নতুন কোনও কর্ম পরিকল্পনায় সাফল্যের ইঙ্গিত। লটারি বা ফাটকায় প্রাপ্তি যোগ। খেলাধূলায় কৃতিত্ব। বাক্যে ও ... বিশদ
‘মরণ রে,
তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান ।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট,
রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু-অমৃত করে দান ।
তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান ...।।’
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন নিখুঁত শরীরে পৃথিবীকে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে। অস্ত্রোপচারে তাঁর প্রবল আপত্তি ছিল। ডাঃ নীলরতন সরকারও তাঁর পক্ষে ছিলেন। ডাঃ সরকার অন্য চিকিৎসকদের বলেছিলেন, ‘দেখুন, রবীন্দ্রনাথকে সাধারণ রোগীর মতো দেখবেন না। তাঁর স্নায়ু, তাঁর শিরা উপশিরা দৈহিক গঠন সবই অসাধারণ। আমাদের ডাক্তারি শাস্ত্রের নির্দেশ রবীন্দ্রনাথের মতো মহাপুরুষের দেহের পক্ষে প্রযোজ্য নাও হতে পারে।’
কবিও চাননি তাঁর অপারেশন করা হোক। অপারেশন হয়েছিল তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তিনি বার বার, হাজার বার বলেছিলেন, ‘শরীরে খুঁত নিয়ে মরতে চাই না। বয়স হয়েছে, বিদায় নেবোই তো, স্বাভাবিকভাবেই সব শেষ হোক, কাঁটা ছেঁড়া কেন?’
তবু অপারেশন হল! ডাক্তার ললিতমোহন ব্যানার্জি কবির অপারেশন করলেন। আর সত্যি হল রবীন্দ্রনাথের কথা। অপারেশনের প্রবল ধকল সহ্য করতে পারল না তাঁর শরীর। কবির প্রিয় ঋতু ছিল বর্ষাকাল, আর তাঁর তিরোধানের দিনটি ছিল বাইশে শ্রাবণ।
পালঙ্কে শুয়ে আছেন আচ্ছন্ন রবীন্দ্রনাথ। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তাঁর পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ছিলেন ডাঃ জ্যোতিষ রায়। সেইসময়, শেষ মুহূর্তে পরিবারের কেউ একজন তাঁর কানের কাছে মুখটি নিয়ে গিয়ে শোনাচ্ছেন ‘শান্তম অদ্বৈতম’ মন্ত্র, তার পাশাপাশি চলছে অবিরাম ব্রহ্মসঙ্গীত। আর এর মাঝেই ডাঃ জ্যোতিষ রায় কবির নাড়ি টিপে ঘোষণা করলেন — ‘সব শেষ’। জীবনের হাত ছেড়ে চিরতরে বিদায় নিলেন আমাদের প্রাণের কবি, মননের কবি, এই পৃথিবীর কবি— বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
পরলোকচর্চায় প্রবল ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তাঁর মৃত্যুর কয়েকবছর পরে তিনি এলেন রাজেন্দ্রলাল আচার্যের পরলোক চর্চার আসরে। ২৮ অগ্রহায়ণ ১৩৫৩ বঙ্গাব্দের ‘দৈনিক মাতৃভূমি’ পত্রিকায় রাজেন্দ্রলাল আচার্য সম্পর্কে প্রতিবেদক লিখছেন,‘রাজেন্দ্রলাল আচার্য বাবু ইতঃপূর্ব্বে— বিশেষ ‘বাঙ্গালীর বল ও বাঙ্গালীর ধর্মগুরু’ নামক ২য় খণ্ডের পুস্তক প্রকাশ করিয়া বঙ্গ সাহিত্যে পরিচিত হইয়াছেন।’ অতএব এটা ধরে নেওয়া যেতে পারেই যে তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পরিচয় ছিল।
দিনটি ছিল ২৩ ডিসেম্বর ১৯৪৫ সাল। রাজেন্দ্রলাল আচার্য তাঁর ‘মৃত্যুর পরপারে’ গ্রন্থে কবির সঙ্গে তাঁর একান্ত আলাপচারিতার কথা খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখছেন, কবিকে আমি অনুরোধ করে বললাম, আমি একটা বই লিখছি, সেই বইয়ের জন্য আপনার মহাযাত্রার বর্ণনাটি লিখে নিতে চাই।
কবি বললেন, তা বেশ লিখে নাও। কবি বলতে থাকলেন, আর আমিও শুরু করলাম লেখা— আমি কলকাতায় যখন দেহত্যাগ করলুম, তখন দেখলুম যে দেহ থেকে একটা সাদা কুয়াশা যেন বেরিয়ে এল। আমার সেই পরিত্যক্ত দেহ ঘিরে আমার আত্মীয়-পরিজনরা তখন কাঁদছে। আমি তাদের বলার চেষ্টা করলুম, আমি মরিনি, এই তো আমি তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তারা আমার কোনও কথাই শুনতে পেল না, কাঁদতেই থাকল। তাদের জন্য আমার সেইসময় বড়ই কষ্ট হচ্ছিল। তাই তাদের কথা ভেবে আবার আমি চেষ্টা করলুম আমার সেই পরিত্যক্ত দেহে প্রবেশ করবার। বার বার চেষ্টা করলুম, কিন্তু পারলুম না। সে সময় আমার চেহারাটা ছিল ধোঁয়ার মতো। হাত-পা সবই তখন আমার ছিল, তবে সবটাই ধোঁয়া দিয়ে যেন তৈরি। তখনও পর্যন্ত আমি বুঝতে পারিনি যে আমার মৃত্যু হয়েছে।
যখন আর পরিত্যক্ত শরীরে ফেরা গেল না তখন আমি একটু বিরক্তই হয়ে পড়লাম। আর এমন সময় দেখলাম আমার চারপাশে কয়েকজন মানুষ এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দুজনের শরীর থেকে জ্যোতি বেরচ্ছিল। তাঁদেরই একজন আমাকে মধুর কণ্ঠে হাসতে হাসতে বললেন, কবি আপনি তো আর বেঁচে নেই, আপনার মৃত্যু হয়েছে।
আমি বললুম, কখন আমার মৃত্যু হল!
তিনি হাসতে হাসতে বললেন, আমাদের সঙ্গে এবার চলুন, সত্যিই আপনার মৃত্যু হয়েছে। এখানে থেকে কোনও লাভ নেই। বৃথাই কষ্ট পাবেন।
আমি বললাম, আমায় কোথায় নিয়ে যাবেন?
তিনি বললেন, চলুন কোনও ভয় নেই। আপনার জন্য যে স্থান নির্দিষ্ট আছে, আমরা আপনাকে সেখানেই নিয়ে যাব।
বললাম, চলুন তাহলে।
শুরু হল আমাদের পথ চলা। তাঁরা আমাকে এক ঘন কুয়াশাপূর্ণ স্থান দিয়ে নিয়ে চললেন সামনের দিকে। দীর্ঘ সে যাত্রা। একসময় আমি তাঁদের বললাম, দেখুন আমার শরীর বড়ই অবসন্ন হয়ে পড়েছে। আর যে আমি হাঁটতে পারছি না।
তখন তাঁদের মধ্যে থেকে একজন বললেন, আর আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। এই কুয়াশাচ্ছন্ন পথের শেষ হবে সামনে। ওই দেখুন সামনেই আলো দেখা যাচ্ছে। আর একটু কষ্ট করুন।
আমি খুব ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলুম। একটুখানি গিয়েই দেখি চারিদিকে বেশ আলো জ্বলছে— যেন চাঁদের আলো— কিংবা তার চেয়েও যেন জোর আলো।
আমি তাঁদের বললুম, আমি তো আর চলতে পারছি না। এইখানে একটু জিরিয়ে নিই। এই বলে সেখানেই বসে পড়লুম এবং পরক্ষণেই শুয়ে পড়লুম সেই ভূমির ওপর। শুতে শুতেই এমন ঘুম এল যে আর কিছুই জানি না। কদিন ঘুমিয়ে ছিলুম তা বলতে পারব না। একদিন আমার ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার পিতা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে দেখে আমি তাড়াতাড়ি উঠে প্রণাম করলাম। তিনি বললেন, রবি, ভয় নেই, আয় আমার সঙ্গে। আমি তোকে নিতে এসেছি।
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলুম, সত্যিই কি আমি মারা গিয়েছি?
তিনি হেসে বললেন, সত্যিই তুই মারা গিয়েছিস রবি। এখন তোর নতুন জীবন আরম্ভ হয়েছে। এ শুধু ও-পার আর এ-পার। এরই নাম মৃত্যু।
আমি বললাম, এর জন্য তবে মানুষের এত ভয় কীসের?
তিনি বললেন, কিছু ভয় নেই। লোকে জানে না তাই ভয়ে মরে। চল না দেখবি চল।
বাবার পাশাপাশি আমিও হাঁটতে শুরু করলাম।
মৃত্যুর প্রবল হানাদারিতে কবির জীবন থেকে নানাসময়ে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন তাঁর বহু প্রিয়জন। তাই বোধহয় মৃত্যুকে তিনি আর ভয় পেতেন না। বরঞ্চ ভালোবাসতেন, গভীর মমত্ববোধ ছিল মরণের প্রতি। তাই তিনি মৃত্যুর উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন এই অনবদ্য কবিতাটি—
‘মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর। আজি তার তরে
ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে।
সংসারে বিদায় দিতে, আঁখি ছলছলি
জীবন আঁকড়ি ধরি আপনার বলি
দুই ভুজে।
ওরে মূঢ়, জীবন সংসার
কে করিয়া রেখেছিল এত আপনার
জনম-মুহূর্ত হতে তোমার অজ্ঞাতে,
তোমার ইচ্ছার পূর্বে? মৃত্যুর প্রভাতে
সেই অচেনার মুখ হেরিবি আবার
মুহূর্তে চেনার মতো। জীবন আমার
এত ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়,
মৃত্যুরে এমনি ভালো বাসিব নিশ্চয়।
স্তন হতে তুলে নিলে কাঁদে শিশু ডরে,
মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে।’
(ক্রমশ)
অলংকরণ: চন্দন পাল