গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
দাঁড়িয়ে পড়ল। এদিকে আলো কম। সন্ধে হয়েছে। হালকা অন্ধকারের ভেতর থেকে চারটে ছেলে তার সামনে এসে দাঁড়াল। ওদের মুখগুলি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে। একজন এগিয়ে এল, ‘দীপান্বিতা আমাদের পাঠাল। ওর কাছ থেকে সতেরো হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন। ফেরত দিন। দীপা চেয়ে পাঠিয়েছে।’
সমরজিৎ স্তম্ভিত। দীপান্বিতা তাকে সতেরো হাজার টাকা ধার দিয়েছে কথাটা সত্যি। সে নিতে চায়নি। ছাত্রীর কাছ থেকে কেউ টাকা ধার নেয়! আবার সেই ছাত্রীর বয়স যখন উনিশ বা কুড়ি। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিতে হয়েছিল।
সমরজিৎ রুখে দাঁড়াল, ‘টাকাটা যার কাছ থেকে নিয়েছিলাম তাকেই দেব।’ চারদিকে কুয়াশা। ছেলেগুলিকে মনে হচ্ছে বৃষ্টিভেজা কাচের দেওয়ালের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সমরজিৎ পা ফেলে এগিয়ে যেতে চাইল। ওরা দিল না। এবার অন্য একটি ছেলে বলল, ‘দীপা বলেছে আমাদের দিতে।’ সমরজিৎ বলল, ‘কাল রবিবার সন্ধেবেলায় দীপান্বিতাদের বাড়িতে থাকব। ওখানে আসুন। তখন কথা হবে।’
ওরা কী ভাবল কে জানে। আর কিছু না বলে কুয়াশার ভেতর হারিয়ে গেল। ডিসেম্বর শেষ হতে চলল। খুব ঠান্ডা। অথচ সমরজিৎ ঘামছে। এখনও ছ’মিনিট হাঁটতে হবে। হাকিমপাড়ায় সমরজিৎদের বাড়ি।
বাড়ির নাম শিউলিকুঞ্জ। বাবার দেওয়া নাম। সমরজিতের ঠাকুরমার নাম ছিল শিউলিরানি। ঠাকুরদা কুঞ্জবিহারী।
বেশ কিছুদিন শিউলিকুঞ্জ অন্ধকার ছিল। সমরজিৎ এখনও ঘামছে। কী সরল নিষ্পাপ মুখ দীপান্বিতার। শান্ত। পড়াশোনায় ভালো। তবে দোষের মধ্যে মেয়েটি সব সময় সেজেগুজে থাকে। দেখেশুনে মনে হয় দীপান্বিতারা বেশ অবস্থাপন্ন।
এখন শিউলিকুঞ্জে অন্ধকার নেই। বাড়িতে ঢুকে দেখবে তার বাবা জগদীশ্বর টেবিলে স্তূপাকৃত বই নিয়ে নব অভিধান রচনায় ব্যস্ত। মা রান্নাঘরে। বাবা অনেক কষ্টে এই একতলা বাড়িটা নির্মাণ করাতে পেরেছিলেন। প্রথমে তিনি চকদ্বীপের স্কুলে বাংলা পড়াতেন। পরে যাদবপুর অ্যাকাডেমিতে হেড মাস্টার হয়ে রিটায়ার করেন। বাড়ি তৈরি, দুই মেয়ের বিয়ে ইত্যাদিতে তাঁর হাত খালি। পুরনো স্কেলে পেনশন পান। সমরজিতের মাইনেও সামান্য। তারই মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাত। প্রথমে পনেরো দিন আগে। তারপর আজ। কয়েক মিনিট আগে। অচেনা ছেলেটি বলল, ‘টাকাগুলো দিন। দীপা চেয়েছে।’ টাকা একশো দুশো নয়। সতেরো হাজার।
সমরজিৎ দূর থেকে দেখতে পেল শিউলিকুঞ্জে আলো জ্বলছে। অন্ধকার থাকলেই ভালো ছিল। সমরজিৎ বাড়িতে ঢুকল। তারপর নিজের ঘরে ঢুকে ইজি চেয়ারে মলিন মুখে বসে রইল।
একটু পরে বীণাপাণি এলেন, ‘কী ব্যাপার! মুখ গোমড়া করে বসে আছিস কেন! অফিসে কোনও গন্ডগোল হয়েছে নাকি!’ সমরজিৎ বলল, ‘না।’ বীণাপাণি বললেন, ‘তবে ওঠ। হাত মুখ ধুয়ে জামাকাপড় বদলে নে। রুটি তরকারি দিচ্ছি।’ সমরজিৎ বলল, ‘না মা। খিদে নেই। এক কাপ চা দাও।’ মা বললেন, ‘বাইরে থেকে খেয়ে এসেছিস!’ সে বলল, ‘জামাকাপড় ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে আসছি। ততক্ষণে চা করো।’
পেটে খিদের আগুন জ্বলছে। মাথায়-মনে অপমানের আগুন। আজ শনিবার। কাল রবিবার। বুকের মধ্যে হি হি করে হাসছে চৌত্রিশটা পাঁচশো টাকার নোট। বালি রঙের লেফাফা থেকে টাকাগুলি বের করে লেফাফাটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কাল সকালের মধ্যে সতেরো হাজার টাকা জোগাড় করতে পারবে না। পারলে দীপান্বিতার অপমানের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে আসতে পারত। বাবা নব অভিধান রচনায় মগ্ন। শিউলিকুঞ্জে আলো ফিরে এলে মা বলেছিলেন, ‘ভগবান আছেন। তুই তো আবার ভগবানে বিশ্বাস করিস না।’
দীপান্বিতাকে মনে পড়েছিল সেদিন। ভগবান তো দীপান্বিতাই। অন্ধকারে আলো তো সে-ই জ্বালিয়ে দিল। কিন্তু আজ! আজ দীপান্বিতার কথা ভাবতে গেলে মনে হচ্ছে মেয়েটা আলো জ্বালায়নি। আগুন দিয়ে সব কিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে।
দুই
সেদিন অফিস থেকে ফিরে দূর থেকে শিউলিকুঞ্জের দিকে তাকিয়ে সমরজিৎ অবাক হয়েছিল। তাদের বাড়ি অন্ধকার কেন! লোডশেডিং! তা তো নয়। পাশাপাশি সব বাড়িতে আলো জ্বলছে। কেবল শিউলিকুঞ্জ অন্ধকার।
বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল। এবারে ইলেকট্রিকের বিল এসেছে বাইশ হাজার টাকা। বিলটা দেখে ভেবেছিল অন্য কারও বিল ভুল করে এই বাড়িতে দিয়ে গিয়েছে। আবার দেখল। না। তাদেরই বিল। বাবা মিটারটা সমরজিতের নামে করেছেন। বিলে স্পষ্ট করে লেখা আছে তার নাম। অফিস মাথায় উঠল। আগে বিলের ব্যাপারটা সুরাহা করা দরকার। বাবা অস্থির হবেন। তাঁর নব অভিধান রচনায় সন্ধেবেলা অন্তরায় হয়ে উঠবে।
ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের হেড অফিসে গিয়ে আশাহত হল। আগে নাকি এই বাইশ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। তারপর তাঁরা দেখবেন ঠিক বিল কত টাকার। ওই বাইশ হাজার টাকার বাকি অংশ মাসে মাসে বিলের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নেওয়া হবে। কিন্তু সবার আগে ওই বাইশ হাজার টাকা জমা দিতে হবে।
তখনও বাড়ি অনালোকিত নয়। তবে টাকাটা তাড়াতাড়ি জমা দিতে হবে। নইলে লাইন কেটে দেওয়া হবে।
অন্ধকার শিউলিকুঞ্জে দুটো মোমবাতি জ্বলছে। বাড়িতে ঢুকতেই বাবা গম্ভীর মুখে বললেন, ‘বিদ্যুতের অফিস থেকে লোক এসে লাইন কেটে দিয়ে গেছে। কেন লাইন কাটছে বার বার প্রশ্ন করেও কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। এবারের ইলেকট্রিকের বিল কি মেটানো হয়নি!’ সমরজিৎ শান্ত গলায় বলল, ‘না। এবারে অনেক টাকার বিল এসেছে। চিন্তা কোরো না। কয়েকদিন কষ্ট করো। ব্যবস্থা করছি।’ মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘অনেক টাকার বিল বলছিস। কত টাকার বিল এসেছে?’ সমরজিৎ বলল, ‘তা শুনে কী করবে! একটু ধৈর্য ধরো।’ সেদিন ছিল শনিবার।
সারারাত বাইশ হাজার টাকার কথা ভাবতে ভাবতে সমরজিৎ ঘুমোতেই পারল না। সকালে উঠে মনে মনে হিসেব করে দেখল খুব বেশি হলে পাঁচ হাজার টাকা জোগাড় করতে পারবে। বাকি সতেরো হাজার টাকা কোথায় পাবে! এত টাকা কে তাকে ধার দেবে। অফিস থেকে অ্যাডভান্স পাওয়া যাবে না। তার মনে হল সে বড় একা। বন্ধুহীন। কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার ক্ষীণ যোগাযোগও নেই। রাজনৈতিক একটা বিশ্বাস অবশ্য আছে। তবে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সমরজিৎ অনেক দূরে।
কী করবে! কার কাছে যাবে! শেষপর্যন্ত ভাবতে ভাবতে সন্ধে নেমে এল। বিষণ্ণ এবং অস্থির মন নিয়ে বাড়ি থেকে বেরল। বেশি দূরে যেতে হবে না। তবে হাঁটতে হবে পনেরো মিনিট।
দীপান্বিতাদের বাড়িটা সুন্দর। লোহার গেট ঠেলে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে একটি সুন্দর বাগান। ওই বাগানে ফুল ফোটে। পাখিরা গান গায়। সন্ধেবেলায় পাঁচটা ইউক্যালিপটাসের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় পরিষ্কার আকাশে বিমল চাঁদ। জ্যোৎস্না ঝাঁপিয়ে পড়ে বাগানে। তখন চারদিক বড় মায়াময় মনে হয়। সন্ধেবেলায় কুসুম সৌরভ মানুষকে আচ্ছন্ন করে দেয়। তখন পাখিরা গান গায় না। পাখা ঝাপটায়। সমরজিতের ভালো লাগে।
আজও সেই বাড়ি। সেই বাগান। সেই কুসুম সৌরভ এবং পাখিদের ডানা ঝাপটানোর ফট ফট শব্দ। ইউক্যালিপটাসের পেছনে আকাশ। চাঁদ। জ্যোৎস্না। সবই একরকম। কিন্তু সমরজিৎ পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল দোতলায়। দীপান্বিতা সাপ্তাহিক অভ্যর্থনা জানায়, ‘আসুন। স্যার।’
সেই ঘর। পড়ার টেবিল। বাঁ দিকের তাকে সোনালি রাজহাঁস। সম্ভবত পিতলের। ঝক ঝক করে। কোনও কিছুই সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছে না। আজ সমরজিতের মন ভালো নেই। একেবারেই ভালো নেই।
এখন হয়তো বাবার ঘরে একটা মোমবাতি জ্বলছে। নব অভিধানের কাজ বন্ধ। রান্নাঘরে একটা মোমবাতি। বীণাপাণি রান্না করছেন।
টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে মলিন মুখে বসে আছে সমরজিৎ। উল্টো দিকে দীপান্বিতা। যার বয়স হয়তো উনিশ কিংবা কুড়ি। এখন বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছে।
সতেরো হাজার টাকা কোথায় পাবে! তার কাছে তো আলাদিনের প্রদীপ নেই! হঠাৎ দীপান্বিতা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কী হয়েছে স্যার!’
সমরজিৎ বলল, ‘কী আবার হবে। কিছুই হয়নি। টাস্কগুলো করেছ? দাও। দেখি।’ দীপান্বিতার মুখের গড়নে খানিকটা আহ্লাদি আহ্লাদি ভাব আছে। চোখ সুন্দর। তবে ক্লাস নাইন থেকে চশমা পরছে। গায়ের রং ফর্সা। কেন যে এই বয়সের মেয়েরা নখ বড় রাখে সমরজিৎ জানে না।
দীপান্বিতা বলল, ‘আপনার কী হয়েছে বলুন না!’ ছাত্রীর স্পর্ধা দেখে সে বিরক্ত হল, খাতা দাও। টাস্কগুলো দেখি।’
বড় টেবিল। অনেক বই ও খাতা সযত্নে গোছানো আছে। দীপান্বিতা খাতা বের করছিল। হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেল। প্রথমে যে কথাটা মনে হল তা ইলেকট্রিক বিল সংক্রান্ত। এদেরও কি তাদের মতো ব্যাপার!
অন্ধকার ঘর। ওরা মুখোমুখি বসে আছে। চল্লিশ সেকেন্ডের মধ্যে আবার জ্বলে উঠল আলো।
সমরজিৎ অবাক, ‘কী ব্যাপার বলো তো!’ দীপান্বিতা বলল, ‘এই রকম আজকাল হচ্ছে। হঠাৎ কারেন্ট অফ হয়ে যায়। আবার হঠাৎ ফিরে আসে দু-এক মিনিটের মধ্যে।’ সমরজিৎ বলল, ‘পড়াতে এসে এমন ঘটনা এর আগে তো ঘটেনি!’ আবার আলোতে দেখল দীপান্বিতার নখগুলি বড়। বিচ্ছিরি রুপোলি নেল পালিশে নখগুলি যেন আরও ভয়ঙ্কর। দীপান্বিতা বলল, ‘আগে হতো না। পরশু থেকে ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। বাবা অবিনকাকুকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন কেন এরকম হচ্ছে! অবিনকাকু ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের একজন হর্তাকর্তা। বললেন, চিন্তার কিছু নেই। পাঁচ-সাত দিন পরে ঠিক হয়ে যাবে।’
সমরজিৎ ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠল। এই অবিনকাকু তো তার প্রবলেম সলভ্ করে দিতে পারেন। না। না। এ কথা মুখ ফুটে কিছুতেই দীপান্বিতাকে বলতে পারবে না। বলা উচিতও নয়।
দীপান্বিতা আবার জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কী হয়েছে বলুন না!’ সমরজিৎ এই প্রথম অনুভব করল তার বন্ধুহীন জীবনে দীপান্বিতা যেন শুধু ছাত্রী হয়ে থাকছে না। বন্ধুর মতো ব্যাকুল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
শান্ত গলায় বলল, ‘এক্ষুনি আমার বেশ কিছু টাকার দরকার।’ কথাটা বলতে বলতে তার স্বর কেঁপে উঠছিল। বুঝতে পারছিল ছাত্রীকে কোনও মাস্টারমশাই এমন কথা বলেন না। কী জন্য দরকার বলল না। কথাটা বলেই সমরজিতের মনে হল এক্ষুনি যদি সব আলো নিভে যায় তাহলে স্বস্তি পাবে। দীপান্বিতাকে বলবে, যাও। আলো নিয়ে এসো। তরুণী ছাত্রী উঠে আলো আনতে যাবে। ততক্ষণে সে অন্ধকারে একা বসে থাকবে। দীপান্বিতা মাস্টারমশাইয়ের অপ্রস্তুত চেহারা অন্তত কিছুক্ষণের জন্য দেখতে পাবে না। এর মধ্যে সমরজিৎ নিজেকে সামলে নেবে।
কিন্তু আলো নিভল না। দীপান্বিতা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কত টাকা দরকার!’
এবার সমরজিতের মনে হল ছাত্রী তার খুব কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছে। একবারও মনে হল না ছাত্রী তার বান্ধবী হয়ে উঠেছে। বন্ধু। কেবল বন্ধু। ফলে বিহ্বল কণ্ঠে বলেই ফেলল, ‘সতেরো হাজার।’
‘আমি একটু আসছি’ বলে দীপান্বিতা এই ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা পেরিয়ে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। কেবল এইটুকুই দেখতে পেয়েছিল সমরজিৎ। ফাঁকা ঘরে একা সে বসে রইল। মাথা তার কাজ করছিল না। অকর্মণ্য মাথা নিয়ে বসেছিল দশ মিনিট। তারপর দীপান্বিতা এসেছিল। চেয়ারে বসে তার দিকে বালি রঙের একটা লেফাফা এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘এতে চৌত্রিশটা পাঁচশো টাকার নোট আছে।’ হাত বাড়িয়ে সমরজিৎ লেফাফাটা নিয়েছিল। আবার তক্ষুনি টাকা ভরা লেফাফাটা দীপান্বিতাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘টাকার কথা বলেছিলাম বটে। কিন্তু টাকাটা তো তোমার কাছে চাইনি!’ দীপান্বিতা বলেছিল, ‘চাননি ঠিকই। তবু নিন।’ সমরজিৎ বলেছিল, ‘জানি না এত টাকা তুমি কোথা থেকে পেলে।’ দীপান্বিতা নাছোড়, ‘নিন স্যার। ধার হিসেবেই নিন।’ সমরজিৎ মাথা নাড়ে, ‘না। তা হয় না। এত টাকা ধার নিয়ে শোধ করতে প্রায় চার বছর লেগে যাবে।’ দীপান্বিতা বলেছিল, ‘লাগুক। এটা আপনাকে নিতেই হবে।’
তিন
সমরজিৎ হন হন করে হাঁটছে। আজ রবিবার। দীপান্বিতার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিতে হবে। ময়ূরাক্ষীর মোড়ে পৌঁছে ডান দিকে হাঁটলেই পেয়ে যাবে দীপান্বিতাদের বাড়ি। দূর থেকে মনে হল সেই চারটে ছেলে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। আরও খানিকটা এগিয়ে দেখল। সেই চারটে ছেলে। ওদের উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হবে। মোড়ের মাথায় এসে দেখল কেউ নেই। আতঙ্ক তার মনে এমন বিভ্রম তৈরি করেছে!
সেই বাগান। সেই চাঁদ। কুসুম সৌরভ। পাখসাট। সে পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল দোতলায়। দীপান্বিতা বলল, ‘আসুন স্যার।’
টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসল। বন্ধু হয়েছিল যে আজ সে ছাত্রী। আজ আবার নখে লাল রঙের নেলপালিশ। সমরজিতের মনে হল এক রাক্ষসীর সামনে বসে আছে। জিজ্ঞেস করল, ‘ওরা কোথায়! এখনও আসেনি বুঝি!’ দীপান্বিতা অবাক, ‘কাদের কথা বলছেন!’ সে শান্ত স্বরে বলল, ‘যে চারটে ছেলেকে তুমি পাঠিয়েছিলে। সবে পনেরো দিন হয়েছে। এর মধ্যে টাকাটা চেয়ে পাঠিয়েছ! টাকাটা কি তুমি তোমার বাবার আলমারি থেকে চুরি করেছিলে!’ দীপান্বিতা কাঁদছে আর বলছে, ‘এসব আপনি কী বলছেন! কোন চারটে ছেলে! চুরি করা টাকা নয়। পাঁচ বছর ধরে ওই টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম।’
সমরজিতের একবার মনে হল মেয়েটি ডাহা মিথ্যে কথা বলছে। পরমুহূর্তে মনে হয় মিথ্যে কথা বলছে না। আসলে আজ যেমন ময়ূরাক্ষীর মোড়ে তার বিভ্রম হয়েছিল, তেমন কালও তাই হয়েছিল। সতেরো হাজার টাকার চাপ তাকে এইভাবে বিভ্রান্ত করেছে। এত ভুল দেখবে? এত ভুল শুনবে! হয়তো সত্যিই ওই চারটে ছেলে দীপান্বিতার বন্ধু। ওদের দিয়ে দীপান্বিতা তাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল। আবার তার মাথা অকর্মণ্য হয়ে যাচ্ছে।
হাউ হাউ করে কাঁদছে ছাত্রী আর বলছে, ‘আপনি আমাকে এত ছোট ভাবেন!’
শেষ পর্যন্ত সমরজিৎ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, ‘সতেরো মাস আমি মাইনে নেব না। প্রতি মাসে ওই এক হাজার টাকা তুমি আবার জমাতে শুরু করো।’ দীপান্বিতার কান্না থামে না।
সমরজিৎ পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে।