বেশি বন্ধু-বান্ধব রাখা ঠিক হবে না। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য আসবে। বিবাহযোগ আছে। কর্ম পরিবেশ পরিবর্তন হতে ... বিশদ
সেদিন বিদ্যাসাগর মশায়ের চোখ জলে ভেসে গিয়েছিল কি না আমরা জানি না। কতখানি নত হয়ে পুত্র জননীর চরণ কতবার বন্দনা করেছিলেন— তাও জানি না। কিন্তু এ তো আমরা সবাই জানি এই গয়না গড়িয়ে দিয়ে বিদ্যাসাগর মাকে সালঙ্কারা করেছিলেন। গর্ভধারিণী আর দেশজননী শব্দের অর্থ যে এক, বর্ণপরিচয় পড়ার সঙ্গে এই পড়াটাও আমাদের হয়ে গিয়েছিল সেই দেড়শো বছর আগেই হয়তো। স্বামীজি বলতেন— দুটো পুজো করার বদলে ফুটবলে দুটো লাথি মারলে দেশটা উদ্ধার হয়ে যেতে পারে। ভগবতী দেবী বলতেন একটা জগদ্ধাত্রী পুজো করে যা খরচ হয়— গরিব-লাচাড় লোকেদের তা দিয়ে অনেক উপকার করা যায়। স্বামীজি ভাবেন এক ভাবে, আমাদের মাতাজি ভাবেন অন্য ভাবে। দু’জনেই আসলে দেশপূজক।
মায়ের ইচ্ছা এবং পুত্রের পূরণের এই মহান কথকতা চাপা পড়ে থাকার কথা নয়। ১৫ শ্রাবণ ১২৭৩ সালের হিন্দু পেট্রিয়টের সংবাদদাতার সংবাদে প্রকাশ পেল ‘সেবাব্রত’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন। তাতে লেখা হয়েছিল— ‘বীরসিংগ গ্রামে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মাতা চার-পাঁচ শত লোককে অকাতরে অকুণ্ঠিত চিত্তে অন্নদান করিতেছেন।’ ভগবতী অন্নপূর্ণা অন্নদাদায়িনী অন্নদান করছেন— এটা কি একটা সংবাদ! এটাই তো তাঁর স্ব-ভাব।
ভগবতী দেবী অসম সাহসীও ছিলেন। এই দান-ধ্যান থেকে দুর্বৃত্তদের ধারণা হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্রের বাড়িতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমা থাকে। একরাতে চোরের দল সেই লোভে বাড়িতে হানা দিল। আসলে তখন বাড়িতে বেশ কিছু গয়না রাখা ছিল— ঈশানের বিয়ের জন্যে গয়নাগাটি রাখা ছিল একটা পুঁটলিতে। বাড়ির পুরুষ মানুষেরা সব খিড়কির দরজা দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পিটটান দিয়েছেন ততক্ষণে। আর ভগবতী দেবী কী ঘটতে পারে তা না ভেবেই ডাকাত-পড়া বাড়িতে চুপিসারে ঢুকে গয়নার পুঁটলি নিয়ে পেট-আঁচলে ভরে পগারপার। আঁচ পেল না কেউ— না বাড়ির লোক, না চোরবাবাজিরা।
এমনই এক আগুনে রাতে বিদ্যাসাগরের গ্রামের বাড়িতে কেউ বা কারা আগুন লাগিয়ে দেয়। সেদিন বিদ্যাসাগর বাড়িতে ছিলেন না। অন্যেরা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেছেন। হঠাৎ ভগবতী দেবীর খেয়াল হল— তাঁর কোলের ছেলে ভূতনাথ ঘরে শুয়ে আছে। মা ভগবতী যেন দশভুজা— একটা বড় কাঁথাকে জলে ভিজিয়ে নিজের অঙ্গবস্ত্রও জলে ভিজিয়ে ঘুমন্ত ছেলেকে কাঁথায় জড়িয়ে তো নিলেনই— গয়নার বাক্সটাকেও নিয়ে আসতে ভুললেন না। বাড়ির থালা-বাসন সব পুড়ে গিয়েছিল— বেঁচে গিয়েছিল তাঁর নাড়ি-ছেঁড়া ধন।
আবার অতিথিপরায়ণা ভগবতী দেবীর জাত-বিচার যে ছিল না— তা তো দেখেছিই— নিষিদ্ধ মাংস ভোজনকারী ইংরেজদের সম্বন্ধেও তাঁর কোনও বাছ-বিচার ছিল না। সেটা ছিল ১৮৬৮ সালের ঘটনা। কলকাতায় তখন ইনকাম ট্যাক্সের কমিশনার হিসেবে এসেছেন হ্যারিসন সাহেব— বিদ্যাসাগরের সঙ্গে খুব দোস্তি। মাকে এসে বললেন, মা হ্যারিসন সাহেবকে নেমন্তন্ন করেছি আমাদের বাড়িতে আসতে— আনব মা তাঁকে। ভগবতী দেবী বললেন, সে কী কথা রে? অতিথি নারায়ণ— নিয়ে আয় তাঁকে। রান্নাঘরে গিয়ে কত যত্ন করে পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করে সাহেবকে সামনে বসিয়ে খাওয়ালেন। সাহেব তো একেবারে থ। এমন হিন্দু মহিলাও সংসারে আছেন। কথা প্রসঙ্গে সাহেব জিজ্ঞেস করলেন— মাদার, তোমাদের অনেক ধন আছে— তাই না? ভগবতী তাঁর ছেলেকে দেখিয়ে বললেন— এরাই আমার ধন-সম্পত্তি। সাহেবের আবার অবাক হবার পালা।
এই সুযোগটা বৃথায় যেতে দিলেন না তেজস্বিনী দয়াবতী।
সাহেবকে বললেন, তুমি এত বড় অফিসার। কত বড় দায়িত্ব নিয়ে আমাদের মেদিনীপুর জেলায় এসেছ। দুঃখীরা যাতে কষ্ট না পায়, তাদের যাতে কোনও খেতি-লোকসান না হয়— তা কিন্তু বাবা তোমাকে দেখতে হবে। তুমি চলে গেলেও লোকে যেন তাতে ‘হায় হায়’ করে। সাহেব বিদ্যাসাগরের দিকে তাকিয়ে বললেন— এমন মা না হলে কি এমন ছেলে হয়!
ভগবতী দেবী উজাড় করে দিতে পারেন, কিন্তু মাঝে মাঝেই স্বামীর সঙ্গে খুনসুটি বাধে। তখন ভগবতী রেগে গিয়ে ঘরে ঢুকে আগল দিয়ে বসেন। ঠাকুরদাস জানতেন ভগবতী বড় মাছ কাটতে-রাঁধতে-খাওয়াতে খুব ভালোবাসেন। তাই গোঁসাঘরের আগল-খোলাবার জন্যে পুকুর থেকে বড় সাইজের মাছ ধরিয়ে এনে উঠোনে ফেলে দিয়ে বলতেন— কই কোথায় কে আছ গো— মাছটা কেটে দাও তো।
অমনি খুট করে দরজা খুলে যেত আঁচলটা গাছ-কোমর করে বেঁধে বসে গেলেন মস্ত বঁটিখান নিয়ে মাছ কাটতে। জীবনীকারেরা কেউ একথা অবিশ্যি লিখে যাননি— তবুও সেই দৃশ্যটা উপস্থিত সকলের নজর এড়িয়ে যায়নি— ঠাকুরদাস কাছে গিয়ে ঘোমটাকে তুলে একবার স্ত্রীর রাগ থেকে অনুরাগ মাখা শ্রীমুখ কেমন করে দেখেছিলেন এবং ভগবতী দেবী বঁটি নিয়ে তাড়া করেছিলেন— তবে রে মিনসে! ১৭৩৫ শকের (১৮১৩ খ্রিস্টাব্দ) একটা দিনে ঘর আলো করে ভগবতী দেবী শ্বশুরের সংসারে পা দিয়েছিলেন। সেটা ছিল বাংলার ১২২০ সাল। ৫৭ বছর পরে ১২৭৭ সালের চৈত্র সংক্রান্তির দিন সেই ঘর থেকে অনেক দূরে আঁধারে ঢেকে দিয়ে ভগবতী চলে গেলেন প্রবল বিসূচিকার আক্রমণে। কাশীধামে অসুস্থ ঠাকুরদাসকে দেখতে এসে তাকে সুস্থ করে নিজেই পড়লেন কলেরার আক্রমণে। স্বামীর পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে ভগবতী যে কোন দানের রাজ্যে চলে গেলেন— কে জানে? এই হতদরিদ্রের দেশে একটা ভগবতীর যে এখনই বড় দরকার।
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল