কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। ব্যবসায়ীদের উন্নতির আশা রয়েছে। বিদ্যার্থীদের সাফল্যযোগ আছে। আত্মীয়দের সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেবে। ... বিশদ
—‘ও মা অত্তগুলো নোকের রান্না, তা তেল লাগবে নাকো।’
—‘তা বলে দিন কয়েকেই এত তেল শেষ হয়ে যাবে?’
সরমার সন্দেহবাতিক মনটা রান্নার মাসিকে একটু ঝাপটা মেরেই দিনের শুরুটা করল। বৈঠকখানায় ঢুকে দেখলেন গহীনবাবু সবেমাত্র চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে। দু’চোখের দৃষ্টি যেন খবরের কাগজটাকে গিলে নিচ্ছে। সরমা নিঃশব্দে পাশটিতে এসে দাঁড়ানো মাত্রই গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন— ‘কিছু বলবে?’
—‘বলেছিলাম দিনকে দিন চাঁপার মা’টা যেন হাত সাফাইয়ের মাস্টারনি হয়ে উঠছে। তেল-মশলাপাতি সবই যেন এক ফুৎকারে উবে যাচ্ছে। ওদিকে টুনির মা’টাকেও আমার বেশ সন্দেহজনক মনে হয়। কানের দুলজোড়া টেবিলে রেখেছিলাম। কাল থেকে ওগুলো পাচ্ছি না।’
ঘরের যাবতীয় ঝাড়পোঁছ, ধোয়া-মোছা সবই টুনির মায়ের দায়িত্ব। প্রায় বারো বছর ধরে এ বাড়িতে আছে। তবু এখনও নিজেকে সক্কলের কাছে সন্দেহের ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে পারেনি। সরমার কথায় গহীনবাবু ঘাড় নাড়লেন।
—‘সত্যি, সমস্যার কথা। বাড়ি ভর্তি কাজের লোক রেখেছ। নিজেদের একটু তো সাবধানে চলতেই হবে। হাতে-নাতে ধরতে না পারলে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে তো কোনও কাজ হবে না সরমা। দেখি কী করা যায়।’
গহীনবাবুর বলা কথাগুলো সরমার একদমই পছন্দ হল না। ব্যাজার মুখে আবারও রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
একান্নবর্তীর এই আকালেও গহীনবাবুরা তিন ভাই এখনও এক হাঁড়ি—এক উঠোনেই থাকেন। বড় গহীন। মেজো আর ছোট যথাক্রমে মহীন ও নবীন। গহীনের একমাত্র ছেলে আকাশ বিবাহিত। পুত্রবধূ ঝরণা আর নাতনি অর্ণাকে ঘিরে গহীনবাবুর পরিবার। মেজো মহীন অবিবাহিত। ছোট নবীনের এক ছেলে, এক মেয়ে। ‘একজন ক্লাস সিক্স, আরেকজন ক্লাস ফোর। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই বড় বাড়িটায় বেশ স্বচ্ছন্দেই ওরা বাস করছে। একসঙ্গে থাকলে একটু ঠোকাঠুকি লাগেই। তবে ব্যস, ওই পর্যন্তই। কোনও কিছুই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায় না।
গহীনবাবু সেদিন বিকেল বেলায় পার্কে বসে বন্ধু-বান্ধবদের মাঝেই কথাটা পেড়েছিলেন। বিনয় বলেছিল, ‘দেখো গহীন, বাড়ির এই সব ছিঁচকে চুরি ধরতে কয়েকটা নজরদারি ক্যামেরা বসাও। আর তাছাড়া যা দিনকাল পড়েছে, তার ওপর তোমাদের এত বড় বাড়ি। সারা বাড়িতে কে কোথায় কী করছে, কখন বেরুচ্ছে, কখন ঢুকছে সব কিছু একেবারে তোমার হাতের মুঠোয় থাকবে, বুঝলে।’
গহীন কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ায়। তবু মনে মনে একটা খটকা রয়েই যায়। তবে কি সে এবার থেকে বাড়ির সব মানুষকে সন্দেহের আসনে বসিয়ে দেবে!
বাড়ি ফিরে গহীনের মাথায় নানান কথা আনাগোনা করতে লাগল। শেষে ঠিক করলেন প্রাথমিকভাবে ছেলে আকাশের সঙ্গেই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করবেন। কারণ আধুনিক প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়গুলিতে ছেলে আকাশের বিকল্প হয় না। তারপর না হয় একটা মিটিং ডেকে বাড়ির সব্বাইকে বিষয়টা খোলসা করে বলে একটা সম্মতি আদায় করে নেবেন।
গহীন চিরকালই একটু গম্ভীর প্রকৃতির। কোনও একটা বিষয় মাথায় ঢুকলে সেটা নিয়ে গভীরভাবে ভেবেই চলেন। বাড়ির কর্তা হিসাবেও যথেষ্ট কড়া। সরমা এই বয়সে এসেও স্বামীর মুখের ওপর একটা কথাও বলতে পারেন না।
এক রবিবার সকালে গহীন আকাশকে ডেকে বললেন, ‘একটা কথা ছিল। তুমি একবারটি বৈঠকখানায় গিয়ে বসো। আমি আসছি।’
এই সাতসকালে সাধারণত ছেলের সঙ্গে গহীন খুব একটা কথাবার্তা বলেন না। তবে বাবার কথায় আকাশ বুঝতে পারল যে, কোনও একটা গভীর বিষয়েই গহীন তার সঙ্গে কথা বলবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৈঠকখানায় এলেন গহীন। — ‘হ্যাঁ তোমাকে যে কথা বলছিলাম।’ উৎকণ্ঠায় আকাশের শিরা-ধমনীগুলো যেন টনটন করে উঠল। গহীন বললেন, ‘দেখো খোকা, আমি এ বাড়িতে কিছু নজরদারি ক্যামেরা বসাতে চাই। এ ব্যাপারে তোমার পরামর্শ দরকার।’
বিস্ময়ে হতবাক আকাশ বাবার কথা শুনে একেবারে যেন মাটিতে পড়ল।
—‘সে কী বলছ বাবা! তুমি বাড়ির এত্তগুলো মানুষকে এক নিমেষে সন্দেহের চোখে ফেলে দেবে! এটা তো আর অফিস নয়! আবার ইস্কুল বা বাজারও নয়। তাহলে...!!’
ছেলেকে কথা শেষ করতে না দিয়েই গহীন শুরু করলেন, ‘দেখো খোকা, এত বড় বাড়িতে ছিঁচকে চুরি-চামারি লেগেই আছে।’
—‘তা বলে একেবারে ক্যামেরা লাগাতে হবে? জানো, আমাদের অফিসেও নজরদারি ক্যামেরার ছড়াছড়িতে সক্কলেই কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছে। সব্বাই সব্বাইকে এখন আরও বেশি বেশি করে সন্দেহের চোখে দেখছে। সকলেই ভাবছে এই বুঝি বসের ঘর থেকে ডাক এল। পান থেকে চুন খসলেই উপরওয়ালারা হাঁক পাড়েন। অফিসের সক্কলেই এহেন নজরবন্দি দশায় একেবারে হাঁসফাঁস করে মরছে। আর সেই নজরদারি ক্যামেরা কিনা তুমি এই বাড়িতে বসাতে চাইছ!’
—‘দেখো খোকা, বাড়িতে নিয়মানুবর্তিতা বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। যে যা খুশি করবে সেটা তো চলতে পারে না। আর এখন এমন নজরদারি তো দেশের সর্বত্রই। একটা বেনিয়মের সমাজকে বাঁধতে গেলে এছাড়া আর উপায় কী? আর তাছাড়া আমি তো গোপনে ক্যামেরা বসাচ্ছি না। সব্বাইকে তো জানিয়েই দিয়েছি।’
—‘আচ্ছা বাবা। তোমার একবারও কি মনে হয় না যে এটা একরকম ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল?’
—‘দেখো খোকা, সে জন্যই তো সব জায়গায় লেখা থাকছে, এখানে আপনি নজরদারি ক্যামেরার অধীন। সেক্ষেত্রে সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। সক্কলেই সচেতন হয়ে গেল। আর দেখো তোমাদের এই অত্যাধুনিক সময়েই মানবাধিকার বলে শব্দটা গজিয়েছে। আমাদের সময় এইসব মানব-অধিকার-টধিকার গায়ে দেয় না মাথায় মাখে সেটাই কেউ জানত না।’
বাবার কথায় থই না পেয়ে গোমড়া মুখে আকাশ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
সরমা সমেত একে একে সবাই জানতে পারল বাড়িতে গহীনবাবু নজরদারি ক্যামেরা বসাতে চলেছেন। মিটিং-এ ভাইদের মধ্যে কেউ নিমরাজি হলেও, সম্মতি আদায় করতে গহীনের বেশি বেগ পেতে হল না।
চাঁপার মা, টুনির মা সক্কলের কাছেই ক্যামেরা বসানোর খবরটা গেল। উৎকণ্ঠাভরা মন নিয়ে চাঁপার মা প্রশ্ন করল— ‘সে কী গো বউদিমণি, একেবারে সব ফটো উঠে যাবে।’ টুনির মা সবটুকু শুনে বোবা হয়ে শুধু ফ্যাল্ফ্যাল্ করেই চেয়ে রইল।
ক্যামেরা বসানোর আগে আকাশ বাবাকে একটাই অনুরোধ করল, যেন ব্যক্তিগত পরিসরটুকুতেও নজরদারি ক্যামেরা না বসে। ছেলের কথায় বিরক্ত হয়ে গহীন বলল, —‘ছিঃ ছিঃ, তোমার বাপকে এতটা নিচু মনের মানুষ ভাবলে! তবুও তো আজকালকার সিনেমায় দেখানো হচ্ছে তোমাদের প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরাই বাবা-মা’র ব্যক্তিগত পরিসরে ক্যামেরা ঢুকিয়ে চুপি-চুপি ওদের সব কথা শুনে ফেলছে। কিছু নিয়ম-নীতির বাছবিচার আমারও আছে খোকা, সে কথা ভুলে যেও না।’
দিন কয়েকের মধ্যেই বাড়ির বেশিরভাগ অংশ নজরদারি ক্যামেরার অধীনে চলে এল। গহীনবাবুর নাতনি অর্ণাও দাদুর এহেন কাণ্ডে বিরক্ত। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ক্লাস নাইনের অর্ণা এখন যথেষ্ট পরিণত। বাড়িতে নানা বন্ধু-বান্ধবদের আনাগোনা, নিজেও যখন-তখন বাইরে বেরয়। খালি এরই মাঝে খটকা হিসাবে রয়ে গেছে নজরদারি ক্যামেরা। উঠতি বয়সের অর্ণার চলাফেরা কয়েকটা বোবা চোখের ভেতরে শুধুই আটকা পড়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তারক্ষীদের ক্লান্ত চোখগুলোকে সমাজ এখন আর বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রযুক্তির কল্যাণে টোয়েন্টি ফোর ইন্টু সেভেনের অক্লান্ত চোখগুলো সমাজজীবনের নজরদারিতে এখন একেবারে প্রথম সারিতে। তবু বিজ্ঞানের আশীর্বাদ আজও অনেক ক্ষেত্রেই অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। নজরদারির বোবা চোখগুলোকে সাক্ষী রেখে তুলে চলা নানান অবাঞ্ছিত ছবি সমাজকে চোখ রাঙায়। গহীনবাবুর নাতনি অর্ণা ওরফে টুকাই এই বয়সে এসে ক্রমশ যেন অসহিষ্ণু। পড়াশোনায় ভালো মেয়ে হিসাবে ইস্কুলে টুকাইয়ের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তবুও আকাশ আর ঝরণা ওর ওপর ক্রমশ চাপ বাড়িয়েই চলেছে। ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম কুড়ির মধ্যে থাকতে হবে বলেও ফরমান জারি করেছে।
দাদু হিসাবে গহীন ছেলে বউমার ইচ্ছের লাগামটা সামলানোর পরামর্শ দেন। কিছুদিন হল নজরদারি ক্যামেরার প্রশ্নে টুকাই দাদুর কাছ থেকেও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। বাইরে উচ্ছলতার সঙ্গে ঘুরে বেড়ালেও ঘরে প্রায় চুপচাপই থাকে। গহীনবাবু পরামর্শ দিয়েছেন নাতনিকে কোনও একজন মনোবিদের কাছে নিয়ে যাওয়ার। বাবার বলা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলেও এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে আকাশ। উপরন্তু বলেছে, ওসব নাকি মেয়ের ভাঁওতাবাজি আর অভিনয় ছাড়া কিছুই নয়। সরমাও সেদিন ঝরণাকে বলেছিল, টুকাইকে কোনও একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা। মা হিসাবে ঝরণা শাশুড়ির সে সব কথাও উড়িয়ে দিয়েছে।
নবীনের মেয়ে ঋত্বিকা টুকাইয়ের সঙ্গে ঘরে ঘুরতে-ফিরতে একেবারে লেগে থাকে। তবু এখন সেই ঋত্বিকাই টুকাইয়ের দু’চক্ষের বিষ। এর ওপর বাড়িতে ক্যামেরার নজরদারি আগুনে ঘি ঢালার শামিল হয়ে পড়েছে।
গহীনবাবু সপ্তাহে একদিনই অর্থাৎ ফি রবিবার সকালে নজরদারি ক্যামেরায় তোলা সারা সপ্তাহের ছবিগুলো জরিপ করতে বসেন। এমনই এক ছুটির দিনে খুব সক্কাল বেলায় উঠে গহীনবাবু দেখলেন সারা বাড়িটা অদ্ভুত রকমের নিশ্চুপ। চারপাশ থেকে কাক-পক্ষী ডাকার শব্দও শোনা যাচ্ছে না। আজ যেন গহীনদের সারা বাড়িটা একটু বেশিই ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালবেলার তাজা মনটাও গহীনের কাছে কেমন যেন পান্সে ঠেকছে। অস্থির মন নিয়েই অভ্যাসমতো নজরদারি ক্যামেরায় বন্দি ছবিগুলো জরিপ করতে বসে নবীন।
বোবা চোখগুলোর নীরব চাউনিতে ধরা পড়া ছবিগুলো তখন গহীনের চোখের সামনে একের পর এক ভেসে উঠছে। সারাটা বাড়ির সাবধানী অথচ আড়ষ্টতা জড়ানো জীবন একটার পর একটা ছবিতে চলে যাচ্ছে।
গত রাতের ছবিগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ-ই গহীনের দৃষ্টি একেবারে স্থির হয়ে গেল।
ওই তো টুকাই নিস্তব্ধ রাতে পড়ার ঘরের টেবিলে বসে কী যেন লিখছে। তার কিছুক্ষণ পর চেয়ারটা টেনে এনে সিলিং ফ্যানটার ঠিক নীচে রাখল। তারপর চোয়াল শক্ত করে নজরদারি ক্যামেরার চোখে চোখ রাখল, কী অসম্ভব ঠান্ডা চোখ দুটো? তার ওপরে ওড়নাটা শক্ত করে পাখার সঙ্গে বেঁধে তৈরি করল ফাঁসটা। তারপর... তারপর...।
গহীনবাবু আর স্থির থাকতে পারলেন না। টুকাইয়ের ঘরের বন্ধ দরজায় আছড়ে পড়ল গহীনের শরীরটা।