কর্মরতদের সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা ও ব্যবহারে সংযত থাকা দরকার। ... বিশদ
পর্ব-৭
তবে উত্তমকুমার নয়, ভানুর অভিনয় জীবনের মেন্টর বা সবচেয়ে বড় আইকন ছিলেন ছবি বিশ্বাস। গৌতমবাবু বলছিলেন, ‘অবশ্য সেইসময় শুধু বাবা নয়, তখনকার সমস্ত অভিনেতারই গুরুস্থানীয় ছিলেন ছবি বিশ্বাস।’ ‘স্ত্রী’ ছবিতে উত্তমকুমারের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মেলোড্রামাটিক সিন ছিল। সেই দৃশ্যটার রিহার্সাল থেকে টেক পর্যন্ত ভানু হাঁ করে উত্তমকুমারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। উত্তমকুমার সেটা ভালোই বুঝেছিলেন, কিন্তু মুখে কিছু বলেননি। শটটা ফাইনালি টেক করার পর উত্তমকুমার ভানুকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী ভানুদা, হাঁ করে আছিস কেন?’
ভানু চুপ। কোনও কথা না বলে একবার ঢোঁক গিলে আবার ‘হাঁ’ করে উত্তমকুমারের দিকেই তাকিয়ে রইলেন।
উত্তমকুমার তখন হেসে বলেন, ‘আসলে কী জানিস ভানুদা, ভালো অভিনয় এক রকমই হয়। ছবিদার প্রভাব এসে পড়বেই।’ ভানু তখন হেসে বলেন, ‘তাই বলো।’
ছবি বিশ্বাসও ভানুকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসতেন। গৌতমবাবুই বলছিলেন,‘ছবি জ্যাঠামশাইয়ের শেষ ১০-১১ বছর ফিল্ম লাইনে একমাত্র নৃপতি চট্টোপাধ্যায় ছাড়া বাবার মতো আপনার কেউ ছিল না। অথচ বাবার মুখেই শুনেছি ছবি জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে বাবার আলাপ অত সহজে হয়নি।’ কী রকম? তখন ১৯৪৭-’৪৮ সাল। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়দের একটা দল ছিল সেই সময়, যাঁরা ছোটখাট পার্টের জন্য স্টুডিওপাড়ায় পরিচালকদের পাশে ঘুরঘুর করতেন। প্রদীপকুমার, দেবী মুখোপাধ্যায়ের ভাই গৌতম মুখোপাধ্যায়, দুলাল গুহ, জহর রায়ও সেই দলে ছিলেন। ‘অভিযোগ’ ছবির শ্যুটিং চলছে। ভানুর খুব ইচ্ছে একবার ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে আলাপ করবেন। কিন্তু ছবি বিশ্বাস পাত্তা দিচ্ছিলেন না।
গৌতমবাবু বলছিলেন,‘আসলে ছবি জ্যাঠামশাই ভেবেছিলেন ফিল্মে চান্স পাওয়ার জন্য বাবা বুঝি জেঠুকে তোষামোদ করবেন। এদিকে বাবাও জেঠুর ওইরকম ব্যক্তিত্ব দেখে কাছে ঘেঁষতে সাহস পেত না।’
এরপর ধীরে ধীরে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটু নাম হল। টাইটেলে, বুকলেটে তাঁর নাম বেরতে শুরু করল। ‘মানদণ্ড’ ছবির শ্যুটিং শুরু হল। তখনই ছবি বিশ্বাস ‘নতুন ইহুদী’ নাটকে ভানুকে দেখেন। পরের দিনই ভানুকে ডেকে খুব প্রশংসা করেন। এরপর থেকে বলতে গেলে ভানুর অভিভাবকের মতো হয়ে যান ছবি বিশ্বাস। পিতৃবিয়োগের সময় ভানুকে অর্থসাহায্য থেকে ভানু যখন ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবি প্রযোজনা করেন, তখনও নামমাত্র পারিশ্রমিকে অভিনয় করে দিয়েছিলেন তিনি। আর সে কী উৎসাহ! দুপুর দুটোয় শ্যুট। সেটে চলে আসতেন প্রায় ঘণ্টা দুই আগে। প্যাক আপের পরেও আড্ডা দিতেন। এমনকী কাজ না থাকলেও সেটে চলে আসতেন। ভানুর সঙ্গে তাঁর এই সম্পর্ক জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বজায় ছিল।
একবার পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় ‘রূপান্তর’ ফিল্মের সেটে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে উচ্চারণ নিয়ে খুব বকাবকি করলেন।
—‘তোমার জিভের আড়ই ভাঙেনি, তুমি অ্যাক্টিং করতে এসেছ।’
যদিও আর কোনও পরিচালক কখনও ভানুর উচ্চারণ নিয়ে অভিযোগ করেননি। এরপর ভানু নিজেই যেচে ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে কথাচ্ছলে উচ্চারণে যদি কিছু ভুল থাকত সেটা ঠিক করে নিতেন।
এরপর ভানুর আর একটু নাম হওয়ার পর সেই অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ই ‘কপালকুণ্ডলা’ ছবিতে ভানুকে সাইন করাতে আসেন।
ভানু তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে বলেন,‘শ্যুটিং-এর আগে কয়েকদিন রিহার্সাল করে নেবেন।’ অর্ধেন্দুবাবু বলেন, ‘তার কী দরকার! রিহার্সাল করে চুক্তি করার দরকার নেই।’
ভানু তখন বলেন, ‘তা কী করে হয়। একটু উচ্চারণটা দেখে নেবেন না।’ জহর গঙ্গোপাধ্যায়ও মাঝে মাঝে ভানুকে উচ্চারণ এবং ইস্টবেঙ্গল নিয়ে খ্যাপাতেন। গৌতমবাবু হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘এরপর এমন হল ভুল উচ্চারণ শুনলেই বাবা খেপে যেতেন এবং শুধরে দিতেন। বাবা বলতেন বেশিরভাগ বাঙালিরই (ঘটিই হোক কী বাঙাল) স, শ, র আর চন্দ্রবিন্দু’র উচ্চারণ ঠিক নেই। আমার জীবনে দেখেছি বাবা নানা জায়গায় অন্তত একশো লোককে বজ্র (বেশিরভাগ লোক বজরো উচ্চারণ করেন) শব্দের উচ্চারণ ঠিক করে দিয়েছেন।’
এই উচ্চারণ নিয়ে ভানুর পিছনে লাগতেন ছবি বিশ্বাসও। ইস্টবেঙ্গল হারলে বলতেন, ‘আজ ভানুকে ছুটি দিয়ে দাও। বাঙালের পো’র মন খারাপ।’ আবার মোহনবাগান হারলে ভানু পাল্টা বলতেন, ‘ছবিদা হাতের গন্ধ শুকুন। ১৯১১-য় যে ঘি খেয়েছিলেন তার গন্ধ এখনও আছে কিনা দেখুন।’
এমনই সুন্দর সম্পর্ক ছিল। ছবি বিশ্বাস ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবির খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েও আলোচনা করতেন ভানুর সঙ্গে। গৌতমবাবু বলছিলেন, ‘কিছু কিছু জায়গায় আর্টিস্ট নির্বাচন নিয়ে বাবার গোঁ ছিল। ছবি জ্যাঠামশাই সেখানে বেশি কথা বলতেন না। কেবল বলতেন ভেবেচিন্তে কাজ করো, ডিস্ট্রিবিউটর টাকা দেবে, তার সঙ্গে বিশেষ ঝগড়া করো না।’
একটা হাসির তরজা গানের দৃশ্য ছিল। ডিস্ট্রিবিউটর চেয়েছিলেন মিন্টু দাশগুপ্তকে। কিন্তু ভানু গোঁ ধরেন, ওই রোলে তুলসী চক্রবর্তীকেই চাই। শেষপর্যন্ত তাঁর কথাই থাকল। অভিনেত্রী নির্বাচন নিয়েও প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছিল। প্রায় ১ বছর শ্যুটিং বন্ধ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভানুর পছন্দের অভিনেত্রীকেই নিতে হয়েছিল।
‘কাবুলিওয়ালা’ ছবি বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নির্বাচিত হল। ছবি বিশ্বাস বার্লিন গেলেন। ভানুর সে কী আনন্দ! ভেবেছিলেন, নির্ঘাৎ ছবি বিশ্বাসই শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পাবেন। তাঁকে দমদম বিমানবন্দরে গিয়ে সি-অফ করেও এসেছিলেন। ছবি বিশ্বাস বার্লিন থেকে ফিরলে টানা এক মাস লাগাতার বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল নিয়ে আড্ডা চলত। ছবি বিশ্বাস যেদিন জাগুলিয়ার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, সেদিন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়েরও যাওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল, বসুশ্রীর সুবোধ মুখোপাধ্যায় গাড়ি চালাবেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাস, তাঁর স্ত্রী ও এক নাতি যাবেন। কিন্তু হঠাৎই রেডিও নাটক পড়ে যাওয়াতে শেষপর্যন্ত আর যেতে পারেননি ভানু। তিনি না যাওয়াতে সুবোধ মুখোপাধ্যায়ও যাননি। সেই আফশোস ভানু বয়ে বেড়িয়েছেন আজীবন। কেবলই তাঁর মনে হতো, যদি সঙ্গে থাকতেন তাহলে কিছুতেই দুর্ঘটনা হতো না।
ছবি বিশ্বাসের প্রয়াণ ভানুর মাথার ওপর থেকে যেন ছাদ সরিয়ে নিয়েছিল। বহুদিন পর্যন্ত কাজকর্মে মন বসাতে পারেননি তিনি।
‘লাখ টাকা’ ছবির একটি দৃশ্যে ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
অনুচিত্রণ:ভাস্কর মুখোপাধ্যায়