পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
‘নিশিপদ্ম’ ছবির সেই ফুচকা খাওয়ার দৃশ্যের মতো জহর রায়ের ইম্প্রোভাইজেশন নিয়ে আরও নানারকম মিথ রয়েছে। সিনেমার মতোই নাটক ও যাত্রাপালাতেও প্রবল প্রতিপত্তি ছিল জহর রায়ের। ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ নাটকের একটি ঘটনা। সেই নাটক বহু রজনী অতিক্রান্ত হয়েছিল রংমহলে। হাজারি ঠাকুরের ভূমিকায় অভিনয় করতেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। আর জহর রায় করতেন মতি চাকরের চরিত্রটি।
এমনিতে নাটকটিতে সেরকম কোনও কমেডি দৃশ্য ছিল না। কিন্তু মঞ্চে জহর থাকবেন, আর কমেডি তৈরি হবে না, সে কী হয়! শিশির ভাদুড়ি, অহীন্দ্র চৌধুরীর পরবর্তী যুগে বাংলা বাণিজ্যিক থিয়েটারে যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। সিরিয়াস চরিত্রই হোক বা কমেডি, বাংলা থিয়েটারের দর্শককে মন্ত্রবৎ বশ করে রাখতে পারতেন তিনি। দুরন্ত অভিনয় করলেও তাঁর একটা দুর্বলতা ছিল। হাসির দৃশ্যে তিনি হাসি চেপে রাখতে পারতেন না। ফলে রংমহলের মঞ্চে জহর রায়ের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির কারণে তাঁকে চূড়ান্ত অপ্রস্তুতে পড়তে হতো। কোনওমতে হাসি চেপে দৃশ্যগুলো উতরে দিতেন।
‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ নাটকটির একটি দৃশ্য ছিল, হাজারি ঠাকুর ‘মতি, মতি’ বলে তাঁর চাকরকে ডাকবেন। মতিও সব কাজ ফেলে স্টেজে ঢুকে বলবে, ‘কেন ডাকতিছ গো ঠাকুর?’ সেদিনও সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়মমাফিক হাঁক পেড়েছেন। কিন্তু জহর আর স্টেজে আসেন না। চিন্তিত সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় ভাবলেন, কী হল! জহর তো এবার সিন ফেল করবে! তাই বেশ জোরে ডেকে উঠলেন, ‘অ্যাই মতি।’
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সারা গায়ে ময়দা মাখা অবস্থায় হুড়মুড়িয়ে মঞ্চে প্রবেশ করলেন জহর। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ময়দা মাখা শুধু চোখ দুটো বেরিয়ে আছে। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ও জহরের ওই মূর্তি দেখে হকচকিয়ে গিয়েছেন। একে তো এভাবে ডাকার কথা নয়, তার উপর এই রকম গোরু চোরের মতো জুল জুল চোখে তাকাচ্ছেন জহর! দেখেই তাঁর ভীষণ হাসি পেয়ে গেল। কোনও রকমে সামাল দেওয়ার চেষ্টাও করলেন, ‘এ কী রে মতি! এ কী চেহারা হয়েছে তোর?’ জহর বললেন, ‘কী করব বলো, সবে ময়দা মাখব বলে গামলায় ময়দা ঢেলেছি, অমনি তুমি মতি বলে এমন জোরে ডাকলে, আমি ওই গামলা ভর্তি ময়দার মধ্যে মুখ থুবড়ে পইরে গেলুম।’
নাটকে ময়দা মাখা চেহারা বা এই ধরনের কোনও সংলাপ ছিল না। সত্যবাবু প্রমাদ গুনলেন। জহরকে দেখে তাঁর হাসি আরও প্রবল বেগে আসতে লাগল। পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বললেন, ‘হতভাগা! দূর হ। মুখ হাত পরিষ্কার করে আয় যা।’ ওদিকে জহর রায় তো বুঝে গিয়েছেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনের অবস্থা। তিনি যে হাসি চাপতে পারছেন না বলেই জহরকে ভাগিয়ে দিতে চাইছেন। তাই জহর পাল্টা বললেন, ‘তুমি মিছিমিছি রাগ কইরতেছ। ইচ্ছে করে কি আমি ময়দার উপর পইরেছি। কেন হাঁক দিলে আগে বলো দিকি।’
হাসির উদ্রেকে তখন সত্যবাবুর কথা বলার মতো অবস্থা নেই। প্রেস্টিজ বাঁচাতে জহরকে একপ্রকার ধাক্কা দিতে দিতে স্টেজ থেকে বের করে বললেন, ‘তুই আগে পরিষ্কার হয়ে আয় তার পর বলছি।’ তাঁকে মঞ্চ থেকে বের করে খানিক নিশ্চিন্ত হয়ে সবে কাঁধের গামছা দিয়ে ঘাম মুছছেন সত্যবাবু। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চে জহর রায়ের পুনঃপ্রবেশ।
—ও ঠাকুর, তুমি কেন ডাইকতেছিলে বলো না। তোমার কথাটা শুনে তারপর হাত-মুখ সাফ করব।
সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় আর সামলাতে না পেরে জহরের দিকে ‘তবে রে’ বলে তেড়ে গেলেন। জহরও বুঝলেন আর বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না। তাই দৌড়ে পালিয়ে গেলেন স্টেজ থেকে। কিন্তু যাওয়ার আগে দর্শকদের একটা ফিচেল হাসি উপহার দিয়ে গেলেন। প্রেক্ষাগৃহে হাসির রোল উঠল।
মঞ্চের আরও দুটো কাহিনী শোনালেন অভিনেতার ছোট মেয়ে কল্যাণী রায়। একটা সিরিয়াস আর একটা মজার। সরস চরিত্রে অভিনয় করলেও শিল্পীর অসম্মান যে সহ্য করতে পারতেন না জহর, তার প্রমাণ প্রথম ঘটনা। কল্যাণীর কথায়, ‘বাবার এক বন্ধু ছিলেন, নাম ধীমান। পদবিটা এখন মনে পড়ছে না। আমরা ধীমানকাকু বলে ডাকতাম। কী একটা নাটকে বাবার ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ধীমানকাকু। ওঁর পায়ে একটু বড় বড় লোম ছিল। দৃশ্যটাতে হাফপ্যান্ট পরে বাবার কোলে চেপে মঞ্চে ঢুকতেন ধীমানকাকু। সেদিনও একইভাবে ঢুকেছেন। দর্শকাসন থেকে কেউ তখনই বলে ওঠে, ‘এ বাবা এটা ভাল্লুকের বাচ্চা নাকি!’ সংলাপ থামিয়ে বাবা বলেছিলেন, ‘অ্যাই যা তোর বাবা এসে গিয়েছে।’ ধীমানকাকুর চোখে সেদিন জল এসে গিয়েছিল। এ রকমই আর একটা নাটকের ঘটনা। সম্ভবত নাটকটির নাম ছিল ‘নন্দা’। নাটকে একটা বিয়ের দৃশ্য ছিল। জহর রায় টোপর পরে শোলার বল দুটো নাড়তে নাড়তে দর্শকদের মধ্যে থেকে মঞ্চে প্রবেশ করতেন। এই নাটকটিই একবার দেখতে গিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী কমলাদেবী। বসেছেন একদম সামনের সারিতে। জহর টিকিট কাউন্টারে আগেই বলে রেখেছিলেন, কমলাদেবীর পাশের সিটের টিকিটটা যেন কাউকে না দেওয়া হয়। নাটক শুরু হয়, সেই দৃশ্যটাও আসে যথাসময়ে। জহর একইরকম ভাবে এসে সেদিন স্টেজে না উঠে স্ত্রীয়ের পাশে বসে পড়েন। দর্শকরা তো হকচকিয়ে যান। কমলাদেবী তো লজ্জা পেয়ে তাঁকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দেন। হলে তখন হইহই কাণ্ড।
জহর রায়ের এই শিশুসুলভ মনটাই আকৃষ্ট করেছিল সুচিত্রা সেনকে। জহর তাঁকে ডাকতেন ‘দিদিভাই’ বলে। আর সুচিত্রার কাছে তিনি ছিলেন ‘ভাইয়া’। তবে মাঝে মাঝে তাঁকে চার্লি বলেও ডাকতেন। প্রত্যেক বছর দিদিভাই সুচিত্রার কাছ থেকে ভাইফোঁটা নিতেন জহর। আর বিজয়া দশমীর দিন বাড়ির প্রত্যেকের ফোন করে সুচিত্রা সেনকে প্রণাম ও শুভেচ্ছা জানানো ছিল মাস্ট।
জহর রায় যখন প্রবল অসুস্থ, তখন সুচিত্রা অনেকবার কমলাদেবীকে ফোন করে তাঁকে দেখতে আসার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। কমলাদেবী রাজি হননি। কারণ, সুচিত্রা সেন বাড়িতে এলে তো ভিড় সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই শুনে সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘কী হয়েছে। আমি বোরখা পরে যাব।’ কমলাদেবীর সঙ্গে সুচিত্রার সম্পর্ক ছিল দারুণ। তিনি পাবনার মেয়ে। খাস বাঙাল। মাঝে মধ্যেই তাঁর শুঁটকি মাছ খাওয়ার সাধ হতো। কমলা ছিলেন চট্টগ্রামের মানুষ। সুচিত্রা একেক দিন গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। তাঁর জন্য সেই গাড়িতে করে রান্না করা শুঁটকি মাছ নিয়ে যেতেন কমলাদেবী।
সুচিত্রা সেন ও অন্যান্যদের সঙ্গে জহর রায়।
অলঙ্করণ: বিশ্বনাথ ঘোষ