কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। যোগাযোগ রক্ষা করে চললে কর্মলাভের সম্ভাবনা। ব্যবসা শুরু করলে ভালোই হবে। উচ্চতর ... বিশদ
—‘এই তো, কি সুন্দর বউদি আর বুবুনকে নিয়ে মন্দারমণি থেকে ঘুরে এল।’
—‘সে, তোমার দাদা মস্ত অফিসার। হাজারটা ক্লায়েন্ট। কেউ পেট্রোল খরচ দিচ্ছে, তো কেউ হোটেল। তার সাথে কি আমার তুলনা চলে?’ চা শেষ করে আমি জুতো পরতে লাগলাম।
—‘খুব চলে। ইচ্ছে থাকলে সব হয়। অন্ততঃ কাছেপিঠে থেকেই একদিন ঘুরে আসি চলো। মেয়েটা এত বায়না করছে। সামনেই তো বড়দিন। চলো না গো।’
শেষের দিকটায় সুর কিছুটা নরম। অপর্ণা বুঝেশুনে সবরকমের টেকনিকই অ্যাপ্লাই করে, যেটা লেগে যায়। কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার মাত্র দেড় ঘণ্টার রাস্তা। আমরা সকাল ন’টার মধ্যেই ঢুকে পড়লাম। স্টেশন বাজার পেরিয়ে একটা রাস্তা পশ্চিম দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। আমি স্টিয়ারিং এ বসে অপর্ণাকে লক্ষ করছিলাম। দীর্ঘ দাবদাহের পর প্রথম বর্ষণে প্রকৃতি যেমন ঝলমলিয়ে ওঠে, ওকে দেখে অনেকটা সেরকমই মনে হচ্ছিল। মেয়ে পিছনের সিটে বসে মোবাইল গেম নিয়ে ব্যস্ত।
ছোট একটা কালভার্ট পড়ল। সেটা পেরিয়ে ডান হাতে একটা গার্লস স্কুল।
তারপর একটু এগিয়ে, সামনে একটা বাঁক নিয়ে গাড়িটা একটা ইট বাঁধানো রাস্তার সামনে এসে দাঁড়াল। বুঝলাম আর এগোনো যাবে না। পেঁজা মেঘের ফাঁক দিয়ে ঝকঝকে নীল আকাশ। বাতাসে একটা শিরশিরানি ভাব। ইটের রাস্তাটা সরু হয়ে এঁকেবেঁকে কিছু কৃষ্ণচূড়া গাছ আর টালির চালের বাড়ির মাঝখান দিয়ে যেন একদম নদীর বুকে নেমে গেছে। সামনে একটা বিশাল বটগাছ তার ডালপালা নিয়ে নদীটা আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। তার লম্বা ঝুরির ফাঁক দিয়ে দেখা যায় নদীর চরে দুটো নৌকা বাঁধা রয়েছে। সেখান থেকে একটু দূরে নদীর পাড় ধরে কিছুটা এগতেই সবুজ ঘাসে মোড়া একফালি জায়গা পাওয়া গেল। আমরা শতরঞ্চি পাতলাম। আজকে বড়দিন। আমাদের মতো অনেকেই এসে ভিড় জমাতে শুরু করেছে। অপর্ণা রাত জেগে লুচি আর আলুরদম বানিয়েছিল। ফ্লাস্কে চা-ও আছে। কতক্ষণ গরম থাকবে জানি না। ব্যাডমিন্টন খেলার সরঞ্জামও রয়েছে। মা মেয়ে দুজনেরই খেলার খুব শখ। আমি রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা এনেছি।
এখানে নদীটা বেশ চওড়া। একের পর এক ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। কিছুদূর এসেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। তারপর আরেকটা, আবার আরেকটা। কত যুগ ধরে যেন বয়ে চলেছে। বহু যুগের ওপার থেকে যেন বয়ে নিয়ে আসছে কোন বার্তা। কোন সুদূর অতীত যেন আজ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
২
হাফপ্যান্ট পরা ছেলেটা রোজ এখানটায় এসে দাঁড়ায়। দূর থেকে তাকিয়ে থাকে নৌকোগুলোর দিকে। মাঝিরা খুব সকালেই বেরিয়ে যায় মাছের সন্ধানে। দুপুরের দিকে আবার ফিরে আসে। নদীর চরে স্টোভ জ্বেলে চলে রান্নাবান্না। বেশ লাগে মাঝিদের এই সহজ-সরল আড়ম্বরহীন জীবন। আর ভালো লাগে শীতকালে শহর থেকে আসা মানুষদের ভিড় দেখতে। নদীর পাড়ে যেন মেলা লেগে যায়। কী সুন্দর পোশাক পরে থাকে ওরা। মাথায় খেজুরপাতার টুপি। ও খেজুরপাতার চরকা বানাতে পারে। দুটো খেজুরপাতা একটার মধ্যে আরেকটা ঢুকিয়ে প্রথমে চরকাটা বানিয়ে
নিতে হয়, তারপর মাঝখানে একটা খেজুরকাঁটা ফুটিয়ে আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে দিলেই চরকাটা বনবন করে ঘুরতে থাকে। তবে শীতকালের এই সময়টায় চরকা ঘুরিয়ে তেমন মজা পাওয়া যায় না। এই সময়ে নদীর ধারে একরকম বুনোফুল ফোটে। বোঁটা ভাঙলেই টুপটুপ করে আঠা বের হয়। একটা নারকেল পাতার শীষ পেঁচিয়ে সেই আঠাতে ডুবিয়ে ফুঁ দিলেই সারি সারি
বুদবুদ বেরিয়ে হাওয়ায় উড়তে থাকে। বুদবুদের পিছনে ধাওয়া করতে করতে ছেলেটা নদীর চরের দিকে নেমে এল।
নদীতে এখন ভাটা। অনেক দূর পর্যন্ত বালির চর দেখা যাচ্ছে। বালির ওপর রোদ পড়ে কেমন রুপোর পাতের মতন ঝিকমিক করছে। ওর বয়সি দু’তিনজন ব্যাডমিন্টন খেলছিল। ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে। এ খেলাটি তার চমৎকার লাগে। এতটাই আনমনা হয়ে গিয়েছিল যে কচুপাতায় রাখা আঠাটা কখন শুকিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি সে। হঠাৎ পায়ের কাছে ঝুপ করে ফেদারটা এসে পড়ল। জিনিসটা একবার ছুঁয়ে না দেখলেই নয়। ছেলেটা একটু ইতস্ততঃ করে ফেদারটা হাতে তুলে নিল। পরক্ষণেই তার মনে হল যে কাজটা বোধহয় ঠিক হয়নি। ও ধীর পায়ে এগিয়ে গেল ফেদারটা ফেরত দিতে। কিন্তু অধিকারভঙ্গের শাস্তি যে এতো
তাড়াতাড়ি মিলবে ও সেটা বুঝতেই পারেনি। ওদের মধ্যে একটা দস্যি মতন ছেলে এগিয়ে এসে প্রথমে ওর হাত থেকে ফেদারটা কেড়ে নিল, তারপর এক ধাক্কায় ওকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, ‘ফেদারে হাত দিলি কেন রে? গেঁয়ো ভূত।’
শরীরে যতটা না আঘাত লেগেছিল মনে লেগেছিল তারও বেশি। ও মাটি থেকে উঠে প্যান্টে ধুলো ঝাড়তে লাগল। চোখ মুখ অপমানে লাল। গালে কিছুটা মাটি লেগেছিল, কনুইটাও ছড়ে গিয়েছে। চোখ ফেটে জল আসতে চাইছিল কিন্তু এ পরিস্থিতিতে কান্না চলে না।
মায়ের চোখ থেকে অবশ্য কিছুই লুকোনো গেল না। ‘কি হয়েছে রে?’ দুপুরে খেতে বসে মা জিজ্ঞাসা করলেন। পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে যারা আসন্ন বিপদের উপস্থিতি টের পেয়েও মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারেনা। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। কনুইটা তো ছড়ে গিয়েই ছিল, গালের ওপর পড়ল আরেকটি চড়। দুপুরে মা ঘুমোলে ছেলেটা আবার চুপি চুপি বার হল। এর একটা প্রতিশোধ নেওয়া দরকার।
শীতের সূর্য তাড়াতাড়ি বিদায় নেয়। তবে এখনও বেলা কিছুটা আছে। যারা খেলছিল তাদের এখন মধ্যাহ্ন ভোজনের সময়। ভেসে আসা কোলাহল আর টুকরো হাসির ফোয়ারা জানান দিচ্ছে যে সকলেই বেশ উপভোগ করছে। একটু দূরেই ব্যাট দুটো পড়ে ছিল। পাশেই ফেদারটা। ছেলেটা সকলের নজর এড়িয়ে চুপিসাড়ে সেখানটায় এসে দাঁড়াল, তারপরে অতি সন্তর্পণে ফেদারটা তুলে নিয়ে পাশে একটা খেজুর গাছের আড়ালে চলে গেল। বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকা আগুনটা যেন একটু বাতাস
পেয়ে গেল। প্রথমে ও ফেদারটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ল, তারপর মাটিতে ফেলে দুপায়ে পিষতে লাগল।
মনের জ্বালা কিছুটা জুড়িয়ে এসেছিল, হঠাৎ পিঠের ওপর পড়ল সপাটে একটা বাড়ি। ও চকিতে পিছন ফিরে দেখল সেই দস্যি ছেলেটা একটা ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট নিয়ে হিংস্র বাঘের মত দাঁড়িয়ে আছে। দুচোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। কী করবে বুঝতে না পেরে ও ছেলেটাকে দু’হাত দিয়ে ধাক্কা মারল। ছেলেটা মাটিতে পড়ে গেল। ব্যাটটা ছিটকে পড়ল দূরে। ও এবার ব্যাটটা তুলে নিয়ে সজোরে চালিয়ে দিল ছেলেটার হাতে। ছেলেটা যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল। আর ও ব্যাটটা নিয়ে লাগাল দৌড়। দৌড়োতে দৌড়োতে অনেকটা দূরে এসে লক্ষ করল দস্যি
ছেলেটাও ওর পিছু নিয়েছে। ও আরও জোরে দৌড়োতে লাগল। এসে থামল একেবারে নদীর চরে। এ জায়গাটা খুব নিরিবিলি। চারিদিকে শুধু বড় বড় পাথরের চাঁই আর এলোমেলো খেজুরের গাছ। দস্যি ছেলেটা নদীর পাড় অবধি এসে হাঁফাতে লাগল। এখানে অবধি আসার ক্ষমতা ওর নেই। হাফপ্যান্ট পরা ছেলেটা এবার মনেমনে যুদ্ধ জয়ের হাসি হাসল, তারপর দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাটটাকে হাঁটুর ওপরে রেখে দু’হাতে সজোরে চাপ দিল। ব্যাটের হ্যান্ডেলটা কিছুটা বাঁকলো। তারপর সেটাকে ছুঁড়ে দিল খেজুরগাছের ঝোপের মধ্যে, যেখান থেকে খুঁজে পাবার ক্ষমতা কারওর নেই। সূর্য তখন ঢলে পড়েছে নদীর কোলে।
৩
ঢেউ গুনতে গুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। অপর্ণা ঠেলা মেরে বলল, ‘ওঃ, কি লোক রে বাবা। বেড়াতে এসেও ঘুমায়। ওঠো.., ফিরতে হবে না?’
আমি হাতঘড়ি দেখলাম। সাড়ে ছ’টা। আমরা জিনিসপত্র গুছিয়ে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে লাগলাম। চরে বাঁধা নৌকোগুলোয় হ্যারিকেনের আলো জ্বলতে শুরু করেছে। ওরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। অনেক ভোরে উঠতে হয় ওদের।
আমি গাড়ি স্টার্ট দিলাম। ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলো কুয়াশা পরিবৃত হয়ে রাস্তাকে আলোকিত করার পরিবর্তে অন্ধকারকেই যেন বেশি প্রকট করে
তুলেছে। তবে গাড়ির হেডলাইটে রাস্তার দৃশ্যমানতা যথেষ্ট। গাড়ি মেন রোডে এসে পড়ল। অপর্ণাকে বললাম, ‘নজর রেখো তো, পেট্রল নিতে
হবে।’
অপর্ণা অনেকক্ষণ ধরেই চুপচাপ। সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়ে বলল, ‘জানো, আজকে তোমার মেয়ে একটা কাণ্ড করে বসেছে।’
—‘কি আবার কাণ্ড?’ আমি পিছন ফিরে মেয়ের দিকে তাকালাম।
—‘আমরা যখন দুপুরবেলায় খেলছিলাম, একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আমাদের খেলা দেখছিল। মেয়েরই বয়সি। মাঝেমধ্যে ফেদার এদিক ওদিক চলে গেলে কুড়িয়ে আনছিল। খেলা শেষ হলে মেয়ে বলল, মা, দেখে মনে হচ্ছে ওরা খুব গরিব। একটা ব্যাট ওকে দিয়ে দিই?’
‘আর তুমি দিয়ে দিলে?’ আমি বিরক্ত হয়ে বললাম।
‘আঃ কেমন মানুষ গো তুমি। দিলামই না হয়। তুমি পরে না হয় একটা কিনে দিও?’ অপর্ণা মৃদু তিরস্কার করল।
গাড়ি মাঝারি স্পিডে চলছিল। চারপাশে হালকা কুয়াশা। রেডিওতে পুরনো গানের সুর। অপর্ণা যেন মনের অতলে ডুব দিয়েছিল। তারপরে হঠাৎ কোন গুপ্তধন খুঁজে পেয়েছে এরকম একটা ভাব করে বলল, ‘জানো, একটা খুব পুরনো ঘটনা মনে পড়ে গেল।’
আমি রেডিওর ভল্যুম কম করে দিলাম।
অপর্ণা বলল, ‘আমি তখন খুব ছোট। বাবা, মায়ের সঙ্গে একবার এখানে পিকনিক করতে এসেছিলাম। দাদাও ছিল। আমরা নদীর ধারে ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম, হঠাৎ দাদার সঙ্গে একটা ছেলের খুব ঝামেলা লাগল।’
—‘তারপর?’
—‘দু’জনের মারপিট শুরু হল। তারপর ছেলেটা দাদাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে একটা র্যাকেট নিয়ে পালাল। দাদাও পিছু নিল।’
—‘তারপর?’ এই শীতের মধ্যেও যেন আমার ঘাম দিতে শুরু করল।
—‘তারপর ছুটতে ছুটতে অনেক দূরে গিয়ে ছেলেটা র্যাকেটটা জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দিল। আমরা অনেক খুঁজলাম, কিন্তু পেলাম না। আমি খুব কেঁদেছিলাম।’
অপর্ণা একটু দম নিল। তারপর মনের যত বিরক্তি আর ক্ষোভ উজাড় করে দিয়ে বলল, ‘কী শয়তান ছেলে দেখেছ। সামনে পেলে না একবার চড়িয়ে গাল লাল করে দিতাম। অসভ্য বাঁদর কোথাকার।’
আমি সজোরে ব্রেক কষলাম। অপর্ণা চমকে উঠে বলল, ‘কি হল?’
রাস্তার ধারে একটা পেট্রল পাম্পে টিমটিম করে আলো জ্বলছিল। আমি সেই দিকে ইশারা করে বললাম, ‘পেট্রল নিতে হবে।’
পরের দিন অফিস থেকে দুপুর দুপুর বেরিয়ে পড়লাম। ট্যাক্সি নিয়ে শিয়ালদা। সেখান থেকে ট্রেন। মা-বাবা আমাদের পুরনো বাড়ি ছেড়ে এখন বারুইপুরে থাকেন। আমি মাঝেমধ্যে এরকম না জানিয়েই চলে আসি। আমাকে দেখে মায়ের মুখে যে খুশির তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে, তার কাছে পৃথিবীর সকল ঐশ্বর্য মূল্যহীন। তবে আজকে এখানে আসার একটা অন্য কারণ আছে। মা লুচির জন্য ময়দা মাখতে বসলেন। বাবা বেরলেন নাতনির জন্যে নলেনগুড় কিনতে। কলকাতায় নাকি এসব ভালো পাওয়া যায় না। আমি সেই ফাঁকে দোতলার চিলেকোঠায় হানা দিলাম। এ জায়গাটা আমার বড় প্রিয়। একটা কাঠের তক্তপোষ আছে। তার তলায় পুরনো একটা ট্রাঙ্ক। টেনে বের করলাম। আমার ছোটবেলায় ব্যবহার করা জামাকাপড়, খেলনাপত্র সব যত্ন করে রেখে দিয়েছেন মা। পুরনো বই, দু-চার খানা খাতা, ক্লাস ফাইভের ফার্স্ট প্রাইজের ট্রফি, মায়ের হাতে বোনা আমার প্রথম সোয়েটার, ঘুড়ি, লাটাই, লাট্টু সবই আছে। একের পর এক সব
বের করলাম। জিনিসটা এখানেই রেখেছিলাম, স্পষ্ট মনে আছে। তখন সেভেনে পড়ি। নদীর ধারে খেলতে যেতাম রোজ। শীতকালে শহর থেকে দলে দলে পিকনিক করতে আসত অনেকে। সেবারে ওই ছেলেটার সাথে মারপিট হল। ওদের সঙ্গে একটা ফুটফুটে মেয়ে ছিল। ওদের একটা র্যাকেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। প্রথম দিকে ব্যাপারটাতে বেশ মজা লাগলেও, কিছুদিন পর থেকে মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। একদিন নদীর ধারে গিয়ে অনেক করে খুঁজলাম র্যাকেটটা, পেয়েও গেলাম। খেজুর গাছের ঝোপে আটকে ছিল। বাড়ি নিয়ে
এসে ট্রাঙ্কে রেখে দিলাম। ভেবেছিলাম কোনওদিন দেখা হলে ফেরত দেব। পরের বছর বড়দিনে আবার গেলাম নদীর ধারে। পেলাম না। ছেলেটার মুখ ভালো করেই মনে ছিল। পরের বছর আবার গেলাম। তার পরের বছর আমরা ডায়মন্ড হারবারের পাট গুটিয়ে পাকাপাকি ভাবে বারুইপুরে চলে এলাম। ভাবতেই অবাক লাগে যে ওই ছোট্ট মেয়েটাই এখন আমার স্ত্রী।
বাড়ি ফিরতে রাত হল। অপর্ণা আমাকে দেখে বলল, তুমি হাত মুখ ধুয়ে এসো, আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি। অপর্ণা রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল, আমি ওর রাস্তা আটকে দাঁড়ালাম। খবরের কাগজ মোড়া একটা প্যাকেট ওর হাতে দিয়ে বললাম, ‘এটা আমার কাছে তিরিশ বছর ধরে গচ্ছিত ছিল। দেখত, চিনতে পার কিনা?’
অপর্ণা চোখে একরাশ কৌতূহল। ও আমার হাত থেকে নিয়ে প্যাকেটটা খুলতে লাগল। একটা করে পরত খুলছে আর কৌতূহল গভীরতর হচ্ছে। অবশেষে যে বস্তুটা বেরিয়ে এল সেটা দেখে অপর্ণা কেমন থমকে গেল। অনেক পুরনো, মরচে পড়ে গেছে, হাতলটা একটু বাঁকা। অপর্ণার মন শাটল ককের মতন খুব দ্রুত গতিতে একবার অতীত আর একবার
বর্তমানের মধ্যে ছুটে বেড়াচ্ছে আর কোনও পাকিয়ে যাওয়া জট ছাড়াবার চেষ্টা করছে। অবশেষে, অপর্ণার ঠোঁটে হাসি। আমি নিরাপদ দূরত্বেই ছিলাম। অপর্ণা ছুটে এসে প্রথমে আমার জামাটা খামচে ধরল, তারপর র্যাকেটটা নিয়ে পিঠে দু-ঘা কষিয়ে দিয়ে বলল ‘তুমিই তাহলে সেই...!’
ও আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে বললাম, ‘অসভ্য, পাজি, বদমাশ...।’
দেওয়াল ঘড়িতে রাত এগারোটা বাজল। বাইরে কুয়াশা মাখা হিমেল রাত প্রহর গুনছে ভোরের অপেক্ষায়।
অলংকরণ : সুব্রত মাজী