পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
পর্ব-৬
খেলা ভালোবাসলেও অভিনয়ই যে তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, পেশা-নেশা সব ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সাফল্য করায়ত্ত করেও অনুশীলনে ফাঁকি দেননি কখনও। তিনি যখন রেডিওতে কাজ শুরু করেন, তখন লাইভ টেলিকাস্ট হতো, আর তাই নিয়ে টেনশন করতেন খুব। তবে নিয়ম করে অন্তত বার চারেক রিহার্সাল করতেন। পরে যখন লাইভ অনুষ্ঠান উঠে গিয়ে রেকর্ডিং শুরু হল, তখন ভুল ত্রুটি শুধরে নেওয়ার সুযোগ থাকায় অনুষ্ঠান করা তুলনায় সহজ হয়ে গেল। কিন্তু ভানু নিজের অভ্যাস বদলাননি। তখনও নাকি চারদিনই রিহার্সাল দিতে ছুটতেন।
ভানু-কন্যা বাসবী এক জায়গায় বলছেন, ‘বাবা যে কোনও অনুষ্ঠান নাটক বা যাত্রার জন্য মঞ্চে ওঠার আগে প্রচণ্ড টেনশন করতেন। ছটফট করতেন। যেন প্রথমবার মঞ্চে উঠছেন এমনই অস্থির হয়ে থাকতেন ভিতরে ভিতরে। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, যেদিন এটা থাকবে না, সেদিন শিল্পী হিসেবে আমার দিনও শেষ হয়ে যাবে।’ রেডিওতে অনুষ্ঠান করে যে সামান্য টাকা পেতেন তা দিয়ে গাড়ির তেলখরচটুকুও উঠত না। বেশিরভাগ সময় সহঅভিনেতারাও থাকতেন না। কিন্তু তিনি ঠিক যেতেন।
পি জি উডহাউসের লেখা আর চার্লি চ্যাপলিনের খুব বড় ভক্ত ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের কর্মজীবনেও চার্লির বোধের উপরেই ভরসা রেখেছিলেন। নিজেই লিখেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, পরিবেশন ঠিকমতো হলে সাধারণ মানুষ সেটা উপলব্ধি করতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, চার্লি চ্যাপলিনের কোনও ছবিই সাধারণ মানুষের দুর্বোধ্য নয়।’ ছবিতে অভিনয় করতে ভালোবাসলেও, নাটক যাত্রার মতো মাধ্যম ছিল তাঁর ভীষণ প্রিয়। কারণ দর্শকদের পছন্দ-অপছন্দ যাইহোক না কেন সেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া তিনি উপলব্ধি করতে চাইতেন।
মনে করতেন সমাজের সমস্যা তুলে ধরা প্রত্যেক শিল্পীর একটা নৈতিক দায়িত্ব। নাটকের পাশাপাশি কৌতুক নকশার মাধ্যমেও সেই চেষ্টাই চালিয়েছেন আজীবন। এ বিষয়ে সম্পদ ছিল তাঁর মুখের ভাষা। প্রতি বছর গ্রামাফোন কোম্পানি থেকে বেরত ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কমিক নিয়ে শারদ অর্ঘ্য। আর তার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকত শ্রোতারা। কমিক রেকর্ডের ঐতিহ্য একশো বছরেরও বেশি প্রাচীন। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন গোস্বামীর দুটি কৌতুক নকশার রেকর্ড—‘বিকট বিরহ’ এবং ‘চাষার খেদ’। একইসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল অভয়পদ চট্টোপাধ্যায়ের দুটি কমিক—‘স্বামীর প্রতি স্ত্রীর সোহাগ’ আর ‘স্ত্রীর প্রতি স্বামীর সোহাগ।’ পরবর্তীকালে নবদ্বীপ হালদার থেকে রবি ঘোষ অনেক শিল্পীই নিজেদের কমিক রেকর্ড করেছেন। কিন্তু এই পরম্পরায় ধারাবাহিকতা এবং প্রভাবে ভানুর কাছাকাছি পৌঁছতে পারেননি কেউই। ভানুর রেকর্ড প্রকাশিত হলে যাঁরা কিনতেন, তাঁদের থেকে অনেক বেশি সংখ্যক শ্রোতা রেকর্ড ডিলারের দোকানে বাজানো কৌতুক নকশা কার্যত মুখস্থ করতেন। পরবর্তীকালে নিজেরা আড্ডায় সেই কৌতুক স্মৃতি থেকে তুলে এনে বাহবা কুড়োতেন।
দৈনন্দিন জীবন থেকেই ভানু তাঁর কমিকের রসদ সংগ্রহ করতেন। যেমন, যাঁরা অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায়, তাদের নিয়ে ‘চোখে আঙুল দাদা’, দাম্পত্য দ্বন্দ্বের চিরকালীন বিষয় নিয়ে ‘কর্তা বনাম গিন্নি’। ক্রস কানেকশন নিয়ে যখন সাধারণ মানুষ জেরবার তখন ভানু নিয়ে এসেছেন ‘টেলিফোন বিভ্রাট’। আবার পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে বাড়াবাড়ির সময় তাঁর কৌতুক নকশা ‘পরিবার পরিকল্পনা’ শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরত। এভাবেই ‘চন্দ্রগুপ্ত’ থেকে ‘মহাকাশ ভ্রমণ’ ভানুর কমিক রেকর্ডের অংশবিশেষ শ্রোতাদের স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে আজও। সিনেমার মতোই নিজের নামেও কৌতুক নকশা করেছেন তিনি— ‘লর্ড ভানু’ বা ‘ভানু এল কলকাতায়।’ এমনকী ‘নব রামায়ণ’ কৌতুক নকশায় রাম-লক্ষ্মণ-সীতার অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে যে সব স্যাটায়ার ভানু করেছেন, আজকের জমানায় তা প্রকাশিত হলে তিনি নিশ্চিত বিপদে পড়তেন।
লোককে এত হাসাতেন অথচ বাস্তবে তাঁর মতো জেদি মানুষের খোঁজ পাওয়া ছিল দুষ্কর। শিল্পীদের স্বার্থরক্ষায় সংগঠন তৈরি করেছিলেন অভিনয় জীবনের মধ্যগগনে। ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে যখন ধর্মঘট হয়েছিল, তখন অন্যান্যদের সঙ্গে তিনি ও অভিনেতা ছবি বিশ্বাস যুক্ত হন ‘সিনে টেকনিশিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’-এর আন্দোলনে। প্রযোজকদের একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন বারবার। এই জেদি স্বভাবের জন্যই উত্তমকুমারের সঙ্গেও একসময় তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। অথচ নিজের ছোটভাইয়ের মতো ভালোবসাতেন মহানায়ককে। উল্টোদিকে উত্তমকুমারও তাই। ‘ভানুদা’ ডাকতেন, আবার ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন। ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবিটি তৈরি করতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে যাঁরা অর্থসাহায্য করেছিলেন, উত্তমকুমার ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ‘ভ্রান্তিবিলাস’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য ভানুকে সোনার গিনি দিয়ে অ্যাডভান্স করেছিলেন তিনি। এমন ভালো সম্পর্কেও তৈরি হয়েছিল সংঘাত। ষাটের দশকে ‘অভিনেত্রী সংঘ’ ভেঙে শিল্পী সংসদ তৈরি করলেন উত্তমকুমার। মহানায়কের সঙ্গে সেখানে চলে গেলেন বিকাশ রায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়রা। এদিকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে থেকে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপকুমাররা। ‘কালো’ তালিকাভুক্ত করা হল ওঁদের। এই সময় সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ রিলিজ করবে। তাতেও বাধা দেওয়া হতে পারে বলে খবর রটে গেল। একজোট হলেন ভানু, সৌমিত্র, অনুপকুমার, অজিত লাহিড়ী, সৌমেন্দ্যু রায়রা। বিজলি সিনেমায় গন্ডগোল হতে পারে আঁচ করে টানা ৮ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতেন। হাতে কাজ নেই। কিন্তু মনে জেদ। মাথা নোয়াবেন না কিছুতেই। যাত্রা দল গড়লেন। স্মৃতিচারণায় নীলিমাদেবী বলেছেন, ‘যে মানুষ নরম বিছানা ছাড়া শুতে পারতেন না, তিনিই গ্রামে-গঞ্জে শতরঞ্জি পেতে গাছের তলায় ঘুমতেন। বাড়িতে থাকলে যিনি এটা-ওটা খেতেন না, সেই তিনিই দিনের পর দিন চপ, ফুলুরি, মুড়ি খেয়ে কাটিয়েছেন। একবার একটা আধভাঙা বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়ার সময় তো বুকের ওপর সিলিংয়ের চাঙড় খুলে পড়েছিল।’
এই সময়ই প্রথমবার হৃদরোগে আক্রান্ত হন ভানু। তাঁর পুত্র গৌতমবাবুর কথায়, ‘আসলে উত্তমকাকুর সঙ্গে বিচ্ছেদ কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি বাবা। পরে অবশ্য সব মিটমাট হয়ে যায়।’
ছবিতে উত্তমকুমার ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
(* ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর)
অনুচিত্রণ:ভাস্কর মুখোপাধ্যায়
অলংকরণ: চন্দন পাল