কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
পর্ব ৯
ঈশ্বরচন্দ্রের পড়াশোনা আর সংসারযাপন বেশ পাকা পড়ুয়া এবং পাকা গিন্নির মতো চলতে লাগল। প্রথমে ভাই দীনবন্ধুকে তার পড়াশোনার জন্য কলকাতায় নিয়ে এলেন বাবা ঠাকুরদাস। তিনিও দাদার সঙ্গে পড়তে যান। বিদ্যাসাগরের পড়ার ভার বাড়ে আর সংসারের চাপও বাড়ে। তারপরে বাবার শাসন-পীড়নও। তবুও সিংহবাড়ির মানুষদের ভয়ে মারধর একটু কমেছে। ব্যাকরণ ক্লাসে পড়ার সময় মাস ছয়েক ইংরেজি শেখার ক্লাস করেছিলেন। তাতে ইংরেজির ভিত শক্ত করার মতো সময় পাননি। পরে অবশ্য নিজের চেষ্টায় ইংরেজিনবিশ হয়ে উঠেছিলেন।
ভাই দীনবন্ধু পড়াশোনায় তুখোড়। বুদ্ধিতে বুঝি দাদাকেও পার হয়ে যান। পরে তিনি ন্যায়রত্ন উপাধি পান। পাশ করে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করার পর স্কুলের ডেপুটি ইনস্পেক্টরের চাকরিও পান। একটা কবিতার বইও লিখেছিলেন। এর পরে পরে সংসার বাড়তে থাকে। ভাইরা একে একে কলকাতায় পড়তে আসেন। আগে দু’বেলায় রাঁধতে হতো ঈশ্বরকে। পড়ার চাপ বাড়াতে শুধু সকালের দিকের রান্নাবান্না করতেন। অফিস থেকে ফিরে রাত ন’টা নাগাদ রাতের রান্নার পাট নিয়েছিলেন ঠাকুরদাস। ছেলেদের মানুষ করার লক্ষ্যে এই বয়স্ক লোকটার চেষ্টার একটুও কমতি ছিল না।
পড়তে পড়তে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ঈশ্বরের। স্ত্রী দিনময়ী অবিশ্যি বীরসিংহাতেই থাকতেন। কলকাতায় আসেন বাদুড়বাগানে ঈশ্বরচন্দ্রের নিজের বাড়ি তৈরি হবার পর। সেটাই ভালো হয়েছিল, নইলে স্ত্রীর সামনে বাবার হাতে মার খেলে কোথায় যে সম্মান থাকত! ভারী চমৎকার হাতের লেখাটি রপ্ত করেছিলেন ঈশ্বর। বই কেনার পয়সা নেই, ভারী ভারী সংস্কৃত পুঁথি নিজের হাতে নকল করে নিতেন ঠিক আসল পুঁথির মতো। কলেজে যাওয়ার পথে বই খুলে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পড়তেন, ফেরার সময়ও তাই। একবার ল-কমিটির পরীক্ষা দেবেন ঠিক করলেন। দিনরাত ভুলে পড়া। বাবা রাতের খাবার খাইয়ে দিতেন রাত দশটার মধ্যে। তারপর দু’ঘণ্টা জেগে থাকতেন। দশটা থেকে বারোটা দু’ঘণ্টা মাত্র ঘুমের জন্য বরাদ্দ ঈশ্বরের। তারপরে বাবা শুতে যাবার আগে ঈশ্বরকে ঘুম থেকে তুলে দিতেন। রাত কাবার হয়ে যেত ঈশ্বরের পড়া চলত। ভোর হতেই সংসার পালন। ভারী অসুখে পড়লেন। রক্তাতিসারে তো একবার প্রাণ যায় যায়। কলকাতার ডাক্তাররা পারলেন না। গ্রামে গেলেন, সেখানে কোবরেজ মশায় পাতলা দইয়ের সঙ্গে গুল সিদ্ধ মিশিয়ে এমন ওষুধ বানিয়ে দিলেন যে রোগ পালিয়ে বাঁচে। এমন ওষুধ আমরা কখনও শুনিনি। ল’ কমিটির পরীক্ষার সময় বাবার কাছে অনুমতিতে ছ’মাস রান্না করা থেকে ছুটি পেয়েছিলেন।
ব্যাকরণ শ্রেণী থেকে সাহিত্য শ্রেণীতে উঠলেন। এখানে তিনি জলপানি পেলেন। বাবার মাইনে পাঁচ, ঈশ্বর বৃত্তি পান আট টাকা। শেষে বৃত্তির পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। টাকার সিংহভাগ বাবাকে পাঠিয়ে দেন। বাবার ইচ্ছে সেই টাকাতে গ্রামে বাড়ি তৈরি করে টোল খুলে দেবেন— ঈশ্বর পড়া শেষ করে টোলে এসে ছাত্রদের পড়াবে— ঠাকুরদাসের বড্ড শখ। ছোট ঈশ্বরের চেয়ে বড় ঈশ্বর আড়ালে ভাবছেন— এই ছেলেটা বড় হয়ে মাটির পৃথিবীতে আরও বড় একটা ঈশ্বর হয়ে যাবে!
ঈশ্বর রান্না করেন খাটা-পায়খানা সংলগ্ন একটা রান্নাঘরে। ডাবা থেকে মলের পোকাগুলো কিলবিলিয়ে নেমে এসে খাবার জিনিসের দিকে এগয়— ঘটি ভর্তি জল নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র সেগুলোকে ঢেউয়ে সরিয়ে দেন। একবার তো বে-খেয়াল হয়ে তরকারি রাঁধতে গিয়ে একটা গোটা আরশোলা রেঁধে বসলেন। পাছে অন্যের পাতে পড়লে কী একটা অনর্থ বেঁধে যায়— তাই নিজেই আরশোলাটি তরকারির সঙ্গে ভাতে মেখে নিয়ে গপাৎ। কে জানে আরশোলা খেলে বিদ্যের জাহাজ হওয়া যায় কি না! কিন্তু একটা ব্যাপার মানতেই হবে, পড়াশোনায় তিনি এতখানাই ভালো ছিলেন যে, মাস্টারমশায়দের সঙ্গেও কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে তর্ক করতেন— তাও আবার সংস্কৃত ভাষায়। জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন মশায় শুনে হতভম্ব হয়ে যেতেন। বলতেন, ‘আমরা এই বালককে কলেজের মহামূল্য অলঙ্কার-স্বরূপ জ্ঞান’ করে থাকি। সব ক্লাসের সব মাস্টারমশায়দের চোখের মণি ঈশ্বর— ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সাকিন বীরসিংহা। এদিকে, বাচস্পতি মাস্টারমশায় বিপত্নীক হয়েছেন এবং কিছুদিনের মধ্যে এক পরমাসুন্দরী বালিকাকে বিয়ে করে এনেছেন। একদিন ঈশ্বরকে ডেকে বললেন, একদিন আমার বাড়িতে গেলি না তোর নতুন মাকে দেখতে। ঈশ্বর গেলেন এবং দু’চোখ ফেটে জল এল তাঁর। একটা বয়স্ক মানুষ এই বালিকাকে বিয়ে করেছেন! সেই বুঝি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল।
বেশ ছিলেন নানা অসুবিধা সত্ত্বেও জগদ্দুর্লভ সিংহমশায়ের বাড়িতে। কিন্তু সিংহমশায়ের কোনও অন্যায় কাজের জন্য মাস ছয়েকের জন্য ওই বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়। নতুন বাড়িতে ঈশ্বরের ভালো লাগে না। কিন্তু উপায় নেই। নতুন বাড়িতে এসে কিন্তু একটি সংস্কৃত কবিতা লিখে সর্বোৎকৃষ্ট বিবেচিত হওয়ায় একশো টাকার পুরস্কার পেলেন। এর অল্প দিন পরে তাঁর ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর শিক্ষক হরিপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন অসুস্থ হয়ে পড়লে ঈশ্বরচন্দ্রকেই কলেজের অধ্যক্ষ মশায় উপযুক্ত বিবেচনা করে দু’মাসের জন্য পড়াতে দিলেন। তার বিনিময়ে চল্লিশ টাকা পেলেন আর সেই টাকা বাবার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, তুমি খুশিমতো তীর্থভ্রমণ করে এসো। হলই বা দু’মাসের, কিন্তু শিক্ষক বিদ্যাসাগরের জীবনের সূত্রপাত ঘটল। ক’জনের এই সুযোগ আসে আমরা জানি না। এরপরেই একের পর এক সুযোগ, সংঘাত এবং সেই এঁড়ে বাছুরটার একরোখা জীবন— সব মিলিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রকে আমরা বিদ্যাসাগর হয়ে উঠতে দেখব।
(ক্রমশ)