কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর ঈর্ষার কারণে সম্মানহানি হবে। ব্যবসায়ীদের আশানুরূপ লাভ না হলেও মন্দ হবে না। দীর্ঘ ... বিশদ
কাজের প্রতি জহরের নিষ্ঠা কেমন ছিল, তার প্রমাণ দিতে কেবল একটা ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট। নিজের মেয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়েও তিনি সেদিন ফ্লোর ছেড়ে বেরননি। অথচ, পরিবার ছিল তাঁর প্রাণ। পুজোর সময় যত কাজই থাকুক, ছেলেমেয়েদের জন্য দুটো দিন তাঁর বরাদ্দ ছিল। একদিন জামাকাপড় কেনা, অন্যদিন জুতো কেনা। আর দু’দিনই পছন্দের দোকানে সকলে মিলে খাওয়াদাওয়া। শত ব্যস্ততাতেও এই রুটিনের অন্যথা হয়নি।
জহর রায়ের মেয়ে কল্যাণী বলছিলেন, ‘আমার পরে এক বোন হয়েছিল। সে চোখে দেখতে পেত না। আমার পিসিরা ওকে বিহারে নিয়ে যায় চোখের অপারেশন করার জন্য। কিন্তু সে বাঁচেনি। এটা অনেকেই জানেন না।’ ছোট মেয়ের অকাল প্রয়াণ জহরের জীবনে এতটাই গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে যে, দীর্ঘদিন তিনি স্বাভাবিক হতে পারেননি। অথচ, যখন মেয়ের মৃত্যুসংবাদ পান, তখন তিনি শট দিচ্ছিলেন। কিন্তু শট অসমাপ্ত না রেখে অভিনয় চালিয়ে যান।
পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘পিতাপুত্র’ ছবির সেটে ওই ঘটনা ঘটে। ওই ছবিতে স্বরূপ দত্ত, তনুজা, গীতা দে, অনুপকুমার, জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিলেন জহর রায়ও। ছবিতে ভীতু চাকরের চরিত্রে অভিনয় করে সকলকে খুব হাসিয়েছিলেন তিনি। সেদিনের ঘটনা সম্বন্ধে অরবিন্দবাবু কী জানিয়ে গিয়েছেন— ছবির নায়ক ডাক্তারি পড়ে। তার পড়ার ঘরের সেট। সেই জন্য তার ঘরে একটা কঙ্কাল রয়েছে। সেটাকে চাকর খুব ভয় পায়। সকালে জহর এল, পার্ট বুঝে অপূর্ব সব শট দিতে লাগল। একটু পরে কে যেন এসে ওকে বলল, ‘জহরদা, আপনার ফোন এসেছে।’
জহর অফিসে গিয়ে ফোনে কথা বলে এসে আবার শট দিতে লাগল। ঘণ্টাখানেক পর লাঞ্চ ব্রেক দিলাম। জহর বলল, ‘আমি কিছু খাব না। শরীরটা ভালো নেই। ’ আমরা ক্যান্টিন থেকে লাঞ্চ সেরে বেরচ্ছি, এমন সময় মেকআপ ম্যান শৈলেনদা খুব নিচু স্বরে আমাকে বলল, ‘জহরদা মেকআপ রুমে বসে কাঁদছে।’
এ কথা শুনে আমি তো প্রায় আকাশ থেকে পড়লাম। সেকি! দৌড়লাম মেকআপ রুমের দিকে। গিয়ে দেখি, টেবিলে মাথা গুঁজে জহর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে রে?’ জহর বলল, ‘একটু আগে টেলিফোনে খবর পেলাম, পাটনায় আমার ছোট মেয়েটা থাকত, হঠাৎ মারা গিয়েছে। আমাকে খুব ভালোবাসত রে।’ এই বলে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল। এই কথা শুনে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়— ‘তোর মেয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে তুই শ্যুটিং করে গেলি!’
‘কী করব ভাই, তোর ক্ষতি হবে,’ বলল জহর। ‘কিচ্ছু ক্ষতি হবে না,’ বললেন ছবির প্রযোজক প্রকাশ চন্দ্র নান। আরও বললেন, ‘ঢুলুদা (অরবিন্দবাবু ইন্ডাস্ট্রিতে এই নামেই পরিচিত ছিলেন), এখনই প্যাকআপ করে দিন।’ তখন জহরই আমার হাত ধরে বলেছিল, ‘না, না প্যাকআপ করিসনি। বরং, শ্যুটিং করে খানিকটা হলেও দুঃখ ভুলে থাকতে পারব।’ সত্যি সেদিন সন্ধে ৭টা পর্যন্ত জহর অক্লান্তভাবে এমন এমন সব শট দিয়েছে, পরে হাজার হাজার দর্শক সেই সব দৃশ্য দেখে হেসে মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে। তারা তো আর জানতে পারেনি, এই শটগুলোয় হাসির কানায় কানায় লুকিয়ে রয়েছে নীরব চোখের জল।
আসলে জহর রায় ও অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ফিল্মি কেরিয়ারও শুরু হয়েছিল প্রায় একই সময়ে। ১৯৪৫-’৪৬ সালে দুই বন্ধু রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে স্টুডিও থেকে স্টুডিওয় কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতেন। অরবিন্দবাবু একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি যখন পরিচালক হলাম, ওকে কাজ দিয়ে জিজ্ঞাসা করতাম, তোকে কত দিতে হবে? জহর বলত, তুই যা ভালো বুঝবি, তাই দিবি।’ এই বন্ধুত্ব চিরদিন অটুট ছিল। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের বহু ছবিতে পরবর্তীকালে কাজ করেছেন জহর রায়। তার মধ্যে ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিতে ফুটবল পাগল জমিদার গোবর্ধনের চরিত্রে তাঁর অভিনয় কে ভুলতে পারেন! আবার এই পরিচালকের ‘অগ্নীশ্বর’ ছবিতে অগ্নীশ্বর রূপী উত্তমকুমারকে যখন তিনি বলেন, ‘আপনি ডাক্তার না কসাই?’ তখন দর্শকের বুকের ভিতর মোচড় না দিয়ে পারে! আবার ‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে পুষ্পর (সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) ঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে অনঙ্গ দত্ত (উত্তমকুমার) যখন নটবরের (জহর রায়) হাত ধরে অন্য পতিতালয়ের দিকে পা বাড়িয়ে গান ধরেন, ‘না না না, আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না।’ তখন অনঙ্গের সঙ্গে সমান তালে সঙ্গত করেন ‘নটবর’ জহর। পান চিবতে চিবতে নিজের ধুতির কোঁচা ধরে জহরের সেই অভিনয় অনবদ্য। টলতে টলতেই অনঙ্গকে এনে বিছানায় বসিয়ে দেয় নটবর। উত্তমের লিপে মান্না দে গাইছেন, ‘আমার মনটা যদি চিরাগ সাজে, ভাগ্য মিরজাফর...’ জহরের সম্বল তখন শুধুই শরীরী অভিব্যক্তি।
এই ‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে ফুচকার মধ্যে মদ ভরে খাওয়ার দৃশ্যটা চিত্রনাট্যে ছিল না। সেটা জহরের ইম্প্রোভাইজেশনের ফসল। পরে এই ছবিটি যখন হিন্দিতে তৈরি করেছিলেন পরিচালক শক্তি সামন্ত, তখন সেই ‘অমর প্রেম’ ছবিতে উত্তম ও সাবিত্রী অভিনীত চরিত্র দু’টিতে অভিনয় করেছিলেন যথাক্রমে রাজেশ খান্না ও শর্মিলা ঠাকুর। শক্তি সামন্ত নটবরের চরিত্রে জহরকেই নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুম্বই লবির জন্য তা সম্ভব হয়নি। তাই সেই চরিত্রে অভিনয় করেন ওমপ্রকাশ। তবে, জহরের ইম্প্রোভাইজ করা দৃশ্যটি হিন্দি ছবিতেও রেখে দিয়েছিলেন পরিচালক।(ক্রমশ)
অলঙ্করণ: বিশ্বনাথ ঘোষ