বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
আসলে ঈশ্বরচন্দ্রের পূর্বপুরুষরা সবাই ভালো সংস্কৃত জানতেন— ঠাকুরদা রামজয় তো তর্কভূষণ উপাধি-ভূষিত ছিলেন। তাঁর বাবা ভুবনেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বাঘা সংস্কৃত পণ্ডিত ছিলেন। রামজয়ের শ্বশুরমশায় উমাপতি তর্কসিদ্ধান্ত পর্যন্ত ডাকসাইটে পণ্ডিত। সেখানে ঠাকুরদাস সংস্কৃতর ‘স’ পর্যন্ত জানতেন না— যদিও পরে ছেলেকে পড়াতে গিয়ে ভাষাটা ভালোই শিখে নিয়েছিলেন। তাই ঠাকুরদাসের সংস্কৃত পড়ানোর দিকে একটা দুর্বলতাই ছিল। তাই কারও পরামর্শে কান না দিয়ে সরাসরি সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করে দিলেন ছেলেকে। বিদ্যাসাগর মশায় নিজেই লিখে গেছেন, ঠাকুরদাস ভেবেছিলেন ‘আমার একান্ত অভিলাষ, সংস্কৃত শাস্ত্রে কৃতবিদ্য হইয়া দেশে চতুষ্পাঠী করিবেক, তাহা হইলেই আমার সকল ক্ষোভ দূর হইবেক। .... তাঁহারা অনেক পীড়াপীড়ি করিলেন, তিনি কিছুতেই সম্মত হইলেন না।’ ছেলে ‘উপার্জনক্ষম হইয়া, আমার দুঃখ ঘুচাইবেক, আমি সে উদ্দেশে ঈশ্বরকে কলিকাতায় আনি নাই।’ দু’ টাকা মাইনের বাবার দূরদৃষ্টিকে বলিহারি দিই।
অতএব ঈশ্বরচন্দ্র মাত্র ন’বছর বয়সে গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলেন। তারিখটা ছিল ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের পয়লা তারিখ। ভর্তি হলেন কিন্তু বীরসিংহায় তিনি সংস্কৃতের আদ্যপাঠটুকুও সেরে আসেননি। সংস্কৃত কলেজে সংস্কৃত ভাষা শেখানোর ভার ছিল হালিশহরের কাছে কুমারহট্টের গঙ্গাধর তর্কবাগীশের। কী করে ছোটদের সংস্কৃত শেখানো যায়— সেই বিদ্যাটা তাঁর নখদর্পণে ছিল। ঠাকুরদাস প্রতিদিন সকাল ৯টার সময় ঈশ্বরকে খাইয়ে পটলডাঙার (তখন সংস্কৃত কলেজের অঞ্চলকে লোকে পটলডাঙা বলেই ডাকতেন) কলেজে পৌঁছে দিয়ে শিক্ষক গদাধর তর্কবাগীশের সঙ্গে একটু কথা বলে আবার দুই মাইল হেঁটে বড়বাজারের বাসায় এসে খেয়ে অফিসে যেতেন। বিকেল চারটে বাজলে অফিস থেকে বের হয়ে ছেলেকে কলেজ থেকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আবার অফিসে যেতেন, বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা হয়ে যেত।
এমনি করে মাস ছয়েক যেতেই ঈশ্বরচন্দ্র পথ চিনে ফেলেছেন দেখে ঠাকুরদাস একাই ছেলেকে স্কুলে যেতে দিলেন। রাতে ফিরে এসে ছেলে যা শিখেছে তা জিগ্যেস করতেন। ঠাকুরদাস এতই মেধাবী ছিলেন যে ঈশ্বরচন্দ্র যা পড়া হয়েছে তা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে গেঁথে যেত। ঈশ্বর ভুল বললে তিনি তা চট করে ধরে ফেলতেন। এদিকে ঈশ্বরচন্দ্র তাই দেখে ভাবতেন যে, তাঁর বাবা সংস্কৃতে একটা জাহাজ। কিন্তু এই পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় যেত। যেদিন অফিস ফেরত এসে দেখতেন, ছেলে প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে— অমনি কান ধরে তাকে তুলে তুলোধোনা করতেন। সেটা পড়ছে না বলে তো বটেই, অকারণে প্রদীপের তেল পুড়ছে বলেও তার রাগ সম্ভবত বেশি হতো। এত মারতেন যে জগদ্দুর্লভবাবু ও তাঁর পরিবারের লোকজনেরা খুব কষ্ট পেতেন। একদিন তো জগদ্দুর্লভবাবু বলেই দিলেন— ছেলেকে আপনি যদি এত মারেন তবে আপনাকে আমার বাড়িতে আর রাখতে পারব না। ভয়ে ঠাকুরদাস সংযত হলেন— ঈশ্বরচন্দ্র বেঁচে গেলেন। তবে যাতে ঘুম আর না আসে সেজন্যে তিনি চোখে সরষের তেল ঘষতেন— যাতে তেলের ঝাঁঝে চোখ জ্বালা করলে ঘুম বাপ বাপ বলে পালায়, আর ঈশ্বর তাতে বাঁচেন।
ততদিনে মাস ছয়েক পড়া এগিয়ে গেছে— একটা পরীক্ষা দেবার সময় এল। তিনি পরীক্ষা দিলেন এবং এত ভালো ফল করলেন যে সাড়ে ন’বছরের একটা ছেলে ১৮২৯-’৩০ সালেই পাঁচ টাকার বৃত্তি পেয়ে গেলেন। বৃত্তির টাকা পেয়ে বাবার হাতে তুলে দিলেন। ব্যাকরণ শ্রেণীতে তাঁকে পড়তে হয়েছিল টানা তিন বছর, এর মধ্যে দু’বছরের পরীক্ষায় ভালো ফল করে বৃত্তি পান— এক বছরের ফল ততখানি ভালো না হওয়ায় ক্ষোভে-দুঃখে ঈশ্বরচন্দ্র ঠিক করেছিলেন সংস্কৃত কলেজ ছেড়ে দিয়ে গাঁয়ে ফিরে গিয়ে দণ্ডিপুরে বিশ্বনাথ সার্বভৌম পণ্ডিতের টোলে গিয়ে পড়বেন। আসলে এই পরীক্ষাটির দায়িত্বে ছিলেন এক সাহেব, যিনি নিজেই সংস্কৃত ভালো জানতেন না। একটা বেঁটেখাটো মাথা-মোটা ক্যাবলা-কেষ্ট ছেলে— যে ছাতা মাথায় দিয়ে গেলে লোকটাকেই চেনা যেত না ছাতার আড়ালে— সেই ছেলেটা প্রথম হবে? সাহেব তাকে ঠিকমতো নম্বরই দিলেন না।
ঈশ্বরচন্দ্র ছোট থেকেই জেদ চাপলেই ঘাড় বেঁকিয়ে চলতেন। সাহেবকে দেখেই তাঁর ঘাড় বেঁকে যেত। আসলে এঁড়ে বাছুর তো। বাবা তাঁকে জানতেন ভালো। তাই ময়লা কাপড় পরে পড়তে যাচ্ছে দেখলেই বলতেন, বেশ করেছিস ময়লা কাপড় পরেছিস। অমনি ঈশ্বরচন্দ্র সাবান কাচা কাপড় পরতেন। একেবারে হুবহু বর্ণপরিচয়ের সুবোধ গোপাল!
ছবিতে সংস্কৃত কলেজের বেদান্ত শ্রেণীর উপস্থিতির খাতায় নাম রয়েছে মদনমোহন ও ঈশ্বরচন্দ্রের।
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল