কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সূচনা। ব্যবসায়ীদের উন্নতির আশা রয়েছে। বিদ্যার্থীদের সাফল্যযোগ আছে। আত্মীয়দের সঙ্গে মনোমালিন্য দেখা দেবে। ... বিশদ
নিজে যেমন খেতে ভালোবাসতেন, তেমনই লোককে খাওয়াতেও ভালোবাসতেন খুব। তাঁর একটা বাতিক ছিল। যখন তখন লোকজনদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করে বসতেন। আর সেটা নীলিমাদেবী জানতে পারতেন একদম শেষ মিনিটে। কোনওদিন সেভাবে বাইরে ঘুরতে না গেলেও পরিবারকে নিয়ে রেস্তরাঁয় খেতে যেতেন ভানু। গড়িয়াহাটের ‘নিরালা’য় বা ‘কোয়ালিটি’তে। বসুশ্রীর মালিক মন্টু বসুর পরিবারের সঙ্গে ভানুর পরিবারের দারুণ হৃদ্যতা ছিল। ফলে সবাই মিলে খেতে যাওয়া লেগেই থাকত।
আর ভালোবাসতেন গান। নীলিমাদেবীর গলায় প্রায়ই শুনতে চাইতেন ‘বাঁশি বাজাব কবে’। শচীনকর্তার পল্লিগীতি হলে তো কথাই নেই।
শচীনকর্তা ছাড়া ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আরও এক গায়ক। সুধীরলাল চক্রবর্তী। রাসবিহারীর মোড়ে অমৃতায়ন রেস্টুরেন্ট ছিল ভানু ও তাঁর বন্ধুদের আড্ডাস্থল। সেখানে অমূল্য সান্যাল, রসরাজ চক্রবর্তী, মাউথ অর্গান শিল্পী প্রফুল্ল চক্রবর্তীরা আড্ডা মারতেন। খাওয়াদাওয়া চলত। আর ছিল লেক মার্কেটে ‘রাধুর চায়ের দোকান’। সুধীরলাল এখানেই থাকতেন। ভানুর সঙ্গে সুধীরলালের আলাপ করিয়ে দেন এইচএমভির পবিত্র মিত্র। সুধীরলাল ভদ্রলোকটি ছিলেন খুব আমুদে। একবার ‘হিন্দুস্তান’ রেকর্ড-এ সুধীরলালের সঙ্গে গিয়েছেন ভানুও। পাশে এসে বসলেন ভারতের আধুনিক সঙ্গীতের পিতৃপ্রতীম পঙ্কজ মল্লিক। কিন্তু পঙ্কজ ও সুধীরলালের কথা নেই। দু’জনে দু’দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে। হঠাৎ পঙ্কজ মল্লিক সিট ছেড়ে উঠে সুধীরলালের হাত ধরে বললেন,‘বাঃ, সুধীরভাই কী গানটাই না গাইলেন। মধুর আমার মায়ের হাসি ভারতীয় সঙ্গীতের সম্পদ।’ সুধীরলাল বললেন, ‘আপনি যে আমাকে চিনতে পেরেছেন এতেই আমি উল্লসিত।’ এরপর পঙ্কজ মল্লিক চলে যেতেই ভানুকে সুধীরলাল বললেন, ‘মধুর আমার’ গানটি যেই হিট হয়েছে অমনি নিজে এসে কথা বললেন। অথচ কয়েকদিন আগেই এক ফাংশনে আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন।’
এই সুধীরলালের কাছেই রোজ গান শিখতে আসতেন শ্যামল মিত্র, গায়ত্রী বোস, উৎপলা সেন, গীতা বর্ধনরা। রাধুর চায়ের দোকান তাই ফাংশন অর্গানাইজারদের কাছে ছিল মোক্ষলাভের জায়গা। কেন না, একাধারে সুধীরলালের মতো বড় গায়ককে হাতের নাগালে পাওয়া, আবার কমিকের জন্য ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, মাউথ অর্গান বাজিয়ে প্রফুল্ল চক্রবর্তীরও দেখা মিলত। এতগুলো আর্টিস্ট একসঙ্গে পাওয়া যায় বলে সুধীরলালের বাড়িতে কিম্বা রাধুর চায়ের দোকানেই অনেক জলসার কনট্রাক্ট সই হতো। অনেকসময় বিনা পয়সাতেও ফাংশন করতে হতো। এই ধরনের ফাংশনকে বলা হতো ‘আক্ষেপ’। মানে টাকাপয়সার কোনও বালাই নেই, অনুরোধই সম্বল। আর সুধীরলালের ছিল খুব গাড়ি চড়ার শখ। যদিও নিজের গাড়ি ছিল না। আসলে পঙ্কজ মল্লিক, রাই বড়াল, কাননদেবী ছাড়া সঙ্গীতজগতে তখন কারও গাড়ি ছিল না। একবার এক ভদ্রলোক পন্টিয়ার গাড়িতে সুধীরলাল আর ভানুকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে ফাংশন করতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এদিকে, ফাংশন অর্গানাইজাররা ‘বিশেষ খাতির’-এর ব্যবস্থা করেননি। কিন্তু সুধীরলালকে মিথ্যা বলে যাচ্ছেন, এখনই ব্যবস্থা করছি। প্রায় আটটা নাগাদ হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে ভানুকে বললেন সুধীরলাল —‘চলুন বাড়ি যাই।’
ফাংশন পার্টি হই হই করে উঠল। —এই এক্ষুনি আপনাকে মঞ্চে তুলছি।
অবস্থা বেগতিক দেখে অর্গানাইজারদের একজন বললেন,‘এই এক্ষুনি আসছে, আপনি বসে পড়ুন। আপনার গান হয়ে গেলেই...’
সুধীরলালও হেঁয়ালি করে বললেন, ‘পাগল নাকি, আমার সুরা না হইলে সুরই বাইরইব না গলা দিয়া।’ এহেন সুধীরলাল ভানুকে খুব পছন্দ করতেন। উনি কখনই গান শেখাতে কারও বাড়ি যেতেন না। কিন্তু ভানুর খাতিরে নীলিমাদেবীকে বাড়ি গিয়ে গান শেখাতেন। সুধীরলালের সুরে হিন্দি গান ‘এক অমর বসন্ত কী ছায়া’ রেকর্ড করার কথা ছিল নীলিমাদেবীর। পরে অবশ্য গানটি রেকর্ড করেন উৎপলা সেন।
একবার এই ভানুই সুধীরলালের রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। সেইসময় রেগুলার পাড়া, অফিসে থিয়েটার, ফাংশন করে বেড়াচ্ছেন ভানু। সিনেমাতে অভিনয় চলছে টুকটাক। একটু আধটু নামটামও হয়েছে। সুধীরলালের তখন বেশ নামডাক। এই সময় লেকমার্কেটের মস্তানরা সুধীরলালের ওপর জোর-জুলুম শুরু করল। তখন বন্ধু নির্মল চক্রবর্তী, রুনু বোসদের নিয়ে সুধীরলালের প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করেন এই ভানুই। আসলে অন্যায় কখনও বরদাস্ত করেননি।
জোরজুলুম করলে তো ভয়ানক রেগে যেতেন। ১৯৫২-’৫৩ সালের ঘটনা। তখন বামনেতা রাম চট্টোপাধ্যায়ের খুব দাপট। মার্ক্সবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক দলের সর্বেসর্বা এই নেতা রাজ্যের মন্ত্রীও হয়েছিলেন পরবর্তীকালে। মাসলম্যান বলে তাঁর কুখ্যাতিও ছিল। সেই রাম চট্টোপাধ্যায়ের কিছু চ্যালাচামুণ্ডা একদিন এসে ভানুকে বলল, অমুকদিন রামদার ফাংশন, সময়মতো পৌঁছে যাবেন। ভানু তো অবাক — কে আপনাগো রামদা? হে কইলেই আমারে যাইতে হইব নাকি!
চ্যালাদের তো একথা শুনে প্রায় ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। — সে কী মশাই! রামদা কে জিজ্ঞেস করছেন। ওর নাম শুনলে লোকে বাপ বাপ করে দৌড়য়। শুনুন ভালো কথায় গেলে ভালো, নইলে তুলে নিয়ে যাব।
ভানুর মাথায় যেন আগুন চাপল। বলে উঠলেন, ‘নিয়া যাইতে পার, তবে আমার লাশ। জ্যান্ত অবস্থায় নিতে পারবা না। যাও গিয়া কও তোমাগো বাপেরে।’
ছেলেরা ফিরে গিয়ে ঘটনাটা সবিস্তারে বলল রাম চট্টোপাধ্যায়কে। তিনি শুনেই বললেন, করেছিস কী! ওঁকে খেপিয়ে এসেছিস, আর তো আসবেনই না। কদিন পর দলবল নিয়ে নিজেই হাজির হলেন ভানুর বাড়ি। তবে এবার আর হুমকি নয়, একেবারে অনুরোধে চলে গেলেন নেতামশাই।
বললেন, ‘ভাই কিছু মনে কোরো না। ওদের ভুল হয়েছে, ক্ষমা করে দাও। তুমি একবার ফাংশনে এসে দাঁড়িও। নইলে আমার প্রেস্টিজ থাকে না।’
(ক্রমশ)
ছবিতে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
অনুচিত্রণ :ভাস্কর মুখোপাধ্যায়
অলংকরণ: চন্দন পাল