কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর ঈর্ষার কারণে সম্মানহানি হবে। ব্যবসায়ীদের আশানুরূপ লাভ না হলেও মন্দ হবে না। দীর্ঘ ... বিশদ
আসলে সংসার ছিল জহর রায়ের ধ্যান-জ্ঞান। বেঙ্গল ফেমাস না হতে পারার জন্য তিনি বম্বে যাননি, এটা তাঁর বিনয়। ঘরকুনো হওয়ার কারণেই তিনি বম্বে গিয়ে বিখ্যাত হওয়ার হাতছানি অনায়াসে উপেক্ষা করতে পেরেছেন।
জহর রায়ের কমেডি অভিনয়ের প্রায় সর্বত্র বুদ্ধিমত্তার ছাপ স্পষ্ট। সোজা পথে হালকা চুটকি তৈরির দিকে তিনি হাঁটতেন না। তাই জহর সৃষ্ট দৃশ্য যথার্থভাবে আহরণ করতে গেলে বা তাঁর কাজের থেকে রসাস্বাদন করতে গেলে নিজেদের চিন্তাধারা আর রসবোধের ব্যাপ্তি ঘটানো প্রয়োজন। প্রয়োজন নিজের জানার পরিধিকে প্রসারিত করা। প্রতি বছর পুজোর সময় তিনি যে কৌতুক নকশা পরিবেশন করতেন ‘মেগাফোন রেকর্ডে’, সেখানে কমেডি নির্মাণে গভীর বুদ্ধিমত্তা ও শিক্ষার ছাপ থাকত সুস্পষ্ট। নিজস্ব স্টাইলে তিনি শ্রোতাদের সঙ্গে একটা টিউনিং করে নিতেন। শ্রোতাও প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব কষতে কষতে মনোযোগী হয়ে উঠত।
জহর এই সব রেকর্ডে ধরা দিতেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। যেমন— ‘ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান চ্যারিটি খেলা’ বা ‘পঞ্চম দিনের টেস্ট ক্রিকেটের ধারা বিবরণী’ সেখানে জহরের দ্রুত কথনের সঙ্গে বিষয়ের সঙ্গতি রয়েছে। ফলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি শ্রোতারা আমোদটাও চেটেপুটে উপভোগ করেন।
ফুটবল খেলা নিয়ে একটি কৌতুক নকশায় তিনি বলছেন, ‘বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া মাঠে খেলা চলছে। রেফারি পিঠে ত্রিশূল বেঁধে রেখেছেন। বৃষ্টিস্নাত মাঠে বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচতে রেফারি এ হেন উপায় অবলম্বন করেছেন।’ উঁচু বাড়িতে মাথার উপর ত্রিশূলের মতো দেখতে বাজ-প্রতিষেধক লাগানো থাকত, সেই জিনিসটাই বলার সময় জহর কমিক স্কেচে নিয়ে আসেন। আর একটি নকশায় তিনি বলছেন, ‘টেস্ট ম্যাচ খেলায় টিকিক সংগ্রহের জন্য লম্বা লাইন পড়েছে। এদিকে প্রচণ্ড ভিড়ের চাপে চলেছে প্রবল ঠেলাঠেলি। লাইনে দাঁড়ানো একজন আর একজনকে বলছে, ভিড়ের চাপে আমার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে, আর আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন কেন? লোকটি তখন অসহায়ের মতো উত্তর দিচ্ছে, হাসছি না দাদা। চর্বিতে চর্বিতে ফ্রিকশন হয়ে একটা অটোমেটিক হাসি হচ্ছে বুঝলেন। কিছু মনে করবেন না।’ কমেডি তৈরিতে এই সূক্ষ্মতা একমাত্র জহর রায়ের পক্ষেই সম্ভব। আবার ‘ঘেরাও’ রেকর্ডটিতে রয়েছে উত্তেজক মেজাজ— এভাবেই এই অভিনেতার বাচিক অভিনয়ের সিগনেচার স্টাইল পৌঁছে গিয়েছে শ্রোতাদের কাছে।
একটি পত্রিকার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে জহর রায়ের কথা শুনে বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায় যে প্রাণখোলা হাসি হেসেছিলেন, সেটি ছিল এরকমই একটি কমিক স্কেচ। ‘ন্যাপাসুর বধ’। এই ন্যাপাসুর বধ শুনেই সত্যজিতের হাসি ধরা পড়েছিল এক ফোটোগ্রাফারের ক্যামেরায়। সেই ফোটো অমিয় নিবাসের দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছিলেন জহর।
এই ন্যাপাসুর বধ সৃষ্টির পিছনেও রয়েছে একটা চমৎকার গল্প। এই কমিক স্কেচের আইডিয়া তাঁর মাথায় এসেছিল এক বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। বিশ্বকর্মা পুজো এমনিতে বিভিন্ন কলকারখানাতেই হয় সাধারণত। সেই রকমই এক কারখানার কর্মীদের বিশ্বকর্মা ঠাকুর নিয়ে প্রলয় নাচন নজরে পড়ে জহরের। এই আইডিয়া নিয়েই পরে ‘ন্যাপাসুর বধ’ তৈরি করেন।
বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। বিশ্বকর্মা পুজোয় পাওয়া আইডিয়া নিয়ে বারোয়ারি পুজোর আদলে দুর্গাপ্রতিমাকে কেন্দ্র করে একটা স্কেচ করলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমন কাজ। বিজয়া দশমীতে ঠাকুর বিসর্জনের পরের দিন সকালবেলা স্কেচের শুরু। নেপালচন্দ্র ওরফে ন্যাপা পাড়ার বেকার ছেলে। ষষ্ঠীর দিন বারোয়ারি পুজোর প্রতিমা আনতে গিয়ে অসুরটি যায় ভেঙে। তখন আর নতুন অসুর তৈরি করে যে নিয়ে আসবে তার উপায় নেই। সময়ও নেই। পাড়ার সকলে মিলে ঠিক করে এই চারদিন ন্যাপাই মাদুর্গার অসুর সেজে প্রক্সি দেবে। ন্যাপার গায়ের রং কালো। মুখের চেহারাও অসুরের আদলের সঙ্গে মিলে যায়। যাইহোক পুজোর চারটে দিন নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে কাটল। বিপত্তি ঘটল দশমীর দিন। লরিতে যখন ঠাকুর বিসর্জনের জন্য তোলা হচ্ছে, তখন আর ন্যাপা অসুর সেজে গঙ্গা পর্যন্ত যেতে রাজি নয়। কিন্তু সকলে ধমকে ন্যাপাকে গাড়িতে তুলল। এরপর শুরু হল উদ্দাম ধুনুচি নাচ। সিদ্ধি, গাঁজা খেয়ে সকলেই নেশাগ্রস্ত। তাদের ধুনুচি থেকে আগুনের ফুলকি ছিটকে ছিটকে ন্যাপার শরীরের নানা জায়গায় ফোস্কা পড়তে লাগল। ন্যাপার আর্তচিৎকার উদ্দাম নৃত্যরতদের দল কর্ণপাত করল না। এখানেই শেষ নয়, মা চলে যাবে কৈলাসে আর অসুর ফিরে আসবে কলকাতায়! তা কী করে হয়! প্রতিমার সঙ্গে ন্যাপাকেও গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলা হল। তবে, সে সাঁতার জানত। সে যতবারই সাঁতরে পাড়ের কাছে আসে, ততবারই সবাই তাকে ইট ছুঁড়ে মারে। অবশেষে ওদের চোখ এড়িয়ে ন্যাপা কোনও রকমে বাগবাজার ঘাটে গিয়ে পাড়ে ওঠে। সেখান থেকে সোজা হাসপাতাল। ওখান থেকে আপাদমস্তক ব্যান্ডেজে মুড়ে হয় তার পাড়ায় প্রত্যাবর্তন।
সংক্ষেপে এই হল ‘ন্যাপাসুর বধ’। দুর্গাপুজোর সময় জহর এই স্কেচটা রেকর্ড করেন। দারুণ বিক্রিও হয়। জহর ঘরানায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই সময় আরও একদল তরুণ কৌতুকশিল্পী কমেডি করতে উৎসাহিত হয়েছিলেন। তাঁরা ছোটখাট ফাংশনে জহরের মতো করে ‘ন্যাপাসুর বধ’ করে দেখাতেন। হাততালিও মিলত প্রচুর। তবে, জহর যেভাবে ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠস্বরে অপূর্ব ভঙ্গিমায় ওই স্কেচটির প্রস্তাবনার অংশ অভিনয় করতেন, তার তুলনা ছিল না। কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে কখনও তিনি বৃদ্ধ, আবার কখনও বৃদ্ধা। কখনও ধরিবাজ তো কখনও রকবাজ। কখনও প্রেমিক কখনওবা প্রেমিকা। সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, সেটাও নিজের মুখে বাজাতেন জহর। তার সঙ্গে নাচ ও গান। চ্যাংড়া ছোকরাদের উদ্যোগে আয়োজিত বারোয়ারি পুজোর প্রস্তুতি পর্ব শ্রোতাদের চোখের সামনে ভেসে উঠত। সেই সঙ্গে এই সৃষ্টির মধ্যে পাড়ার ভদ্রলোক, অবহেলিত বেকার যুবক সম্প্রদায়ের প্রতি স্রষ্টার একটা প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি জড়িয়ে থাকত। সাধে কী আর এই স্কেচ সত্যজিৎ রায়কেও প্রভাবিত করেছিল।(ক্রমশ)
‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ ছবির একটি দৃশ্যে জহর রায়।
অলঙ্করণ: বিশ্বনাথ ঘোষ