তিনি।
জ্যাঠাও মনে মনে ভাবেন, এই ভালো। ভাইপো অভিনয়টা মন্দ করে না। আর ভাইপো অ্যাক্টিং করলে তাঁকে চোখে চোখে রাখতেও পারবেন তিনি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তিনি তুলসীকে নিয়ে গেলেন অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। প্রসাদবাবুর অনেক অনুরোধ-উপরোধে অবশেষে অপরেশবাবু স্টার থিয়েটারে সুযোগ দিলেন তুলসীকে। সালটা ছিল ১৯১৬। অপরেশবাবুই তালিম দিলেন তাঁকে। টপ্পা গান, পাখোয়াজ বাজানো শেখালেন। ধীরে ধীরে তিনি স্টেজে অভিনয় করার সুযোগও পেলেন। ১৯২০ সালে প্রথম নাটকে অভিনয় করলেন— ‘দুর্গেশনন্দিনী’। অভিনয় জীবনের শেষটা তাঁর স্টার থিয়েটারে— ১৯৬১ সালে ‘শ্রেয়সী’ নাটকে। ওই নাটকে অভিনয় করতে করতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। আর মঞ্চে ফেরা হয়নি। তার আগে অবশ্য ৪২টি নাটকে অভিনয় করা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত স্টার থিয়েটারেই ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। তারপর যোগ দেন মনমোহন থিয়েটারে। সেখানে থেকে আবার ফিরে আসেন স্টারে।
নাটকে ধীরে ধীরে নাম হতে লাগল। নাটকের সূত্রেই এল ফিল্মের অফার। কিন্তু থিয়েটার থেকে ফিল্মে আসতে আসতেও লেগে গেল আরও ১২টি বছর। প্রথম ছবি ‘পুনর্জন্ম’, ১৯৩২ সাল। ছবিটির পরিচালক ছিলেন সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। তুলসী মুখ দেখিয়েছিলেন একটি ছোট্ট ভূমিকায়। তারপর থেকে একের পর এক ছবিতে অফার আসতে থাকে। ‘শচীদুলাল’ ছবিতে নিমাই সন্ন্যাসীর গুরু অদ্বৈতাচার্যের ভূমিকায় তুলসীর অভিনয় তাঁকে পরিচিতি এনে দেয়। বাঙালি দর্শক তুলসী চক্রবর্তীকে মূলত কমেডিয়ান হিসাবেই চেনেন। অথচ, প্রথমদিকের ছবিগুলিতে তিনি কিন্তু কমিক রোলে অভিনয় করতেন না। ‘মেজদিদি’, ‘বামুনের মেয়ে’, ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘মানদণ্ড’, ‘নবীন যাত্রা’, ‘পণ্ডিত মশাই’... বাংলার পাশাপাশি প্রায় ২৫টা হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন। কিন্তু সে সব ছবির প্রিন্ট আজ আর নেই। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘একটি রাত’— তিনটি সিনেমায় কোথাও তিনি মেস মালিক। কোথাও আবার হোটেল মালিক বা সরাইখানা কাম ধর্মশালার মালিক। সবকটি চরিত্রেই তুলসী তাঁর স্বকীয়তা বজায় রেখেছিলেন। কখনও তাঁর অভিনয় এক ছাঁচের হয়ে যায়নি।
পথে চলতে চলতে বহু মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তুলসীর। বহু পেশার মানুষ দেখেছেন। তাই যে কোনও চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে অভিজ্ঞতার ঝাঁপি উপুড় করে দিতেন। নিজের দেখা মানুষের ছাঁচে ফেলে গড়ে তুলতেন চরিত্রটি। তাই তাঁর অভিনয় ওরকম স্বাভাবিক মনে হতো। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে কলকাতা থেকে দেশের বাড়িতে ফিরে গায়ের জামা খুলে দু’হাতে পৈতে পরিমার্জনের দৃশ্যটি যেন একদম ন্যাচারাল লাগে। এই প্রসঙ্গে পরে তুলসী চক্রবর্তী বলেছিলেন, ‘ছবির পরিচালক নির্মল দে বলেছিলেন, বাড়িতে যা যা করেন ঠিক তেমনটিই করবেন। প্রপারলি বিহেভ করাই হল গিয়ে অভিনয়ের অঙ্গ। তা আমি এমনিতেই কিছু করি বা না করি পৈতে টিকে মেজে ধপধপে করে রাখতাম। কাজের থেকেও বাড়ি ফিরেও রোজ পৈতে মাজা আমার অভ্যাস ছিল। ওটাই আমার ব্রাহ্মণত্বের পরিচয়। শ্যুটিংয়েও তেমনটিই করেছিলাম।’
‘অঞ্জনগড়’ ছবিতে ট্রাক ড্রাইভারের পাশে বসে ঢুলতে ঢুলতে চলেছেন তুলসী। হঠাৎ গাড়ি ব্রেক কষে আর তাঁর তন্দ্রা ভাব কেটে যায়। ঘুমন্ত অবস্থায় চমকে ওঠা দেখলে দর্শককেও চমকে উঠতে হয়। এখানেও পরিচালক বিমল রায় আলাদা করে কোনও নির্দেশ দেননি তুলসীকে। হাওড়া থেকে ট্রামে-বাসে করে যেমন ঢুলতে ঢুলতে টালিগঞ্জ আসতেন তিনি, সেই অভিজ্ঞতাই ওই দৃশ্যে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি একজন গীতিকারও ছিলেন। বহু ছবির গান মুখে মুখে তৈরি করে গেয়ে দিতেন। কীর্তন আর টপ্পা অসাধারণ গাইতেন বলে বহু ছবিতে তরজা দৃশ্যে কবিয়ালের চরিত্রে তাঁকে এমন স্বাভাবিক দেখিয়েছে।(ক্রমশ)