রাজনীতিক ও পেশাদারদের ব্যস্ততা বাড়বে। বয়স্করা শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিন। ধনযোগ আছে। ... বিশদ
অভিনয় জীবনে জহর রায় বহুদিন কলেজ স্ট্রিট থেকে স্টুডিও যাওয়ার সময় ট্যাক্সি নিয়ে ভানুর বাড়িতে যেতেন তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। অর্থাৎ প্রযোজক এক ট্যাক্সির ভাড়ায় দু’জন আর্টিস্ট পেয়ে যেতেন। ভানু আর জহরের এক ফিল্মে শ্যুটিং থাকলে তো কথাই নেই। প্যাকআপের পরে তিন-চার ঘণ্টা আড্ডা চলত স্টুডিওয়। অনেকের ধারণা রয়েছে, ভানু-জহর দু’জনেই কমেডিয়ান হওয়াতে এঁদের মধ্যে পেশাগত রেষারেষি ছিল। কিন্তু আদতে কিছুই ছিল না। বরং একটু বেশিরকম ভাব-ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল।
১৯৫৫ সালে ভানু যখন প্রথম গাড়ি কিনলেন তখন একদিন টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে কিছু লোককে ডেকে জহর বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করলেন। ‘আপনারা সবাই শুনুন, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আজ একটি রেকর্ড করেছে। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম লোক যে কমিক করে গাড়ি কিনেছে। অর্থাৎ কমেডিয়ানের গাড়ি। এ আমাদের বাংলাদেশের সমস্ত কমেডিয়ানদের গর্ব। এ গাড়ি ভেনোর একার নয়, এ গাড়ি আমাদের সবার।’ এরপর ভানুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘প্রত্যেক শনিবার সকালে আমাকে গাড়ি পাঠাবি।’ ভানু সেই মতো প্রত্যেক শনিবার তেল ভরে জহরকে গাড়ি পাঠাতেন, আর নিজে কোনও প্রয়োজন হলে ট্যাক্সি চেপে কাজ মিটিয়ে নিতেন।
সেইসময় এক ভদ্রলোক ভানুর হাবভাব নকল করে কমেডিয়ান হওয়ার চেষ্টা করতেন। এমনিতে অবশ্য তিনি ভানুর ফ্যান ছিলেন। হঠাৎ একদিন ভানুর কাছে এসে জহরের খুব নিন্দে করতে লাগলেন। ‘জহর একটা কমিক করছে লুঙ্গি পরে শীর্ষাসন, সেটা খুবই রুচিহীন। আসলে ও অশিক্ষিত, অভদ্র।’
ভানু খানিকক্ষণ শুনে বললেন, ‘আমার কিছু কথা আছে এই সম্বন্ধে। তুই যদি ভাবিস জহরের নিন্দা করলে আমি তর গালে চুমু খামু তা হইলে প্রথম ভুল করছস। আর দ্বিতীয় ভুল করছস, জহর কমিক করে বইল্যা, তর ধারণা ও অশিক্ষিত। আমার কাছ থিক্যা শুইন্যা ল, জহরের মতো শিক্ষিত লোক তর গুষ্টিতে নাই।’
অন্যদিকে জহরও ভানুর নামে যা প্রশংসা করতেন, তা অবাক হওয়ার মতোই। একই পেশার একজন অন্যজনকে এরকম প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন সচরাচর শোনা যায় না। একদিন রবি ঘোষ এসে ভানুকে বললেন, ‘ভানুদা, আপনার সম্পর্কে জহরদা যা সব বলল, শুনলে আপনি খুবই দুঃখ পাবেন।’
ভানু ম্রিয়মান হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী বলল?’
রবি ঘোষ আর জহর রায় ‘একটুকু বাসা’ ছবির শ্যুটিংয়ে একই গাড়িতে যাচ্ছিলেন। পথে নানারকম ফিল্মের গল্পের মাঝে জহর বাঙাল ভাষায় বলেন,‘ভানু বাংলার কমিকে যা কইর্যা দিয়া গেল, তর আমার এর চেয়ে বেশি আর কিছু করনের নাই।’ রবির মুখে ভানু একথা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে হাসতে লাগলেন। দু’জনের মধ্যে এমনই পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল।
ভানুর মুখে ‘মাসিমা মালপো খামু’ সংলাপ বাংলা কমেডি ছবির ইতিহাসে আইকনিক। সংলাপের কথা এমন আহামরি কিছু ছিল না, কিন্তু উচ্চারণ আর ডায়লগ ডেলিভারির মুন্সিয়ানায় সংলাপটিকে অসামান্য করে তোলেন ভানুই। চিত্রনাট্যে নাকি সংলাপটাই ছিল না। ভানু ইম্প্রোভাইজ করে বলে দিয়েছিলেন। দৃশ্যটার শ্যুটিংয়ের জন্য ২৪টি মালপোয়া খেতে হয়েছিল তাঁকে। জহর যদিও এই ছবিতে উল্লেখযোগ্য কমেডি চরিত্রেই রয়েছেন, তবে এখানে তাঁরা জুটি নন। একা ভানু, একা জহর। আর শুধু এই দু’জনই বা কেন! বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের প্রায় সব কমেডিয়ানই যেমন নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী, নবদ্বীপ হালদার, শ্যাম লাহা প্রমুখ বাঘা বাঘা কমেডিয়ান রয়েছেন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ নামের এই ছবিতে। উত্তম-সুচিত্রা তো আছেনই। তাঁদের ঘিরেই তো তৈরি হচ্ছে কৌতুকের রত্নহার। সকলেই দুরন্ত। তারই মধ্যে সংলাপ বলে গোল দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ভানু। মেসবাড়ির সেই দৃশ্যটা মনে করুন যেখানে ঘোড়ার রেস আর মদের নেশায় চুর হয়ে দাঁড়িয়ে শ্যাম লাহা। ভানু জহরকে বলছেন, ‘তর লক্ষণ আমি খুব ভালো বুঝি না রে, বড় বেশি শাকপাতা খাওন আরম্ভ করছস...’
শুনে জহর প্রায় তেড়ে ওঠেন, ‘কী...ই...ই’।
ভানু একটু ঘাড় নিচু করে বলেন, ‘দেখিস গুঁতাইস না।’
আসলে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির কথা উঠলেই আমরা ভানুর সেই আইকনিক সংলাপটাই আওড়াই। কিন্তু খেয়াল রাখি না কখন ভানু নিজ অভিনয়ের ছটায় জহর সহ বাকি সমবয়সিদের চ্যালেঞ্জ করে ওই পুরুষ প্রভাবিত মেস বাড়িটিতে গুরুদাস-পদ্মাদেবীর ঘরে ঢুকে চা খেয়ে, রমলা রূপী সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে বেরিয়ে আসে। এসেই কখনও লজ্জা লজ্জা মুখে আবার কখনও ঊর্ধ্ববাহু হয়ে বলতে থাকে, ‘কইসে কথা আমার লগে, আমার লগে কথা কইসে...’।
কী অসাধারণ লাবণ্য সেই অভিনয় জুড়ে! সাধে কী আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ভানু-জহর সম্পর্কে বলেন, ‘ওনলি গ্রেসফুল আর্টিস্টস’।
(ক্রমশ)