ব্যবসায় বাড়তি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত সাফল্য নাও দিতে পারে। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি। শ্বাসকষ্ট ও বক্ষপীড়ায় শারীরিক ক্লেশ। ... বিশদ
কথায় আছে না, কার কপালে কোথাকার অন্ন লেখা আছে, কেউ বলতে পারে না। বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুরের কাছে ছোট একটি গ্রাম রুদড়ায় যার জীবনের তিনকাল কেটেছে, সেই অনন্তরাম না হলে হুগলির চুঁচড়োর—অভয়ানন্দবাবুর বাড়ি চাকরিতে বহাল হয় কী করে! কী করে চাকরিটা হল সে রীতিমতো এক ইতিহাস। বর্তমানের সত্যটা হল, অনন্ত বিপত্নীক অভয়ানন্দবাবুর বাড়ির রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘরদোর পরিষ্কার, বাজার-হাট—এককথায় জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই করে। তবে, শর্ত হল, বছরে একটিবার দিন সাতেকের জন্য ছুটি দিতে হবে সেই কটা দিন ও দেশের বাড়িতে গিয়ে থাকবে। কিন্তু সমস্যা হল অভয়ানন্দবাবুকে নিয়ে—যিনি কিনা এক গ্লাস জলও নিজে গড়িয়ে খেতে পারেন না! ওই সাত দিন তাঁর কী হবে? অনেক ভাবনা-চিন্তার পর একটা সমাধান সূত্র পাওয়া গেল। অভয়বাবুর মেয়েজামাই থাকে বাঁকুড়া শহরে। ওই সাত দিন মেয়ের বাড়িতে কাটাবেন তিনি। সাত দিন পরে অনন্তকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।
তা এবার অনন্ত গোঁ ধরেছে, বাবুদের সবাইকে তার গাঁয়ে যেতে হবে। গাঁয়ে গিয়ে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে। আসলে শহরে বাবুদের বাড়িতে তার দাম যে কতখানি গাঁয়ের লোককে তাই সে দেখাতে চায়। কাজের লোকের গুরুতর সমস্যা এখন ঘরে ঘরে। অগত্যা তাই অনন্তরামের কথাই রইল। অভয়ানন্দ সপরিবারে এলেন অনন্তরামের ডেরায়।
দুই
রুদড়া গ্রামটি ছোট। রাস্তা-ঘাটে এখনও উন্নয়নের ছোঁয়া তেমন লাগেনি। সংকীর্ণ রাস্তাগুলি জলকাদায় মাখামাখি। কী ভাগ্যি মূল রাস্তাটা কিছুদিন আগে বাঁধানো হয়েছে। নইলে গাড়িতে যাওয়াই মুশকিল হতো। বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই বেরিয়ে এল অনন্ত—যাকে বলে একেবারে বিগলিত করুণা! অভয়ানন্দের দুটি হাত ধরে বলল—‘আসুন বাবু আসুন।’ তারপর উঠোনে পাতা খাটিয়া দেখিয়ে বলল—‘বসুন আজ্ঞা দয়া করে।’ মেয়ে-জামাইকে এবার আপ্যায়নের পালা। বাড়িতে বউ-ঝি, বাচ্চাকাচ্চা যত ছিল—তারা, প্রতিবেশীরা, অনন্তর ভাই, দাদা, পিসিমা, মাসিমা, ওদের পুত্রকন্যারা—সবাই ততক্ষণে গুটি গুটি এসে সার বেঁধে দাঁড়িয়েছে উঠোনে। কোনও মন্ত্রী, নেতা বা অভিনেতাকে দেখলে জনগণের যে অবস্থা হয়, এদেরও যেন সেই অবস্থা অভয়ানন্দের মনে হতে লাগল—এবার বুঝি খাতা বাড়িয়ে ওরা অটোগ্রাফ চেয়ে বসবে!
ছেলে বিশুর দেখা মিলতেই অনন্ত চোখের ইশারা করে—‘যা কেনে, ওগুলো নিয়ে আয়।’ বিশু যেন তৈরিই ছিল। গোটা দুই-তিন ওরই বয়সি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে তখনি বের হয়ে আসে। কারও হাতে মিষ্টির প্লেট, কারও হাতে ঠান্ডা পানীয়ের বোতল, গ্লাস। ওরা অতিথিদের সামনে এসে দাঁড়ায়। আর অনন্ত হাত কচলাতে কচলাতে বলে, ‘নেন সকলে এট্টু মিষ্টিজল সেবা করি নেন। কখন বের হইচেন বাড়ি থিকা!’
—এসব কী কাণ্ড করেছ অনন্ত! অভয়ানন্দ প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন।
—আর সময় নষ্ট কোরো না অনন্তদা। ব্যাগ গুছিয়ে চটপট রেডি হয়ে নাও। জামাই বাবাজীবন ফতোয়া জারি করে।
—এ আর এমনকী বাবু! আমাদের প্লেন (প্ল্যান) ছিল, আপুনিদের দুটো মাংস ভাত সেবা করাই। তা হলনি যখুন...
অনন্তর কথার ধরনে হাসি পেয়ে যায় সবার। দিদিমণি অর্থাৎ অভয়ানন্দের মেয়ে কোনওরকমে সামাল দেয়—হবে হবে। আমরা তো আসব আবার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অনন্তর শিশুকন্যার গাল টিপে দেয় ও। পঞ্চাশের ওপর বয়স অনন্তর। অথচ তার শিশুকন্যার বয়স চার কি বড় জোর সাড়ে চার। জামাই বাবাজীবনের কথায়— ‘ব্যাপারটা রীতিমতো থ্রিলিং।’
তিন
ফেরার সময় সকলের মেজাজ বেশ হালকা। অভয়ানন্দবাবুর মনের কোণে একটা আশঙ্কার মেঘ দানা বেঁধে ছিল অনন্তরাম হয়তো আর ফিরবে না! এখন সেই অনন্তকে বগলদাবা করতে পেরে তাঁর মন এখন ফুরফুরে। সেই ফুরফুরে ভাব সকলের মধ্যে সঞ্চারিত। মেয়ে দীপান্বিতা বলে উঠল—মুকুটমণিপুরের ড্যামে অনেকদিন আসা হয়নি। একটু গাড়ি দাঁড় করাও। আমরা ঘুরব এটা-সেটা খাব।
জামাই দীপ্তিমান গাড়ি দাঁড় করিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় খানিকটা। তারপর শ্বশুরকে আড়াল করে সিগারেটে টান দেয়। একটা হিসেব কিছুতেই মেলানো যায় না। চুঁচড়োর বাড়িতে যে অনন্তরামকে প্রতি মুহূর্তে সাংঘাতিক বলে মনে হয়, এখানে তারই এমন ভিন্নমূর্তি হয় কী করে! সঞ্জীবচন্দ্রের সেই অমোঘবাণী—‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’—এ কি তারই ভিন্নতর প্রতিফলন?
চার
অবশেষে অভয়ানন্দ ফিরে এলেন চুঁচড়োয় নিজের বাড়িতে। সঙ্গে যথারীতি অনন্তরাম। সকালে বারান্দায় অভয়বাবুর কাগজ হাতে আবার একা একা বসে থাকা, আবার সেই হাঁক পাড়া—‘কই অনন্ত চা হল?’ ‘এজ্ঞে যাই বাবু’ বলে অনন্তর চায়ের কাপ হাতে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসা। সবই ঠিকঠাক আগের মতো! এরই মধ্যে এক সন্ধ্যায় টিভি দেখার সময় বাবুর পায়ের কাছে বসে অনন্ত হাত কচলাতে থাকে—বাবু একটা কথা ছেল। যদি ‘অ্যাডমিশান’ দেন তো বলি।
অভয়ানন্দ তো হেসে খুন—‘অ্যাডমিশন’ নয় হে, বলো পারমিশন।
—ওই হল, আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। আমার কি আংজিরি’র কিছু ঠিক আছে?
—ওটা আংজিরি নয়, ইংরেজি তা বলো কী বলবে?
—ব্যাপার হল কী!—আবার ঢোক গেলে অনন্তরাম।—ওই যে মোড়ের মাথায় খাণ্ডেলওলা না কে আছে যা দিগের বড় মিষ্টির দোকান গো—তেনারা একটা আইসকিরিমের দোকান দিবেক, লোক চাই। বলি কি আমার ছা টাকে দেশ থিক্যা আনে দুব। নেকাপড়া করলনি, গাঁয়ে বসে যত বদ নেশা-জুয়া খেলা! তা এখানকে এলে মনটা যদি এট্টুখানি ফেরেক। তা বাবু, আপনে যদি ‘অ্যাডমিশান’ দেন!
অভয়ানন্দ হাঁ হাঁ করে আবার ওর ইংরেজির ভুল সংশোধন করতে যান। পরক্ষণেই মনে হয়—কী হবে ওসব কথা বলে! ওর ভুল কি আর জীবনে সংশোধন হবে! কিন্তু প্রশ্ন হল অনন্তরাম ওর ছেলেকে দেশ গাঁ থেকে আনবে, এতে তাঁর ‘পারমিশন’ দেওয়ার কী আছে?
অনন্তরামের অদ্ভুত যুক্তি—চুঁচড়ো তো আপুনকারই দ্যাশ গো, আপুনি ছি চরণে ঠাঁই না দেলে কি আসতি পারতাম কুনদিন এখান কে? তা ছা টাকে যে আনবু—আপুনি এট্টু বলি না দেলে কি হয়!
অনন্তরামের দিকে ভালো করে তাকান অভয়ানন্দ। কয়েকদিন আগের কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। কোষ্ঠকাঠিন্যে খুব ভুগছিলেন। ডাক্তারকে বলতে সে জোলাপ জাতীয় কী একটা ওষুধ দিয়েছিল। তা খেয়েই একেবারে চিৎপটাং! কিছুতেই সামলাতে পারছিলেন না। বিছানা, কাপড়চোপড় নোংরা করে ফেলছিলেন যখন তখন!
তখন অনন্তরামের সে কী তেজ!—‘আমার কি এসব পস্কার করার কথা? পারবনি, লোক দেখে নাও তোমরা।’ এসব শুনে রীতিমতো কান্না পেয়ে যেত অভয়ানন্দের। মনে হতো কেন বেঁচে আছেন? এত হেনস্তার পর বেঁচে থাকার কোনও মানে হয়? একরকম হাতেপায়ে ধরেই সেইবার অনন্তকে সামলাতে হয়েছিল।
অনেক কিছু কবুল করতে হয়েছিল। মেঝেতে শুতে কষ্ট হয় অনন্তর তাই চৌকির ব্যবস্থা করতে হবে। পাশের পানের দোকানে শোনা গেছে এফএম রেডিওয় ভালো ভালো গান দেয়। অতএব ওকেও একটি এফএম রেডিও কিনে দিতে হবে ইত্যাদি।
অনন্তরামের আর এক কীর্তির কথা মনে পড়ে যায় অভয়ানন্দের। অনন্তরাম তাঁর কাছে আছে, কম দিন তো হল না! মেয়ে দীপান্বিতার সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে তখন। অনেক ভাবনা-চিন্তা উদ্বেগ-উত্তেজনার শেষে ভাবছেন, দুদিন একটু হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নেবেন!
হঠাৎ এক সকালে অনন্তরাম এক ভদ্রলোককে সঙ্গে করে বাড়িতে এনে হাজির। অভয়বাবু তাঁকে চেনেন না, কোনওদিন দেখেছেন বলেও মনে পড়ে না। ওর সামনেই অনন্তকে জিজ্ঞেস করেন ভদ্রলোক কে? উত্তরে কিছুই বলে না অনন্ত। শুধু হাত কচলাতে থাকে, আর বলে—‘আপুনিই শুনুন না, বাবু কি বলতেছেন!’
অগত্যা শুনতে হয় অভয়ানন্দকে। কী ব্যাপার? না, তিনি তো এখন বাড়িতে একাই থাকেন। একমাত্র মেয়ে ছিল, তার তো বিয়ে থা হয়ে গেল। ছেলেও অনেক দূরে থাকে। কাজেই ভদ্রলোকের প্রস্তাব—অতবড় বাড়ি নিয়ে একা একা না থেকে তা বিক্রি করে দিন। উনিই বাড়িটি কিনে নেবেন। তারপর বাড়ি ভেঙে ওই জমিতে উনি ফ্ল্যাট তৈরি করবেন। অভয়ানন্দ ফ্ল্যাট, নগদ টাকা—সবই পাবেন।
অভয়ানন্দর বুঝতে তখন আর বাকি থাকে না যে, ভদ্রলোক একজন প্রোমোটার। ঝোপ বুঝে কোপ মারতে এসেছেন। আর এর মূলে আছে তারই ‘বিশ্বস্ত সঙ্গী’ অনন্তরাম! ভদ্রলোক আগেভাগে ওকেই হাত করে নিয়েছেন। বাড়ির সব খবরাখবর ওর মারফত-ই জেনেছেন!
ভদ্রতা বজায় রেখে অভয়ানন্দ আগে ভদ্রলোককে কোনওরকমে বিদায় করেছেন। তারপর পড়েছেন অনন্তরামকে নিয়ে—‘তোমাকে এসব কে করতে বলেছে অনন্ত? আমি কি তোমাকে কোনও দিন কিছু বলেছি?’ কী উত্তর দেবে অনন্ত? শুধু হাত কচলাতে থাকে, আর দাঁত বের করে হাসে। ধরা পড়ে গিয়ে কত যেন লজ্জা!
সেই অনন্তরাম আর এই নিভৃত সন্ধ্যায় হাত জোড় করে বসে থাকা অনন্তরামকে কিছুতেই যেন মেলাতে পারেন না অভয়ানন্দ! দেশের বাড়ি থেকে ঘুরে আসার পর সেই অনন্তরামের আজ এ কী পরিবর্তন! অভয়ানন্দের মনে হয়, সেই পুরনো অনন্ত নয়, এ এক নতুন মানুষ বসে আছে তাঁর কাছে।—নিভৃত সন্ধ্যায় যে নিজেকে উজাড় করে দিতে চায়। বউ, ছেলে মেয়ে, নিজের দেশ গাঁ ছেড়ে এই বিদেশে-বিভুঁয়ে ওর একেবারেই মন টেকে না। কিন্তু কী করবে? পেটের জন্যে দুটো পয়সার জন্যে সবই করতে হয়। সবাইকে ছেড়ে একা থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে যেন মাথায় আগুন ধরে যায়। আর তখনই সব উল্টোপাল্টা কাণ্ড করে বসে! নইলে মানুষটা সে তো খারাপ নয়!
একসময় হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে অভয়ানন্দের দুই পা চেপে ধরে অনন্ত—‘আমাকে সাজা দেন গো বাবুমশাই, সাজা দেন। আমি পাপ কম্ম করেছি, আপুনকার কাছে অনেক পাপ কম্ম করেছি।’
—আরে করছ কী তুমি অনন্ত! ওঠো ওঠো।-দু’হাত ধরে ওকে তুলে ধরেন অভয়ানন্দ। এতদিন শুধু নিজের কথাই ভেবেছেন। পান থেকে চুন খসলে চেঁচামেচি করে হইহই করে উঠেছেন। কিন্তু ওর কথা তো কোনওদিন ভাবেননি! এক নতুন মানুষের সন্ধান পেয়ে মনে মনে অবাক হয়ে যান অভয়বাবু। চোখের দুই কোণ কী জানি কেন চিকচিক করতে থাকে তাঁর।