ছায়া আছে কায়া নেই
অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
সুকুমার রায়। শিশুসাহিত্যিক ও ভারতীয় সাহিত্যে ‘ননসেন্স রাইম’-এর প্রবর্তক। তিনি একাধারে লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও সম্পাদক। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পুত্র। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। বলতেন আমার যুবক বন্ধু।
সেই সুকুমার রায় আজ মৃত্যুশয্যায়। কালাজ্বরে আক্রান্ত । যুবক বন্ধুর অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে কবি শান্তিনিকেতন থেকে তাঁকে দেখতে চলে এলেন কলকাতায়। সুকুমার রায়ের অনুরোধে তিনি সেদিন গেয়েছিলেন দুখানি গান — ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু এবং দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো
গভীর শান্তি এ যে,
আমার সকল ছাড়িয়ে গিয়ে
উঠল কোথায় বেজে।
ছাড়িয়ে গৃহ, ছাড়িয়ে আরাম, ছাড়িয়ে আপনারে
সাথে করে নিল আমায় জন্মমরণপারে
এল পথিক সেজে।
দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো
গভীর শান্তি এ যে।
চরণে তার নিখিল ভুবন নীরব গগনেতে
আলো-আঁধার আঁচলখানি আসন দিল পেতে।
এত কালের ভয় ভাবনা কোথায় যে যায় সরে,
ভালোমন্দ ভাঙাচোরা আলোয় ওঠে ভরে,
কালিমা যায় মেজে।
দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো
গভীর শান্তি এ যে।’— শেষের এই গানটি রোগীর অনুরোধে কবিকে সেদিন দুবার গাইতে হয়েছিল।
কবি শান্তিনিকেতনে উপাসনায় বললেন,‘ আমার পরম স্নেহভাজন যুবক বন্ধু সুকুমার রায়ের রোগশয্যার পাশে এসে যখন বসেছি, এই কথাই বার বার আমার মনে হয়েছে, জীবলোকের উর্ধ্বে অধ্যাত্মলোক আছে। যে কোনও মানুষ এই কথাটি নিঃসংশয় বিশ্বাসের দ্বারা নিজের জীবনে স্পষ্ট করে তোলেন,অমৃতধামের তীর্থযাত্রায় তিনি আমাদের নেতা। আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি, কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মতো অল্পকালের আয়ু নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্যদান করতে প্রায় আর কাউকে দেখিনি। মৃত্যুর দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে অসীম জীবনের জয়গান তিনি গাইলেন। তাঁর রোগ শয্যার পাশে বসে সেই গানের সুরটিতে আমার চিত্ত পূর্ণ হয়েছে।’
চলে গেলেন সুকুমার রায়। তিনি আবার ফিরবেন ছ’বছর বাদে, বৃদ্ধ বন্ধুর আহ্বানে পরলোক চর্চার আসরে। তিনি কবিকে সেদিন বলবেন, আচ্ছা, আমার ছেলেকে আপনার আশ্রমে নিতে পারেন?
উত্তরে কবি বলেন, তোমার স্ত্রী যদি সম্মত হন।
—তাঁকেও বলুন না।
কবি বললেন, তাকে পেলে আমিও খুশি হব।
প্রয়াত সুকুমার রায়ের সঙ্গে কথা বলার কিছুদিন বাদে কলকাতায় এসে কবি কথা বললেন সুপ্রভা রায়ের সঙ্গে। সুকুমার রায়ের স্ত্রী, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক, শিল্পী, লেখক, সুরকার ও সম্পাদক সত্যজিৎ রায়ের মা সুপ্রভা দেবীও অসম্ভব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। কবির মুখে মৃত স্বামীর অনুরোধ শুনে তিনি বললেন আমার ছেলের বয়স এখন মাত্র আট। এই মুহূর্তে আমি তাকে ছাড়তে পারব না। কিন্তু একটু বড় হলে অবশ্যই আপনার আশ্রমে তাকে পাঠাব। কথা রেখেছিলেন সুপ্রভা দেবী। ১৯৩৯ সালে শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন সুকুমার-সুপ্রভা রায়ের পুত্র সত্যজিৎ রায়।
সেদিন কবির সঙ্গে তাঁর যুবক বন্ধুর নানা বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল, তিনি প্রথমেই আহ্বান জানিয়েছিলেন সুকুমার রায়কে, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর মিডিয়ামের অস্থিরতা দেখে কবি জানতে চেয়েছিলেন তুমি এসেছ?
—এসেছি।
সুকুমার কেমন আছ তুমি?
—অন্য কথা বলুন।
তোমার পৃথিবীর সঙ্গে এখনও যোগ আছে?
—আছে, খুব।
আমাদের এখানকার রচনার কাজ, অন্য কাজ— তাতে তোমার মন আছে?
—আছে বৈকি— এখনও তো তাই নিয়েই আছি।
তোমার এখানকার রচনার প্রতি অনুরক্তি আছে?
—রচনা তো কাগজে হয় না, মনের মধ্যে আছে।
আমাদের কাউকে অবলম্বন করে করতে পার রচনা?
—শক্ত। কার হাতে?
বুলার হাত দিয়ে ছবি আঁকো কিংবা লেখ।
—বড় শক্তির প্রয়োজন। আমার ভাব যেন এক সৃষ্টি ও বিনাশের মাঝখান দিয়ে চলেছে।
আমাদের কাছে কিছু বলবার আছে?
—আছে। বলুন আপনি, কতদিন, কতদিন আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন।
ধর্মবিশ্বাসে পরিবর্তন হয়েছে?
—শুনুন, আমি যেন কী মহান আলোকের মধ্যে রয়েছি। আমার চোখ সেই আলোয় ডুবতে চায়। কিন্তু আমার মনের মধ্যে কী অন্ধকার—
আলো মনকে আশ্রয় করে, না দেহকে?
—আমার মন এখন সর্বস্ব। আমার মন—।
ওটা আর একবার বল।
—আমাদের মনকে পূর্ণ করতে পারলে, অর্থাৎ দেবতাকে...কিন্তু আমার ধর্ম বিশ্বাস আলাদা।
আমার নিজের ধর্মবিশ্বাস সম্বন্ধে একটা লেকচার (হিবার্ট লেকচারের ‘রিলিজিয়ন অব ম্যান’) লিখেছি, জান?
—সে ঠিকই করেছেন। আমার মন ওই চায়।
আমাদের সাধনায় সাহায্য করতে পার?
—সাধনায়?
আমরা যেটা ইচ্ছা করি, কামনা aspire করি, তাতে সহায়তা করতে পার?
—আপনাকে আমার দরকার। আমার নিজের সাধনা আজও শেষ হল না।
ব্রাহ্মসমাজ সম্বন্ধে কিছু বলবে?
—কিছু না।
ব্রাহ্মসমাজের ওপর শ্রদ্ধা আছে?
—না, ওপথ ঠিক নয়।
ব্যক্তিগত সাধনা, এই তোমার বলবার কথা?
—হ্যাঁ, কতকটা তাই।
প্রশান্ত (মহালানবীশ) এখন যে কাজে নিযুক্ত, তাকে তুমি অনুসরণ করছ?
—সমস্তই।
এই পথে সে সার্থকতা লাভ করবে?
—যখন এলাম, মনে হল পৃথিবীতে আমার মনের ধারা পূর্ণ বিকাশের পথে চলেছে।
রানির আরোগ্য?
—বলতে পারি না।
আমি যে ছবি আঁকি, সে কি ভালো?
—হ্যাঁ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, অপূর্ব।
ইউরোপে তার সমাদর হবে?
—হবে।
দীর্ঘ কথোপকথন। ফেরার বেলায় সুকুমার রায় আবার শুনতে চাইলেন কবিতা বা গান। কবি কবিতা নয় , গাইলেন গান—
‘তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়
কোনখানে রে কোন পাষাণের ঘায়।।
নবীন তরী নতুন চলে
দিইনি পাড়ি অগাধ জলে
বাহি তারে খেলার ছলে
কিনার কিনারায়...।’
(ক্রমশ)
অলংকরণ: চন্দন পাল
29th September, 2019