বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
অতি কর্কশ কণ্ঠে নিত্যরঞ্জন বলে উঠলেন, আলোটা কমান। আমার বড় কষ্ট হচ্ছে।
প্যারীচাঁদ মিত্র তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে সেজবাতিটা একদম কমিয়ে দিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে এসে বললেন, বলুন আপনার কথা।
নিত্যরঞ্জন কর্কশ স্বরে বললেন, আমার নাম ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়। আমার বাড়ি ছিল যশোরে। পাঁচ হাজার টাকার লোভে কয়েকজন দুষ্কৃতী আমাকে নৃশংসভাবে খুন করে। তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে আর আমার খোওয়া যাওয়া টাকা উদ্ধারের জন্যই আমি পৃথিবীর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পাঁচ হাজার টাকাটা খুনিরা এই চার্চ লেনের কাছেই হেয়ার স্ট্রিটের একটা বাড়িতে পুঁতে রেখেছিল। তাই আমি এই অঞ্চলেই বেশি ঘোরাঘুরি করি।
পরবর্তীকালে প্যারীচাঁদ মিত্র সেদিনের সেই সন্ধ্যার রোমাহর্ষক বর্ণনা ভাবীকালের জন্য লিখে রেখে গেছেন। তিনি লিখছেন, ‘ভোলানাথ মুখার্জির অশরীরী আত্মা নিত্যরঞ্জন ঘোষের মাধ্যমে তার জীবনকাহিনী বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল। আবার বলল— এখানে থাকতে আমার আর ভালো লাগছে না— এই স্তরের বেশির ভাগই আমার মত খুন হওয়া কিম্বা গলায় দড়ি দেওয়া সব বিক্ষুব্ধ এবং অভিশপ্ত আত্মা— অন্ধকার ঘরে তার কথাগুলো কেমন কাতর কান্নার মতো শোনাল। আবার বলল, আমার স্ত্রী আমার বছর দুয়েক আগে মারা গিয়েছে। সে দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি তার ধর্মে-কর্মে খুব মতি ছিল। ফলে তার আত্মা থাকে অনেক ওপরের স্তরে। সেইখান থেকে সে ক্রমাগত আমার জন্য প্রার্থনা করছে— হয়তো আমিও কিছুদিন বাদে ওপরের স্তরে তার কাছে চলে যেতে পারব। তবে সে সময় এখনও আসেনি। আমাকে আর কষ্ট দেবেন না— আমি এখন যাই। তার কথা শেষ হতে না হতে খোলা জানলা দিয়ে সাঁ সাঁ করে একটা দমকা বাতাস আছড়ে পড়ল ঘরে। আর সেই নিমগাছটা প্রবল বেগে আন্দোলিত হল। মিডিয়াম নিত্যরঞ্জন ঘোষ লুটিয়ে পড়লেন মেঝের ওপর।’
আর একদিনের কথা। সেদিন চক্রের বৈঠক বসেছে পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে। মিডিয়াম নিত্যরঞ্জনের মাধ্যমে সেদিন যাঁর আত্মা ওই চক্রে এসেছিলেন তাঁর নাম দেবেন্দ্রনাথ তর্করত্ন।
প্যারীচাঁদ মিত্রের প্রশ্নের উত্তরে দেবেন্দ্রনাথের আত্মা মিডিয়ামের মাধ্যমে কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, আমার বাড়ি ছিল ব্যারাকপুরে। মাত্র ছ’বছর তিন মাস আগে আমার মৃত্যু হয়।
রাজকৃষ্ণ মিত্র এইসময় জানতে চাইলেন, আপনি এখন কোন স্তরে আছেন?
উত্তরে দেবেন্দ্রনাথ বললেন, আমি এখন যে দ্বিতীয় স্তর থেকে আসছি সেখানকার প্রতিটি আত্মাই পবিত্র আত্মা। সেখানে আমরা সর্বদাই সেই আনন্দময়ের কথা চিন্তা করি এবং তাঁর কথা ভেবেই আমরা মোহিত হয়ে থাকি।
এতক্ষণ চুপ করে বসে রাজকৃষ্ণ মন দিয়ে দেবেন্দ্রনাথের কথা শুনছিলেন। তিনি এবার মুখ খুললেন, বললেন, মহাশয়, আপনি চিরকালই কী এইরকম ঈশ্বরবিশ্বাসী!
এতক্ষণে দুই চক্ষু মুদে, মাথাটা মাটির দিকে ঝুলিয়ে বসেছিলেন নিত্যরঞ্জন। ডাক্তার মিত্রের প্রশ্ন শুনে মিডিয়াম নিত্যরঞ্জন মাথা তুলে তাকালেন তাঁর দিকে। তারপর বললেন, কৈশোর কাল থেকে দেবদ্বিজে আমার খুব ভক্তি ছিল। আমার বয়স যখন আঠারো তখন চাকরির খোঁজে লখনউ গিয়ে এক সন্ন্যাসীর দেখা পেয়েছিলাম। তাঁর কাছেই আমি ‘যোগ’ শিখি। কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার গুরুদেব আমায় বললেন, আমার যা ছিল সব কিছু আমি তোমাকে উজাড় করে দিয়েছি। এর বাইরে আমি আর তোমায় কিছুই দিতে পারব না। তবে তোমার আরও অনেক কিছু জানা ও শেখার বাকি আছে। তারজন্য তোমার উপযুক্ত গুরুর প্রয়োজন। এবার তুমি সেই গুরুর সন্ধানে বেরিয়ে পড়। তারপরই তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
গুরুদেবের আদেশে আমি আবার পথে নামলাম। চলে গেলাম বিন্ধ্যগিরিতে। সেখানে আমাকে কৃপা করলেন তিনজন সিদ্ধ যোগী। বেশ আনন্দেই কাটছিল তাঁদের সঙ্গে। কিন্তু এখানেই আমি একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লাম। কিছুদিন রোগভোগের পর বুঝতে পারলাম এবার আর সুস্থ হওয়ার আশা নেই। তারপর আমার জীবনে এল সেই অদ্ভুত সকালটি। আমার লখনউয়ের গুরুদেবের আবার দর্শন পেলাম। তিনি আমার রোগশয্যার পাশে বসে আমার ডান হাতখানি সস্নেহে ধরে বললেন, ভয় নেই আমি এসে গেছি, তোমাকে আজ এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে লোভ নেই, পাপ নেই। সত্যিই মৃত্যুর পরে এমন জায়গায় এলাম যেখানে পৃথিবীর মতো দিন নেই, রাত নেই। কিন্তু এমন একটা অপরূপ আলোয় চারিদিক ভরে থাকে যাতে মনে হয় যেন এখানে বুঝি অহরহ গোধূলি বিরাজ করছে। আপনাদেরও একদিন সেখানে আসতেই হবে। তবে আজ আর আপনাদের মিডিয়াম আমাকে ধরে রাখতে পারবেন না। এবার আমি যাব। কথা শেষ করেই মিডিয়াম নিত্যরঞ্জন নির্জীবের মতো বসে রইলেন।
কর্মজীবনে বহু সরকারি সংস্থার উচ্চপদে যুক্ত ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। প্রবল ব্যস্ততার মধ্যে তাঁর দিন কাটত। তবু তিনি নিয়মিত পরলোকচর্চা করতেন। বলা যেতে পারে, তিনি ওই জগৎটাকে অত্যন্ত ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তার প্রমাণ পাওয়া যাবে ২৯. ১২. ১৮৮১ সালের ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’-এ চোখ রাখলে। প্যারীচাঁদ মিত্র লিখছেন, ‘আমার স্ত্রীর পরলোকগমনের পর হইতে আমি আধ্যাত্মিকচর্চা করিয়া আসিতেছি। আমার জ্যেষ্ঠপুত্র অমৃতলাল আমাদের পারিবারিক চক্রে বসিয়া পরলোকগত নিজ জনদিগের আত্মার সহিত আলাপ করিয়া থাকেন। একদিন মিঃ এগ্লিন্টন আমাদের সহিত স্বতন্ত্রভাবে চক্রে বসিয়াছিলেন।’
তবে প্যারীচাঁদের প্রয়াণের পর মিত্রবাড়ির প্রেতচর্চা চালু ছিল কিনা সে খবর আমরা কেউই জানি না!