বেশি বন্ধু-বান্ধব রাখা ঠিক হবে না। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য আসবে। বিবাহযোগ আছে। কর্ম পরিবেশ পরিবর্তন হতে ... বিশদ
এই যে ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে পড়াশোনা করছেন— তা এই কলেজটা এল কোথা থেকে? কবে থেকে? এবং কী রকমই বা ছিল এই কলেজ, তা না জানা থাকলে বিদ্যাসাগরের তীর্থভূমি এবং বিদ্যাসাগর উপাধিটার উৎসই তো জানা যাবে না। অতএব দু’-চার কথা বলা যাক। না হলে ইংরেজি শিক্ষার আদিটাও যে অজানা থেকে যাবে।
প্রতিষ্ঠানের নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে টোল-চতুষ্পাঠীর বাইরে সংস্কৃত ভাষার চর্চাকে একটা বিধিবদ্ধ চর্চার পীঠস্থান হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠা এখনকার ১ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে এর প্রতিষ্ঠা হল। তার আগে যখন এর প্রতিষ্ঠা নিয়ে কথাবার্তা চলছে, তখন রামমোহন রায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠান স্থাপনে বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি এই চর্চাকে টোল-চতুষ্পাঠীতেই আবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেন এবং সংস্কৃতের পরিবর্তে ইংরেজি শিক্ষার সার্বিক প্রসারের জন্য ইংরেজ সরকারকে পরামর্শ দেন। সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠার সাত বছর আগে ১৮১৭ সালে, এখন যেটি প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি নামে পরিচিত হয়েছে, তার পত্তন হয়েছিল হিন্দু স্কুল বা কলেজ নামে বউবাজারে একটা ভাড়া করা বাড়িতে।
তারপরে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হল। এ সময়েই মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের খুব চেষ্টা চলছিল। সেটা স্থাপিত হল বটে, কিন্তু এর বাড়ি-ঘরদোর নেই। তাই সংস্কৃত কলেজের দু’ ধারের ঘরগুলোয় পড়াশোনা শুরু হয়েছিল প্রথমে। এদিকে সংস্কৃত কলেজ স্থাপিত হওয়ার ফলে ভারতের পুরনো এই ভাষার বিকাশ ঘটতে থাকল। সেই কথা শুনেই আর হিন্দু কলেজের ছাত্ররা আধুনিকতার নামে বয়ে যাচ্ছে শুনে শেষ পর্যন্ত ঠাকুরদাস ছেলেকে এই কলেজেই ভর্তি করে দিলেন। শুধু ঈশ্বরচন্দ্রকে নয়— দীনবন্ধু ও শম্ভুচন্দ্রকেও এখানে পড়াতে লাগলেন। তার থেকে বোঝা যায় যে, ঠাকুরদাস জেনেশুনেই ছেলেদের এখানে শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। পড়াশোনা করে লায়েক হয়ে ছেলেরা অনেক টাকা রোজগার করবেন— এমন আকাশকুসুম স্বপ্ন ঠাকুরদাস দেখেননি। তাঁর ইচ্ছে ছিল সংস্কৃত কলেজে পড়া শেষ করে ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামে গিয়ে টোল খুলে ছাত্রদের সংস্কৃত শেখালে— তাই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট হবে। তবে, সংস্কৃত কলেজে একদমই ইংরেজি শেখানো হতো না— এমনটা কিন্তু ছিল না। অবশ্য, তা ছিল অনেকটা নিয়ম রক্ষা করার মতো। ঈশ্বর সাহেব ছাড়া ভালো ইংরেজি জানা বাঙালিদের কাছে ইংরেজি শিখেছিলেন নিজের চেষ্টায়। দেখতে গেলে সবটাই নিজের চেষ্টায়। সে জন্যই তো তিনি আর পাঁচজনের থেকে আলাদা। ঈশ্বর পড়াশোনা করছেন আর নিজের গোঁ বজায় রেখে চলছেন। বছর তিনেক ব্যাকরণ শ্রেণীতে পড়ার পর মাস ছয়েক ধরে খানকতক সংস্কৃত বই, অভিধান ইত্যাদি পড়ে নিলেন। বাবা খেটেখুটে এসে ছেলেদের পড়িয়ে বড়জোর রাত দশটায় খেয়ে বারোটা পর্যন্ত জেগে থাকতে পারতেন। ঈশ্বর এইটুকু সময় একটু গড়িয়ে নিতেন, তারপরে জেগে উঠে সারা রাত ধরে পড়তে বসতেন। ভরসা প্রদীপের আলো নয়, সারা রাত ধরে প্রদীপ জ্বালার তেল জোগাবার ক্ষমতা ঠাকুরদাসের ছিল না, তাই সেই ইতিহাসটা ঈশ্বর গড়ে তুললেন— রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে যে আলো জ্বলে— তার নীচে বসে-দাঁড়িয়ে সাধক ঈশ্বর ভবিষ্যতের বিদ্যাসাগরকে রচনায় সাধনা করতে লাগলেন।
লোকে বলে, ‘শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়’। তাই কি ঠিক? এই অসম্ভব পরিশ্রমে ঈশ্বরের শরীর ভাঙতে লাগল, উৎকট অসুখ দেখা দিলে। আর এর জের তাঁকে সারা জীবন বইতে হল।
ন’বছর বয়সে কলকাতায় এসেছিলেন, দেখতে দেখতে এগারো বছরের ডাগরটি হয়ে উঠলেন। বাবা বললেন, এবার তোর পৈতে দিয়ে দেব। গ্রামে নিয়ে গিয়ে সেই কাজটি সেরে এলেন ঠাকুরদাস। পরের বছরে ব্যাকরণ শ্রেণী থেকে উঠলেন কাব্য শ্রেণীতে। তখন এই শ্রেণীতে পড়াতেন জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। আর ঈশ্বরের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়তেন মদনমোহন (তর্কালঙ্কার) আর মুক্তারাম (বিদ্যাবাগীশ)। পরে মদনমোহন আমৃত্যু তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে পড়েন। এই ক্লাসে ঈশ্বর কালিদাসের লেখা রঘুবংশম, কুমারসম্ভব ছাড়াও আরও সব বইপত্র পড়তেন। এই শ্রেণীর পরীক্ষাতে তিনি ছিলেন সবার আগে, একেবারে প্রথম। তাঁর হাতের লেখা এতই ভালো ছিল যে, এর জন্য একটা বিশেষ পুরস্কার পেয়ে গেলেন।
একটা মজার কথা এখানে বলে নিই। এখন যেমন সপ্তাহে প্রতি রবিবার স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকে, তখন সংস্কৃত কলেজে ছুটির ব্যবস্থাটা ছিল একেবারে অন্য ধরনের। অষ্টমী আর প্রতিপদ তিথিতে সংস্কৃত পড়া নিষেধ ছিল সে সময়ে— তাই এই দু’দিনই সংস্কৃত কলেজের ছুটি। কী মজা! এছাড়া প্রতি দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী আর অমাবস্যা-পূর্ণিমায় নতুন কোনও পাঠ শুরু করাও ছিল নিষিদ্ধ। সে জন্য যা পড়া হয়েছিল সেগুলো ছাড়া সংস্কৃতে রচনা করার মক্ সো করা হতো। বাংলা থেকে সংস্কৃত, সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ শেখানোও হতো। সবেতেই ঈশ্বর প্রথম। ঈশ্বর তাঁর সব অধ্যাপকের নয়নের মণি। জয়গোপাল তর্কালঙ্কার তো পারলে বুকের মধ্যে পুরে রাখেন। আর তাঁকে শ্রদ্ধা করে ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর নির্দিষ্ট পাঠ একেবারে ঠোঁটস্থ করে রাখতেন। তাঁর মতো স্মরণশক্তি তাঁর ক্লাসের আর কোনও ছাত্রের ছিল না। কলেজের পণ্ডিতেরা বলতেন ছেলেটা একেবারে শ্রুতিধর। ছাপা বই কম ছিল, পুঁথি থেকে ঈশ্বর সব নকল করে নিতেন।
ঠিক এই সময়ের বিদ্যাসাগরের পরের ভাই দীনবন্ধুকে পড়ানোর জন্য ঠাকুরদাস তাঁকেও কলকাতায় নিয়ে এলেন।
(ক্রমশ)